সুন্দরবনে নতুন দস্যু বড় ভাই বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ৩৬৮ | Rupantorer Golpo 368 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৬৮ : দেখতে দেখতে সুন্দরবন আবার বনদস্যুতে ভরে গেলো। মধ্য সুন্দরবনে নতুন করে নেমেছে বড় ভাই বাহিনী। আর একদম পশ্চিমে আবার নেমেছে জোনাব বাহিনী। জিয়া নামের আরেকটি দল নামবে নামবে করছে। আত্মগোপন থেকে বের হয়েছে সে। অবৈধ অস্ত্রের বাজারে দর কষাকষি চলছে। এদিকে পূর্ব সুন্দরবন অর্থাৎ পশুর নদীর পূর্ব দিকে এখন চারটি দস্যুদল ঘুরে বেড়াচ্ছে। জেলেরা রীতিমতো আতঙ্কে পড়ে গেছে।
দুবলার চরের নিউ মার্কেট এখন মানুষে ভরপুর। কতো রকমের মানুষ যে আছে এখানে! লোকালয়ে যা যা পাওয়া যায় তার সবই আছে। জেলেদের এই সাময়িক পল্লীর কম-বেশি ত্রিশ হাজার মানুষের জীবন চালানোর যাবতীয় জিনিষপত্র পাওয়া যায় এই মার্কেটে। এই বাজারের নাম নিউ মার্কেট কে দিলো, কেন দিলো কেউ বলতে পারে না। জেলেরা বলে, খুলনার নিউ মার্কেটে যা পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশি জিনিষপত্র এখানে পাবেন। তাহলে এটাকে নিউ মার্কেট বলবেন না? চায়ের আড্ডায় বসেছে অনেক পেশার মানুষ।
জেলেদের একটি নাম সর্বস্ব সমিতি আছে দুবলার চরে। তার সভাপতি নির্ধারণ করেন সাহেবরা। মূলত সাহেবদের আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন করে এর নেতারা। শুঁটকি পল্লীর সাধারণ জেলেদের সাথে এই সমিতির তেমন যোগাযোগ নাই। সিজনে ঘর প্রতি এক হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। সেই টাকা কোথায় খরচ হয় কেউ বলতে পারে না। মার্কেটে তাদের একটি ঘর আছে। সাহেব মহাজনরা এখানে বসেন। বাকী সময় থাকে তাদের লোকজন।
বেলায়েত সর্দারকে খুঁজে পাচ্ছি না। মানুষের ভীড়ে কোথায় জানি হারিয়ে গেছে। ফোনের নেটওয়ার্কও কাজ করছে না। রুহুল আমিন নামে এক তরুণ ছিলো পাশে বসা। ইশারায় কিছু বলার চেষ্টা করছে সে। পরে তাকে নিয়েই উঠলাম। বললাম, তোমাদের জেলে সমিতির ঘরে নিয়ে চলো। যেতে যেতে রুহুল আমিন বললো, চায়ের দোকানে সাহেবদের চ্যালারা বসা ভাই। আপনার কথা সব রেকর্ড করে নিচ্ছে। বললাম, আমি জানি। সেজন্য সাহেবদের নিয়ে বেশি বেশি বললাম।
নিউ মার্কেটের একদম মাঝখানে জেলে সমিতির অফিস। সেখানে বসা লোকজনদের ঠিক চিনি না। উনারা বসতে বললেন। পরিচয় দিলাম। বললাম, চা কিন্তু খাবো না। এমনিতে ঘুরতে আসলাম। তাদের একজন বললো, তা ভাই আছেন কয়দিন? বললাম, অনেক দিন থাকবো। শুরুর প্রশ্নেই বুঝতে পারলাম, তারা আমার চর ছাড়ার দিন তারিখ জানতে চায়। বললাম, কয়েকটা ডাকাত দল নামছে। তাদের সাথে আপনাদের সম্পর্ক নিয়ে একটু অনুসন্ধান করছি। নড়েচড়ে বসলো সবাই।
আমার প্রশ্ন শুনে রুহুল আমিন বের হয়ে গেলো। ভয় পেয়েছে সে। সামনে বসা জেলে সমিতির লোকজন। বড় বাহিনীর খোঁজ খবর নিতে হবে। চরের লোকজন এসব খবর রাখে।
