এবারের টার্গেট আলিফ বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ৩৬২ | Rupantorer Golpo 362 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৬২ : ডাকাত ধরলেই মাইরে হাত-পা ভেঙ্গে দিচ্ছে। সুন্দরবনে আর যাওয়ার উপায় নাই। এক পার্টিকে চাঁদা দিয়ে ঢুকি। পথে আরেক পার্টি ধরে। পুরা সুন্দরবন ডাকাতে ভরে গেছে… সুন্দরবনের জেলেদের মুখে মুখে ঘুরছে এমন কথা। বলা হচ্ছে, এক জাহাঙ্গীর বাহিনীই দুইবার করে টাকা নিচ্ছে!
এক বাহিনী দুইবার টাকা নিচ্ছে? কেমন করে? সোর্সদের বললাম, একটু খোঁজ নিয়ে দেখেন তো! দুই-তিন দিন পর জানলাম, ঘটনা সত্য।
জাহাঙ্গীর এখন টাকা কামানোর জন্য মরিয়া। সে দ্রুত বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিবে। মানে জঙ্গল ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাবে। তার আগে কয়েক কোটি টাকা জমাবে। এতোদিন বড় বাহিনীগুলোর কারণে সে কোণঠাসা ছিলো। এবার বড় দাঁও মারতে চায়। সেজন্য নতুন কৌশল নিয়েছে সে। এক দিক থেকে চাঁদা তুলছে। মানে তার হয়ে চাঁদা তুলছে কিছু মাছ ব্যবসায়ী। বাহিনীর নামে চাঁদার স্লিপ দিচ্ছে তারা। অন্যদিকে রাতের বেলা মুখ ঢেকে তারই একটি দল খালে খালে ঘুরছে। অন্ধকারে অস্ত্র উঁচিয়ে তারই লোকজন বলছে, এটা অন্য বাহিনী, নতুন নেমেছে। তাৎক্ষণিক টাকা না পেলে জেলেদের অপহরণ করছে তারা। নতুন ফোন নাম্বার ব্যবহার করছে। বাহিনীর নাম পরিচয় না দিয়ে নিচ্ছে মুক্তিপণ।
নতুন এই গ্রুপটিকে নিয়ে আলোচনা চলছে চারপাশে। কেউ বলছে, এটি জাহাঙ্গীর বাহিনী থেকে বের হয়ে আসা বাহিনী। কেউ কেউ বলছে, পুরনো সেই রাজু ফিরে এসেছে। সেই এসব করছে কিন্তু কাউকে চেহারা দেখাচ্ছে না! বিশ্বাস অবিশ্বাসের মধ্যে ঘুরছে এসব কথা। কিন্তু আমাকে নিশ্চিত হতে হবে।
সাবেক দস্যুনেতা এখন আত্মগোপনে। বেশ কিছুদিন আগে একটি নাম্বার থেকে ফোন দিয়েছিলো। অবশ্য তার আগে যতোগুলো নাম্বারে কথা হয়েছে সবগুলো বন্ধ। তবুও চেষ্টা করি। শেষ নাম্বারটা বের করে ফোন দিলাম। রিং গেলো। ফোন ধরলো একজন। রাজুর নাম্বার কী না জানতে চাইনি।
শুরুতে নিজের পরিচয় দিলাম। এরপর ওদিক থেকে আসলো সেই কণ্ঠ। সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, জঙ্গলে নামছিলেন? রাজু বললো, না ভাই। বললাম, আবার ডাকাতি করতে নামার ইচ্ছা আছে? সে বললো, নামবো না। আর উপায়ও রাখেননি। আমার রেখে আসা সবগুলো অস্ত্র তো সারেন্ডার করায়ে দিলেন! বললাম, আর নামা লাগবে না আপনার। নামলে বাঁচতে পারবেন না।
রাজু বললো, আপনাকে আমরা পছন্দ করি। কিন্তু খুলনার অনেক মানুষ আপনাকে দেখতে পারে না। সাবধানে চলবেন। একই সাথে আপনার পাশের লোকজনের দিকেও খেয়াল রাখবেন। অবৈধ অস্ত্রের কারবারী আর কয়েক জন মাছ ব্যবসায়ী আপনার উপর ক্ষেপছে। ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রাখলাম। ভাবছি, আমাকে কি রাজু সত্য কথা বললো? না কী বিভ্রান্ত করলো?
