রূপান্তরের গল্প ৩৬৫ | Rupantorer Golpo 365

গভীর রাতে দুবলার চরে | রূপান্তরের গল্প ৩৬৫

গভীর রাতে দুবলার চরে | রূপান্তরের গল্প ৩৬৫ | Rupantorer Golpo 365 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৬৫ : ধুম করে ধাক্কা লাগলো। ট্রলার উঠে গেছে জঙ্গলের উপর। কুয়াশায় চারপাশ অন্ধকার। কিছুই দেখছি না। সর্দার চিৎকার করে উঠলেন। সুকানিতে তিনি। ডেক এর উপর বসা আমি। আর গলুইয়ে আমাদের নতুন সহযোগী। ছেলেটার নামটা এখনও জানা হয়নি। সামনে দাঁড়িয়ে তার ইশারা দেওয়ার কথা। কিন্তু কুয়াশায় সেও খেয়াল করেনি যে ট্রলার যাচ্ছিলো জঙ্গল বরাবর।

অন্ধকারে এমন হয়। কখনও বড়সড় দুর্ঘটনাও ঘরে। গতি কম ছিলো বলে বেঁচে গেছি। ব্যাক গিয়ারে ফেলে কিছুক্ষণ চেষ্টা চললো। কিন্তু ট্রলার আর নামে না। কী বিপদের কথা! ভাটা চলছে। এখনই নামাতে না পারলে এখানেই আটকে থাকতে হবে প্রায় আট ঘণ্টা। অতোক্ষণ দেরি করা যাবে না। অন্তত বড় নদীতে এভাবে আটকে থাকলে নানা রকম ঝুঁকিতে পড়তে পারি।

সুকানি আমার হাতে ধরিয়ে সামনে গেলেন সর্দার। এক নাগাড়ে চলছে মুখ। মানে গালির চাপে নতুন ছেলেটির নদীতে পড়ার অবস্থা।

কুয়াশায় এখানে বসে সামনের দিকটা দেখতে পাচ্ছি না ঠিকমতো। এতো বড় টর্চের আলো, তাও দেখা যাচ্ছে না। ছেলেটির কী দোষ? বরং উল্টো সর্দারকে বকাঝকা করছে সে। বলছে, অন্ধকারে এতো জোরে ট্রলার চালায়? আসলে গতি কমানোই ছিলো। স্রোত আর বাতাস এক দিকে চলছিলো বলে গতি বেশি ছিলো।

চিৎকার করতে করতে দুজনেই জঙ্গলে নেমে পড়লো। কাঁধে ঠেকিয়ে দিলো ধাক্কা। তাতেও মনে হয় কাজ হচ্ছে না। বুদ্ধি খাটিয়ে গতি বাড়ানোর দড়িটি বেঁধে আমিও এগিয়ে গেলাম। এখানে জঙ্গলে নামা বেশ কঠিন আমার জন্য। তাই হাতে লগি নিয়ে তালে তালে ঠেলতে থাকলাম।

কাজ হলো এবার। ধীরে ধীরে নামলো ট্রলার, ভাসলো পানিতে। এবার শুরু হলো নতুন বিপদ। ব্যাক গিয়ারে থাকায় ট্রলার চলে গেলো পেছনের দিকে, মানে তীর থেকে দূরে। লগি ছেড়ে দৌড়ে সুকানিতে গেলাম। এক্সেলেটরের দড়িটি খুললাম। একই সাথে গিয়ার বদলে ফ্রন্ট গিয়ারে দিলাম। কিন্তু ততোক্ষণে বেশ দূরে চলে এসেছি। কোন দিকে যাবো, কী করবো বুঝতে পারছি না। ওদের দেখতেও পাচ্ছি না।

মিনিট খানেক ধরে সুকানি হাতে হতভম্ব আমি। এই রাতে নতুন ধরনের বিপদ। ট্রলার নিয়ন্ত্রণ করার মতো সক্ষমতা কম। তীব্র স্রোতে সেটি আরও কঠিন।

