গডফাদারদের খেলা শেষ! | রূপান্তরের গল্প ৩৬১ | Rupantorer Golpo 361 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৬১ : একটি দস্যুদল ভেঙ্গে তিনটি দল হলো। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জাহাঙ্গীর বাহিনী ভেঙ্গে তিন টুকরো হয়েছে। আর ছোট-বড় যাই হোক, দস্যুদল মানেই তাকে চাঁদা দিতে হবে। না দিলে জঙ্গলে আসলে জেলেদের অপহরণ করা হবে, মুক্তিপণ দিয়ে তাদের ছাড়াতে হবে। তার মানে জেলেদের ভোগান্তি বেড়েছে। মধ্য সুন্দরবন থেকে এমন তথ্যই পাচ্ছি। এক দলকে চাঁদা দিয়ে পার পাচ্ছে না জেলেরা।
জাহাঙ্গীরের চাঁদা দিতেই হবে। দালালের মাধ্যমে নৌকা প্রতি দশ হাজার টাকা দিয়ে জেলেরা ঢুকছে পশুর আর শিবসার মাঝের সুন্দরবনে। এদিকে মাছ কাঁকড়া বেশি হয়। এই অভয়াশ্রমে অবাধে মাছ ধরার অনুমতি দেয় বনদস্যুরা। বনরক্ষীদের কথা না ভাবলেও চলে।
সবকিছু ঠিকই ছিলো। জাহাঙ্গীর বাহিনীর টিকেট নিয়ে বনে প্রবেশ করলেই হতো। কিন্তু এখন আরও দুটি দল চাঁদা চাচ্ছে। ভাই ভাই বাহিনী নামে নতুন দস্যুদল নেমেছে। সেই দলের প্রধান ফারুক। আরেকটি বেনামী দলও আছে। জেলেরা বলছে, রাতের অন্ধকারে তারা জেলেদের ধরছে। যা পাচ্ছে কেড়ে নিচ্ছে। কয়েক জন জেলেকে অপহরণও করেছে তারা। খবর নিলাম। জানলাম, ছোট রাজু তার লোকজন নিয়ে এই অপকর্ম করছে। দুটি দলই জাহাঙ্গীর বাহিনী ভেঙ্গে হয়েছে।
জেলেরা নতুন করে আতঙ্কে পড়েছে। সেই ভয় ছড়িয়ে পড়েছে উপকূলে। আর ভয় মানেই এক শ্রেণির মানুষের ব্যবসা, ভয়ের ব্যবসা সুন্দরবনে দারুণ চলে।
সোর্সরা এখন বেশ তৎপর। কোস্টগার্ড, RAB, পুলিশের তৎপরতা বেড়েছে। ওদিকে দস্যুদের পৃষ্ঠপোষকরা সক্রিয়। অভিযান চলছে জঙ্গলে। বনদস্যুদের সহযোগিদের ধরার চেষ্টা করছে বাহিনীগুলো। এসব নিয়ে বেড়েছে তাদের সোর্সদের হম্বিতম্বি। আর সোর্সরা নড়াচড়া করলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
মারামারি, চেক এর মামলা, জমিজমা সংক্রান্ত মামলা, বন মামলাসহ যেকোনো মামলার আসামীরা এখন দৌড়ের উপর। মানে কারোই ঘরে থাকার উপায় নাই। ওয়ারেন্ট আছে যাদের তারা পালিয়ে গেছে এলাকা ছেড়ে। ওই বাড়িগুলোতে গিয়ে বউ-বেটিদের সাসিয়ে আসছে সোর্সরা। মটরসাইকেলে করে ঘুরছে পুলিশ। রামপাল, মংলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, কয়রা, শ্যামনগরের গ্রামে গ্রামে চলছে তল্লাশী।
সবাই বেশ ক্ষুব্ধ। বনদস্যুতা নিয়ে চাপ সব সময় কম বেশি ছিলো। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। দস্যুদের তৎপরতা বেড়েছে সেই খবর ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছছে। এখন দুইজন জেলে অপহরণ হলেও জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো খবর প্রচার করে। সেই খবর দেখেন বড় কর্তারা। তাঁরা চাপ দেন সংশ্লিষ্টদের। উপর থেকে চাপ বাড়তে বাড়তে মাঠে গিয়ে তা চুড়ান্ত চাপে পরিণত হয়। এখন তাই ঘটছে। এভাবেই চলছে গত কয়েক দিন ধরে।
বিকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফোন করলেন। সন্ধ্যায় বাসায় চায়ের দাওয়াত। বুঝতে পারছি উল্টা পাল্টা খবর আসছে তাঁর কাছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে পূর্ণ সমর্থন দেন, বিশ্বাস করেন। সেকারণেই দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের কাজ এতোটা এগিয়েছে। বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েক দফায় RAB এর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সাথে কথা হচ্ছে। কোস্টগার্ডের গোয়েন্দা প্রধানের সাথেও কথা হলো। প্রত্যকেই ভীষণ চাপে। দস্যুতা বাড়লো কেন? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারছেন না কেউ।
সন্ধ্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় গেলাম। সোজা উনার ঘরে ঢুকলাম। দেখি, বিভিন্ন বাহিনীর কয়েক জন সিনিয়র কর্মকর্তা বসা তাঁর সামনে। আমিও বসলাম। মন্ত্রী বললেন, সুন্দরবনের কী অবস্থা? বললাম, অবস্থা তো ভালোই। উনি বললেন, কিন্তু আমার কাছে তো ভালো খবর আসছে না। বললাম, আপনাকে যারা খবর দিচ্ছেন তাঁরা ভুল তথ্য দিচ্ছেন। ওখানে বসা লোকজন একটু নড়ে চড়ে বসলেন। আবারও বললাম, আপনার কাছে খবগুলো ঠিকঠাক আসে না। যারা আপনাকে খবর দেয় তাদের দোষ নাই। মাঠ থেকে বিভ্রান্তুকর তথ্য দিলে উনারা করবেন কী?