জটিলতা বাড়ছে কি? নিজেই ভাবি। নিজেই উত্তর খুঁজি। শুরুর দিকের আত্মসমর্পণগুলো বেশ নির্বিঘ্নে করেছি। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দস্যুদের নিয়ে আসছি। কিন্তু এখন চারপাশ দিয়ে শংকা বাড়ছে। কিন্তু তাতে দমে যাওয়া চলবে না। মাঝপথে কাজ থামিয়ে দেওয়ার মানুষও আমি না। পরিস্থিতি বিবেচনা করে কাজগুলো গোছাতে শুরু করলাম।
সাবেক দস্যুনেতা রাজু জঙ্গলে আসলে বিরাট ঘটনা। কিন্তু সে আত্মগোপনেই আছে। তার নাম ছড়াচ্ছে জাহাঙ্গীর। বেশ কৌশলে সে সুন্দরবনকে অস্থিতিশীল করছে। সেই সুযোগে নিজের রোজগার বাড়াচ্ছে। তার কৌশল এখন পরিস্কার বুঝতে পারছি। জাহাঙ্গীর সারেন্ডার করবে না নিশ্চিত। কিন্তু তার অপকর্মগুলোকেও আর সহজ রাখবো না।
RAB এর গোয়েন্দা প্রধানকে বিস্তারিত জানালাম। তিনি বললেন, ভেতরে যাই থাকুক দস্যুতা তো বেড়েছে! বললাম, আমি শুধু বিভ্রান্তিগুলো দূর করার চেষ্টা করছি। বাকীটা আপনাদের ব্যাপার। উনাকে পরিস্কার ভাবে বললাম, জাহাঙ্গীরকে নিয়ে আমি কোনো কাজ করবো না। তবে পশ্চিম সুন্দরবনের আলিফের সাথে কথা চলছে। সম্ভবত পরবর্তী গ্রুপ ওরা। উনি বললেন, আলিফের সাথে কি আপনার দেখা হয়েছে? বললাম, দেখা হলে জানতেন। উনি বলেন, ইদানিং অনেক কিছুই তো জানান না।
পূর্ব সুন্দরবনের দস্যু বড় সুমন বাহিনীর সাথে দেখা করেছি, এই খবর কাউকে জানাইনি। গোয়েন্দা প্রধানকে বললাম, কিছু বিষয় গোপন থাকুক ভাই। ইদানিং ঝুঁকি বেড়েছে। কিছু মানুষ হয়তো আমাকে পছন্দ করছেন না। সরাসরি না হলেও তারা আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। একটা গ্রুপ আমার নামে অপপ্রচার করছে। আরেকটি গ্রুপ দস্যুদের আত্মসমর্পণ নিয়ে প্রশ্ন উঠাচ্ছে। সেখানে আপনাদেরও প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে।
লে কর্নেল আজাদ সজ্জন মানুষ। দায়িত্বশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকেও বেশ চৌকষ। আমার কথাগুলো শুনে তিনি ভীষণ অবাক হলেন। বললেন, RAB এর কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে কারা? বললাম, আপনারা খোঁজ নেন। উনি ঠিক আমলে নিলেন না। বললেন, বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নাই। সবকিছুই তো স্বচ্ছ!
পরের দিন একটু অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সুন্দরবনের খোঁজ খবর রাখতে পারিনি। রাতে একে একে সোর্সদের সাথে কথাবার্তা বললাম। খুলনার সুতারখালীর এক সোর্স জানালো একজন সাংবাদিক বনদস্যুতা নিয়ে সংবাদ করতে এসেছেন।
সম্প্রতি দাদা ভাই নামের একটি দস্যুদলের নাম ডাক বেড়েছে। মধ্য ও পশ্চিম সুন্দরবনে তারা দস্যুতা করছে। চলতি গোনে ওরা কয়েক জন জেলেকে অপহরণ করেছে, মুক্তিপণ নিয়েছে। দস্যুতার শিকার এমন দুজন জেলের সাথে কথা বলেছেন সাংবাদিক। কয়েকজন শুঁটকি ব্যবসায়ীও কথা বলেছেন সেই সাংবাদিকের সাথে। যারা বক্তব্য দিয়েছেন তাঁরা সকলেই দুবলার চর, সেলার চরের মাছ ব্যবসায়ী। পয়সা ওয়ালা, দাপট ওয়ালা লোকজন তারা। এক সময় পুরো সুন্দরবন নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু দস্যুদের আত্মসমর্পণের পর থেকে তাদের দাপট কমতে শুরু করেছে। উনারা বলে বেড়ান, সারেন্ডারের মাধ্যমে ব্যবসা করছে RAB, আর সাংবাদিক মোহসীন উল হাকিম তাদের অবৈধ রোজগারের ক্যাশিয়ার!