কী করবো বুঝতে পারছি না। ট্রলার নিউট্রালে দিলাম। ভাসতে থাকলাম পশুর নদীতে। হঠাৎ দেখি পাশে বেলায়েত সর্দার। পাশে বলতে নদীতে। সাঁতরে চলে এসেছেন তিনি। কিছু বুঝে ওঠার আগে উঠে পড়লেন। তার পর পর উঠলো সেই ছেলেটি। সর্দারকে বললাম, কী করে আসলেন আপনারা? দেখলেন কী করে? সর্দার একটা হাসি দিলেন। বললেন, দেখতে পাচ্ছি না ঠিক, কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি তো। আমি জানি আপনি জঙ্গলের ধারে ফিরতে পারবেন না। তাই দেরি করিনি। ট্রলারের শব্দ টার্গেট করে সাঁতার দিছি।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বললাম, আগে ট্রলারটা নোঙ্গর করেন এখানে। তারপর কাপড় বদলান। যে শীত পড়ছে! সর্দার বললেন, সামনে খাল আছে। ওখানে গিয়ে একবারে নোঙ্গর করবো।

ভেজা শরীরে সুকানিতে দাঁড়ালেন আমাদের ক্যাপ্টেন। এমন পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখার অদ্ভুত কৌশল জানে এই লোকগুলো।

আন্দাজ করে আবার চলতে শুরু করলাম। ট্রলার এখন একদম জঙ্গলের কাছ দিয়ে চলছে। মাঝে মাঝে গাছের সাথে ধাক্কা লাগলেও সমস্যা হচ্ছে না। আর সমস্যা হলেও কিছু করার নাই। আমাদের সামনের খালে পৌঁছাতে হবে। বড় নদীতে থাকা যাবে না কিছুতেই।

মাঝে মাঝে বামে ছোট খাল পড়ছে। কিন্তু সেগুলো বেশি ছোট। কোনো রকমে ট্রলার ঢুকলেও ভাটার সময় আটকা পড়বো। চারপাশে ঘন জঙ্গল। বাঘের ঝুঁকিও বেশি। নতুন করে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত আর নেওয়া যাবে না।

প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা চলার পর সেই খালটি পেলাম। চরাপূঁটিয়ার দ্বিতীয় খাল। ভেতরে ঢুকলাম। নোঙ্গর ফেললাম ঠিক মাঝ বরাবর। ইঞ্জিন বন্ধ করে ওরা গা মুছে নিলো। কাপড় বদলে ডেক এ আসলো ছেলেটি। তিনজন মিলে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

বাই চুপ। মিনিট দশ পর মনে হলো ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নাই। তবে ক্লান্তি আছে শরীর জুড়ে। উঠে বসতেই সর্দার বললেন, কোনো সমস্যা ভাই? বললাম, জেগে আছেন আপনি? পাশ থেকে ছেলেটিও উঠে বসলো। বললো, আমিও জাগনা আছি কাকু! বললাম, তাহলে আর শুয়ে আছি কেন? চুলা জ্বালাও। একটু চা-মুড়ি খাই!

পশুর নদীর পাশের এই খালটি বেশ লম্বা। তবে চওড়ায় সামান্য। পাশাপাশি দুটি ট্রলার চালানো যাবে কোনো রকমে। এদিক দিয়ে সোজা পূর্ব দিকে গেলে বড় খাল। সেখানে চরাপুঁটিয়া ফরেস্ট অফিস। ওদিক দিয়ে পশ্চিমে চলে গেছে চরাপূঁটিয়ার এক নম্বর খাল। বের হয়েছে পশুরে। অফিস থেকে দক্ষিণে নেমেছে আরেকটি খাল। ওই খাল গিয়ে পড়েছে সেলা নদীতে। হরিণটানা পার হয়ে সেলা নদীর ওই জায়গাটি বেশ গভীর। আরেকটু নেমে গেছে টিয়ার চর। সেখান থেকে সোজা দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। আর পশ্চিমে কোকিলমনি।

অল্প করে মুড়ি মাখানো হলো পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে। তারপর আসলো চা। এমন সময় দূর থেকে ভেসে আসলো ট্রলারের শব্দ। ভাবছি এতো রাতে কে আসছে? কোন দিক থেকে আসছে ট্রলার? ভালো করে কান পেতে সর্দার বললেন, অফিসের ওদিক থেকে আসছে ভাই। মনে হয় ফরেস্টারদের ট্রলার।