গল্পে গল্পে কথা বের করতে হবে। এরা সবাই মহাজনের লোকজন। মানে এমনি এমনি আমাকে তারা সঠিক তথ্য দিবে না। তবুও কথা শুরু করলাম। ওরা বেশ আড়ষ্ঠ। কারণ আগের রাতে চরে নেমেই আমি সাহেবদের অত্যাচার নিয়ে কথা বলছি। সাহেবদের নিষেধ স্বত্বেও সাইফুলের কম্পিউটারের দোকান খুলেছি। সারাদিন দোকান খোলা ছিলো। তারা চেষ্টা করেও দোকান আবার বন্ধ করাতে পারেনি।
বন বিভাগের লোকজনও তাদের হয়ে দোকান বন্ধ করতে যায়নি। ঘটনাটি বেশ আলোড়ন তুলেছে। সমিতির লোকজনকে বললাম, ওই সাইফুলের কাছ থেকে সমিতির চাঁদা নিছিলেন? ওরা বললো, দিছে। বললাম, সে কি নিয়ম মেনে আসছে এখানে? একজন বললো, নিয়ম ঠিক আছে। কিন্তু তার কাজ কারবার ঠিক নাই। বললাম, বেআইনী কিছু পেয়েছেন? ওরা চুপ করে গেলো।
এখানে কেউ অসুস্থ্য হলে বা মারা গেলে এলাকায় যাওয়ার ব্যবস্থা কি? ওরা বললো, আমরা একটা লিখিত দেই। সেটা নিয়ে চলে যায়। জানতে চাইলাম, এখান থেকে কাউকে নিয়ে যাওয়া তো বেশ ব্যয়বহুল। খরচ কে দেয়? সমিতি দেয় না? সমিতির লোকজন কোনো উত্তর দেয় না। বললাম, আপনারা নিজেরাও জেলে। অথচ জেলেদের ভালো মন্দ দেখেন না। সাহেবরা যা বলে তাই করেন। বলেই উঠে পড়লাম।
যাবো খালের পাড়ে। ট্রলারে ফিরবো। রাতে সেখানে রান্না হবে। থাকবোও ট্রলারে। জোয়ার হয়ে গেছে। সর্দার আগেই চলে গেছেন। আমার সাথে রুহুল আমিন। নিউ মার্কেটের ভেতর দিয়ে হাঁটছিলাম। এমন সময় একজন বললো, মংলার এক সাহেব চরে আছেন। তিনি আমাকে খুঁজছেন। বললাম, সময় পেলে দেখা হবে। এখন খুব ক্লান্ত। ট্রলারে যাবো। উনি বললেন, ট্রলারে কেন থাকবেন? সাহেবের ঘর আছে না? বললাম, আমি কোনো সাহেবের ঘরে উঠি না ভাই। তবে চা খেতে আসবো। বলে বিদায় নিলাম।
মরণ চর প্রায় ডুবে গেছে জোয়ারের পানিতে। বেলায়েত সর্দারের ট্রলার ভিড়েছে একদম কিনারে। ট্রলার ঘিরে অনেক মানুষ। গিয়ে দেখি সব পরিচিত মানুষ। শ্যামনগর, আশাশুনি, রামপাল আর মংলার লোকজন সব। আমাকে দেখে এগিয়ে আসলো। ধরে ট্রলারে উঠালো।
বেলায়েত সর্দার মহা ব্যস্ত। রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দেখি বিরাট আয়োজন। মানুষ বেশি। সর্দার বললেন, গড়ে খিচুরি হবে ভাই। বললাম, সে আবার কী? পাশ থেকে ছেলেটি বললো, কুড়ি জনের রান্না হচ্ছে। ট্রলারের নতুন সহযোগির নাম খাইরুল। সর্দারের কেমন জানি ভাগনে হয়। তাই আমাকেও মামা বলেই ডাকে।
রাতটা ভালোই কাটবে। সুন্দরবনের মানুষদের গল্প শুনতে ভালো লাগে। বাঘ আর ভুতের গল্পগুলো বেশি ভালো লাগে। তবে সব গল্পের ভিতর দিয়ে উঁকি দেয় বনদস্যুদের গল্প। আজ যেমন সব গল্পই এসে ভিড়ছে বনদস্যুতে। চরের কয়েক জন জেলে এখন আলিফ ডাকাতের আস্তানায়। জাহাঙ্গীরের ভয়ে কেউ পশুর, শিবসা আর আড়পাঙ্গাসিয়ায় মাছ ধরতে যাচ্ছে না। এক জেলে বললো, এর মধ্যে ওহিদুল বড় ভাই কোত্থেকে আসলো বুঝতে পারলাম না।
ওহিদুলের আবার বাহিনী নিয়ে জঙ্গলে ফিরে আসা কাকতালীয় নয়। যদি এসে থাকে তবে তার ছোট ভাই সেই রাজুই পাঠিয়েছে। তার মানে এখনও তার অস্ত্রশস্ত্র কিছু আছে সুন্দরবনে?