আমার নামে এমন কুৎসা রটানো হচ্ছে। শুরু থেকেই একটি পক্ষ উসখুস করছে আর এমন অপতথ্য ছড়াচ্ছে। তারা এবিষয়ে জেলেদেরও উস্কানি দিচ্ছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জেলেরা তাদের সেই উস্কানিতে পা দিচ্ছে না। শুরুতে একটু দুশ্চিস্তা করতাম। কিন্তু জেলেরা দেখলাম সারেন্ডারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যখন দেখলাম মহাজনদের অপপ্রচারে তারা গা ভাসায়নি, তখন ভয় কাটলো। অবশ্য এই পরিস্থিতি কিছুদিন আগে পার করেছি। এখন নতুন করে কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না।
পরদিন একটি টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার হলো। যার শিরোনাম অনেকটা এমন- বনদস্যু আত্মসমর্পণ কোনো কাজে আসছে না। সংবাদটি দেখলাম। বলা হচ্ছে, মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দস্যু আত্মসমর্পণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা কোনো কাজেই আসছে না। বরং দস্যুতা বেড়েছে। জেলেরা অতীষ্ট। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি এমন- সারেন্ডারের সময় বনদস্যুরা সব অস্ত্র জমা দিচ্ছে না। তারা নাকী লোক দেখাতে কিছু অস্ত্র জমা দিচ্ছে। কিছু অস্ত্র লুকিয়ে রাখছে। শুধু তাই না, সারেন্ডার করে বনদস্যুরা আবারও ডাকাতি করতে নামছে। লুকিয়ে রাখা অস্ত্রগুলো ব্যবহার করছে।
ভাবতেই পারছি না! তথ্য প্রমাণ ছাড়া এমন মনগড়া তথ্য কী করে দিচ্ছে তারা? বনদস্যুদের পৃষ্ঠপোষক ও সুবিধাভোগী হিসাবে যাদের চিনি তারাই সাক্ষাতকার দিয়ে এসব কথা বলছেন। বুঝতে পারছি, সামনের কাজগুলো আরও কঠিন হবে। নিউজটি RAB সদর দপ্তরে পাঠালাম।
মেজর আদনান ফোন দিলেন বরিশাল থেকে। একটু উদ্বিগ্ন। বললাম, আমি দুশ্চিন্তা করছি না। সুন্দরবনের মানুষদের জন্য চিন্তা হচ্ছে। মাঝ পথে যদি আমাদের কাজটি থেমে যায় তবে তোমার আমার সমস্যা কোথায়? সে বললো, এখন দায়িত্বে আছি। সুন্দরবনে একটা কাজের কাজ করে যেতে পারলে ভালো লাগতো। বললাম, তোমাকে মহাজনরা পছন্দ করে না। আদনান বললো, ওরা না করুক, জেলেরা ভালোবাসে ভাই। তাদের জন্যই কাজটা এগিয়ে নেওয়া দরকার।
দুজন কথা বলে ঠিক করলাম, পরবর্তী টার্গেট আলিফ। আদনান তার দিক থেকে কথা শুরু করলেন। আমি শুরু করলাম আমার মতো। আলিফ এখনও সারেন্ডার নিয়ে কথা আগাতে চায় না। বলে, অস্ত্রশস্ত্র কিনে সে অনেক টাকার ঋণে পড়ে গেছে। শুধু ঋণ না, সূদে নেওয়া ঋণ। বললাম, অবৈধ অস্ত্র কেনার জন্যই সূদে ঋণ দেয় লোকজন? কার কাছ থেকে নিয়েছো টাকা? আলিফ ডাকাত বললো, খুলনার এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী তাকে ঋণ দিয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র কেনাকাটায় সহযোগিতা করেছে সেই স্বর্ণকারের স্ত্রী। সব বলবো, কিন্তু নাম বলবো না। বললাম, নাম জানার দরকার নাই। তুমি দ্রুত আমার সাথে দেখা করো!
(নোট: গল্পে গল্পে অনেক জটিল বিষয় উঠে আসছে এখনকার রূপান্তরের গল্পে। আপনাদের বুঝতে অমুবিধা হলে জানাবেন। বিরক্তি আসলেও বলবেন। পরবর্তী পর্বগুলো সেভাবেই লিখবো। ধন্যবাদ)