এদিকে তিনটি দস্যুদল আছে। বড় সুমন, ছোট রাজু আর শামসু। মোশাররফের দস্যুদল এতো নিচে আসে না। এরা সবাই নৌকায় চলাফেরা করে। তাই দস্যুদের ট্রলার হওয়ার সম্ভাবনা নাই।

কাছাকাছি ওরা। ট্রলারের ভেতরে যতোগুলো বাতি আছে সবগুলো জ্বালানো হলো। সামনে গিয়ে বড় টর্চ হাতে দাঁড়ালাম আমি। টর্চ জ্বালিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়াই উদ্দেশ্য। কারণ ঘন কুয়াশায় দেখতে না পেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

ভাগ্যক্রমে কুয়াশা একটু কমেছে। একটু দূর থেকে ওদের দেখতে পেলাম। ট্রলারের সামনে বন বিভাগের পতাকা। টর্চ দিয়ে তারা পাল্টা ইশারা দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ইঞ্জিন নিউ্রটাল করে পাশে এসে ভিড়লো। একজন জানতে চাইলো, কারা? বললাম, যাচ্ছিলাম দুবলার চরে। পথে একটু বিরতি নিলাম। বনরক্ষী বললেন, কার ট্রলার? ভেতর থেকে বেরিয়ে জবাব দিলেন সর্দার, বললেন, আমি বেলায়েত সর্দার।

পরিবেশ বদলে গেলো। বনরক্ষী বরিশালের ভাষায় বললেন, তুই এহানে করো কী? সর্দার বললেন, মোরা তো মরছিলাম আরেকটু হলে! কুয়াশায় জঙ্গলে উঠে পড়লাম! পেছন থেকে আরেকজন বললেন, পাস পার্মিটগুলো দাও। সামনের জন বললেন, ও দেখা লাগবে না স্যার। আমাদের পরিচিত জেলে। চিলা বাজার বাড়ি। পেছনের জন আবারও বললেন, এদিকে থাকা যাবে না। ডাকাত দল ঘোরাফেরা করছে। এবার আমি বললাম, কোন বাহিনী ঘুরছে? সুমন বাহিনী নাকী নতুন দল?

আমার কথা শুনে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। টর্চ মারলেন আমার মুখে। তারপর চিৎকার করে বলে উঠলেন, আপনি সেই সাংবাদিক না? কী যেন নাম? যমুনা টিভির সাংবাদিক না আপনি? বললাম, জ্বি ভাই। সামনে দাঁড়ানো বনরক্ষীকে বললেন, তুমি তাকে চিনতে পারলে না? উনি তো আমাদের মোহসীন ভাই! বলেই উঠে আসলেন। হাত মিলালেন, কোলাকুলি করলেন। ভদ্রলোক নতুন এসেছেন এখানে। চরাপূঁটিয়ার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

আবার চা তৈরি হলো। গল্প হলো অনেক ক্ষণ। ওসি সাহেব বললেন, দুই দিন আগে নতুন একটা ডাকাত দল অফিসে আসছিলো। পুকুর থেকে পানি নিয়ে আবার চলে গেছে। বললাম, ছয়জনের দল? উনি বললেন, সেভাবে খেয়াল করিনি। তবে পাঁচ-ছয় জনই হবে। বললাম, তাহলে ছোট রাজু হবে। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে এসেছে ওরা। জাহাঙ্গীর বাহিনী থেকে পালিয়ে এসে নতুন দল করেছে। এদিকে শামসু বাহিনী নামে আরেকটা দল নেমেছে। ওই দলে ১২ থেকে ১৫ জন দস্যু আছে।

বনরক্ষীরা বিদায় নিলেন। এদিকে কুয়াশা কেটে গেছে। খাল থেকে বের হলাম। রওনা হলাম আবার। ভাটা এখনও ঘণ্টা দুই আছে। এক টানে অনেকটা পথ যেতে পারবো।

দুবলার চরে পৌঁছালাম রাত দুইটার দিকে। ভিড়লাম মরণ চরের ঠোঁটায়। পশুর নদী থেকে আলোর কোল খালে ঢুকতেই যে চরটি পড়ে সেটিই মরণ চর। সাময়িক শুঁটকি পল্লীটি শুরু এখান থেকে। আমরা নেমে পড়লাম। ভেতরের দিকে যাবো। উঠবো কোনো এক শুঁটকির ঘরে।

জানুয়ারি ২০১৭, সুন্দরবন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top