২০১২ সালের দিকে এক অভিযানে তাড়া খেয়ে উঠে যায় রাজু। তারপর শহীদুল, ইলিয়াস, নোয়া মিয়ার নেতৃত্বে চলে তার দল। সেই সময়ের দস্যুতার রোজগারের বড় অংশ রাজুর পকেটে যেতো। তারপর মাস্টার বিদ্রোহ করে সেই দস্যুদল দখলে নেয়। নোয়া মিয়া পালিয়ে যায়। এরপর মাস্টার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলো। তাদের অস্ত্রগুলোর মালিক ছিলো রাজু। তখনও বনের ভেতর বিভিন্ন জায়গায় তার বেশ কিছু অস্ত্র লুকানো ছিলো।
মাস্টার সারেন্ডারের পর আবারও নোয়া মিয়াকে ডাকাতি করতে নামায় রাজু। এ মাসে তারাও সারেন্ডার করলো। তার পর এক সপ্তাহ যায়নি। তার আগেই রাজু তার আপন বড় ভাই ওহিদুল মোল্লাকে পাঠায়। দস্যু জগতে তাকে বড় ভাই বলে ডাকে। জেলেরা বললো, বড় ভাই নেমেছে নিশ্চিত। তবে এখনও কোনো ফোন নাম্বার ব্যবহার করে না।
গল্পে গল্পে ঘণ্টা দুই কেটে গেলো। রান্না শেষ। সবাই মিলে খেয়ে নিলাম। তারপর চা হাতে বসলাম ডেক এর উপর। পুরনো এক জেলে এসে পাশে বসলেন। বললেন, নোয়া বাহিনী কি সারেন্ডার করলো? বললাম, গত ৭ জানুয়ারি তারা সারেন্ডার করেছে। বললেন, কয়জন করলো? বললাম, ১২ জন। তবে দলের সবাই সেদিন সারেন্ডার করেনি। লোকটি বললো, তাই তো বলি! আমার এক শালা ছিলো ওই দলে। কিন্তু শুনলাম সে আত্মসমর্পণ করেনি। বললাম, ওরা জঙ্গলেই থাকবে। দেখবেন ওই ওহিদুল বড় মিয়ার দলে ভিড়ে গেছে তারা।
এর মধ্যে একটি দ্রুতগামী ট্রলার এসে ভিড়লো আমাদের পাশে। বড়সড় ট্রলার। ফোর স্ট্রোক কেন্টার ইঞ্জিন। ভিড়ার সময় আমাদের ট্রলারে ধাক্বা দিলো। সাথে সাথে মুখ ছুটলো বেলায়েত সর্দারের। বললেন, এই তোমরা চোখ কী পকেটে নিয়ে ট্রলার চালাও? কার ট্রলার? কীসের ট্রলার?
ওদিক থেকে একজন বললো, আমি মুকিত! সর্দার বললেন, তাই তো বলি! তো সুকানি কি আপনার হাতে ছিলো মুকিত ভাই? তাহলে তো ট্রলার ভালোই চালাইছেন। অন্য কেউ হলে তো উঠায়ে দিতো! বলেই হাসতে হাসতে শেষ!