পাশ থেকে একজন কর্মকর্তা বললেন, ডাকাতি বেড়েছে, এবিষয়ে কোনো সন্দেহ আছে? জানতে চাইলাম, কোন বাহিনী কতোজন জেলে অপহরণ করেছে বলতে পারবেন? সুন্দরবনের কোন কোন জায়গায় ঘটনাগুলো ঘটেছে? সাগরে কয়টা দস্যুতা হয়েছে এর মধ্যে? কর্তা বললেন, অনেক। বললাম, কতোগুলো জানতে চাইছি। উনি বললেন, গত এক সপ্তাহে ১৫-২০ জন অপহরণ হয়েছে বলে খবর আছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের কথোপকথন শুনছেন। বললাম, আমার জানা মতে চলতি গোনে মানে এই পক্ষে সুন্দরবনে মোট দশটি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। জাহাঙ্গীর, ছোট রাজু, বড় সুমন, আলিফ মোশাররফ সহ কয়েকটি বাহিনীর কাছে এখন অপহৃত জেলে আছে ৬০ জনেরও বেশি। আলিফ সাগর থেকে জেলেদের ধরে এনেছে। পটুয়াখালীর ট্রলার মালিকের জেলে তারা। জনপ্রতি তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ চাচ্ছে আলিফ।
আমার হিসাব শুনে উনাদের কথা থেমে গেলো। বললাম, হিসাবই যদি ঠিক না থাকে, সঠিক তথ্য যদি আপনাদের কাছে না আসে তাহলে সিদ্ধান্তও ভুল হবে। আরেক কর্তা বললেন, সে ঠিক আছে। অনেকে থানায় বা কোনো ক্যাম্পে জানায় না বলে আমরা অনেক খবর জানতে পারি না। বললাম, একটা অপহরণের মতো সংঘবদ্ধ অপরাধ হচ্ছে। আপনারা থানায় অভিযোগ আসার অপেক্ষা করবেন?
তাহলে কী করা যায়? প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত। তিনি সুন্দরবনের দস্যুতা নির্মূল নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই কথায় বুঝলাম সর্বোচ্চ জায়গা থেকে চাপ এসেছে। সেজন্য বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীলরা তৎপর। মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বললেন, জাহাঙ্গীরকে সারেন্ডার করাতে পারছো না কেন? বললাম, সর্ষের ভেতরে ভুত থাকলে কী করা যাবে? দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ চাইছেন না আমি এর মধ্যে থাকি। এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আমি থাকতেও চাই না। তবে মাঠের বাস্তব পরিস্থিতির খোঁজ রাখছি। সেটুকু আপনাকে জানিয়ে যাই।
সুন্দরবনে দস্যু দলগুলো আত্মসমর্পণ করছে। তবে অনেকই চায় না এটা চলুক। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের জমাট বাঁধা চক্রে ভাঙ্গণ ধরেছে। এখন অনেক কিছুই হবে। দস্যুদল ভাঙবে। গোলাগুলি বাড়বে। সুন্দরবনে দস্যুতার সংখ্যাও বাড়বে।
এসময় অনেকেই ভুল করবে। এখন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও যদি ভুল করে তাহলে চলবে কী করে? বরং তাদের ভুলে দস্যুতার পৃষ্ঠপোষক বা গডফাদাররা আগের ভূমিকায় ফিরে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ওদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিবো। বললাম, ব্যবস্থা এখনও নেননি। এতোগুলো দস্যুদল সারেন্ডার করলো, এদের অস্ত্রের সাপ্লাইয়ার কে বা কারা সেটা জানেন? কোনো তদন্ত হয়েছে? এসব কথা বলতে ভালো লাগে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর পাশে বসা কর্মকর্তাদের বললেন, তাহলে আমাকে আপনারা এতোক্ষণ কী বুঝালেন? আপনাদের বুঝ নিয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানালে কেমন হতো? উনারা উত্তরে কী বলেছিলেন আর শুনিনি। তার আগেই উঠে দাঁড়ালাম। মন্ত্রী শুধু বললেন, কাজ থামিও না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করেন। তার কারণও আছে। সুন্দরবনে কাজ শুরুর আগে তাঁকে ভাই বলে ডাকতাম। একদিন আমার নিউজে তাঁর ইন্টারভিউ দেখে আমার বাবা বললেন, এই কামাল তো মিলিটারি একাডেমিতে আমার কোর্সমেট ছিলো! মানে বাংলাদেশের প্রথম কমিশনড অফিসার্স কোর্স এ তাঁরা একসাথেই সুযোগ পেয়েছেন। অনেক আগেন কথা। তারপর প্রশিক্ষণ শেষ না করে কামাল চলে আসে। এই কথা জানার পর থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ডাকতে হয় চাচা। উনিও আমাকে ভাতিজা ডাকেন, স্নেহ করেন, সেই সূত্রেই তুমি বলে ডাকেন।