কোন মুকিত? রামপালের মুকিত ভাই? ওই ট্রলার থেকে উত্তর এলো, আমি সেই মুকিত! চিনতে পারলেন? বললাম, কাঁকড়া ব্যবসায়ী? বললেন, জ্বি ভাই। কিন্তু ব্যবসা তো করতে দিচ্ছে না। ফরেস্টাররা খুব ঝামেলা করছে, কোস্টগার্ডেও ঝামেলা করে। বললাম, কাঁকড়া এই ট্রলারে পরিবহন করেন। এভাবে কাঁকড়া পরিবহন তো নিষেধ! মুকিত ভাই বললেন, নিষেধ জানি। কিন্তু আমি একজন অন্ধ মানুষ! সে হিসাবে একটু সুযোগ পাবো না?
মুকিত নামটি সুন্দরবনে বেশ পরিচিত। এক সময় ডাকাতি করতেন। তারপর একবার ধরা পড়েন। গণপিটুনি দিয়ে তার দুটি চোখ তুলে নেয় লোকজন। অত্যাচারের কারণে বেশ ক্ষোভ ছিলো তার উপর। সে দফায় বেঁচে গেলেও চোখ দুটো আর ফিরেনি। সুস্থ্য হয়ে কয়েক বছর পর আবারও বনে ফিরেছেন তিনি। কেউ তাকে বলে মুকিত ডাকাত। কেউ বলে কানা মুকিত। আমি অবশ্য মুকিত ভাই বলে ডাকি।
সাবেক এই দস্যু অন্ধকারে চলাফেরা করতে পারে। কিছু না দেখলেও ধারণা করে বলে দিতে পারেন সুন্দরবনের কোথায় আছে সে। জোয়ার-ভাটা আর বাতাসের গতি প্রকৃতিও বুঝতে পারে সে।
কাঁকড়ার ব্যবসায়ীদের সাথে বনদস্যুদের যোগাযোগ খুব ভালো। বিশেষ করে যারা ট্রলারে কাঁকড়া টানে তাদের সাথে সম্পর্ক বেশ নিবিড়। অবৈধ হওয়ায় বনদস্যুরা তাদের প্রোটেকশন দেয়। সেজন্য ব্যবসায়ীরা দেয় বড় অংকের চাঁদা। সব মিলিয়ে ডাকাত ও প্রশাসনের সাথে ভালো সম্পর্ক না থাকলে কাঁকড়ার ব্যবসা হয় না এই জঙ্গলে।
উঠে পাশের ট্রলারে গেলাম। মুকিত ভাইয়ের পাশে বসলাম। কানে কানে জিজ্ঞেস করলাম, বড় ভাই নাকী আবার ডাকাতি করতে নামলো? উনি বললেন, পশুর নদীতে একটা পার্টি তাড়া করলো। আমাদের যাওয়ার কথা ওই হংসরাজ নদীতে। সেখানে ঢুকতেই সিগন্যাল দিলো ডাকাতের দল। তাড়া খেয়ে এখানে আসলাম। ওটাই মনে হয় ওহিদুলের বাহিনী।
গল্প শেষ করে ট্রলারে ফিরলাম। বেশ শীত পড়েছে। রাতও হয়েছে। সর্দারকে বললাম, ভাটা হওয়ার আগে বড় নদীতে গিয়ে নোঙ্গর করবেন। ভোরের জোয়ার ধরবো। কাল দিনের আলোয় মংলা ফিরবো। নিচে আপাতত কাজ নাই। চরের সাহেবদের যে বার্তা দেওয়ার দিয়েছি। এখন ডাকাত দল সারেন্ডার করাতে হবে।
ট্রলার ছাড়লাম। আলোর কোল থেকে রওনা হলাম। পশুর দিয়ে এখন চলাফেরা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। রাতের বেলা ডাকাত পড়তে পারে। আমরা রূপের গাঙ এর ভাড়ানী দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ওদিক দিয়ে রূপের গাঙ খালে উঠলাম। তারপর এক টানে পৌঁছালাম লইট্যাখালী খালে। শেষ ভাটা পর্যন্ত এখানেই থাকবো। প্রথম জোয়ারে রওনা হবো মংলার উদ্দেশ্যে।
(জানুয়ারি ২০১৭, সুন্দরবন)
(ছবি: বড় ভাই বাহিনী, সৃন্দরবন ২০১৭)