পেশাগত কাজ অথবা সুন্দরবনে আমার কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে এই সুসম্পর্কও কাজে দিয়েছে। যেকোনো প্রয়োজনে তাঁকে আমি ফোনে পাই। বাসা কিংবা অফিসে গেলেও দেখা হয়। ব্যস্ততা থাকলেও তিনি আমাকে সময় দেন। প্রয়োজনীয় কথা শেষ করে আমি চলে আসি। এই সম্পর্কের কোনো সুবিধা আমি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে নেইনি। তবে সেটি অনেক ক্ষেত্রে আমাকে সুরক্ষাও দিয়েছে। সেই গল্প আরেকদিন হবে। যাই হোক, মন্ত্রীর বাসা থেকে বের হলাম।
মনের কথাগুলো বলতে পেরে নিজেকে একটু হাল্কা মনে হচ্ছে। ধানমন্ডি থেকে বাসায় না এসে চলে গেলাম অফিসে। ডেস্ক-এ বসে সুন্দরবনের দস্যুদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে লিখতে বসলাম। মোটামুটি তথ্য যা আছে সবকিছু একসাথে করলাম। দস্যুদল, দস্যুনেতা, তাদের সাথে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ, অবৈধ অস্ত্র আনা-নেওয়ার কাজ কারা করছে তাদের নাম লিখে ফেললাম। কোন কোন মাচ ব্যবসায়ী কোন দস্যুদলের পৃষ্ঠপোষক, স্থানীয় সহযোগী কারা, এসব নিয়ে বিস্তর তথ্য আছে। সেগুলো গুছিয়ে রাখলাম। ছোটখাটো কাঁকড়া শিকারী থেকে সুন্দরবনের বড় মাছ ব্যবসায়ী কতো জনের নাম আছে সে তালিকায়!
রাতে বাসায় ফিরে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম। একটার পর একটা ফোন চলছে। তথ্যগুলো ক্রসচেক করলাম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কাজ এগিয়ে নিতে বলেছেন। সবাই বলছে আমি যেন কাজ করা না থামাই। তাই গুছিয়ে আবার শুরু করবো।
রাতেই বিশ্বস্ত সোর্সদের ফোন দিলাম। বললাম, তোমরা অকাজ করা বন্ধ করো। আমি আবার মাঠে নামবো। চারপাশে খোঁজ লাগাও। একজন বললো, জাহাঙ্গীর তো কথা শুনছে না ভাই। বললাম, ওকে বাদ দাও। সে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনছে। ও এমনিতেই ধরা খাবে। আমরা অন্য দলগুলোকে নিয়ে কাজ আগাবো। পশ্চিমের দস্যু আলিফ আর পূর্ব সুন্দরবনের বড় সুমন বাহিনীর সাথে শুধু কথাই হচ্ছে। সুমন তো তাও দেখা করেছে। আলিফের সাথে দেখাও হয়নি।
ঠিক করলাম, কাল থেকেই আলিফকে নিয়ে নতুন করে মাঠে নামবো। সে সুন্দরবন ছেড়ে সাগরে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। শুনছি পটুয়াখালীর চর মন্তাজের সেই খোকন মাঝির সাথে দেন দরবার চলছে তার। সোর্সদের বললাম, আলিফকে আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। ওর লোকাল বড় ভাই কে কে আছে? খোঁজ নিয়ে জানাও। ওরা কাজে নেমে পড়লো। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেলাম আমি। কয়েক দিন পর একটা শান্তির ঘুম দিলাম!
পরদিন দুপুর থেকে একটার পর একটা ফোন আসছে। চালগুলো তার মানে কাজে দিচ্ছে। সুন্দরবনের খেলাগুলো অন্যদের হাত থেকে ছুটতে শুরু করেছে। সুন্দরবনের দস্যু জগতের মোড় আবার ঘুরে যাবে মনে হচ্ছে!
(ঘটনা ২)১৭ সালের জানুয়ারি মাসের। ছবিটি সুন্দরবনের ভেতরে তোলা। একটি দস্যুদলের RAB হেফাজতে যাওয়ার সময়ের)