গডফাদাররা সফল হলো? | রূপান্তরের গল্প ৩৬৯ | Rupantorer Golpo 369 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৬৯ : বলছিলাম না? বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের নাটক চলছে? খুলনায় বসে এক মহাজন বলছিলেন এসব কথা। মাছের ব্যবসায় নাকী ধ্বস নেমেছে। ডাকাতি বেড়েছে সুন্দরবনে। সারেন্ডার কোনো কাজেই আসলো না। তাহলে এখন কী করতে হবে? সারেন্ডার বন্ধ করতে হবে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা আবেদন করবো। সেখানে শহরের কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ী উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে তাঁদের একজন ফোন দিলেন। বড় মহাজনের সাথে তার বৈরী সম্পর্ক।
একটা সময় বেশ সহজ ভাবে দেখতাম সবকিছু। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে চিন্তা ভাবনায় আর সরল থাকতে পারলাম না। বনদস্যুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কখনও নিজেকে তাদের কাতারে নামাতে হচ্ছে। খুঁজে বের করতে হচ্ছে দস্যুদের গডফাদারদের মধ্যে কার সাথে কার বিরোধ। কুটিল মানুষদের সাথে জটিল চাল দিতে গিয়ে যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলছি। বনদস্যুদের এখনকার বাড়-বাড়ন্ত পরিস্থিতি সত্যিই ভাবনার বিষয়। জানি না আর কতোদিন এভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবো।
টিকে থাকতে হবে। সম্মান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে না পারলে আমাকেই বড় বিপদে পড়তে হবে। আমি বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।
ঢাকা ফিরেছি একদিন হলো। অফিসের কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করছি। আর নিয়মিত কথা বলছি আলিফ বাহিনীর সাথে। এর মধ্যে বেলায়েত সর্দার ফোন দিলেন। বললেন, আলিফকে মুক্তিপণ দিয়ে দুবলার চরের জেলেরা ফেরত এসেছে। শুধু গফুর গাজীর দুই ভাই এখনও ফিরতে পারেনি। ছয় লাখ টাকা জোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছে তারা। দেখেন কিছু করতে পারেন কী না!
অদ্ভুত এক জটিলতা। বুঝতে পারছি না কী করবো। তারপরও সম্পর্কের খাতিরে ফোন দিলাম। আলিফ ডাকাতকে বললাম, অপহৃত দুইজনকে ছেড়ে দাও। দস্যুনেতা বললো, ছেড়ে দিবো।
দুই দিন পর ওই জেলেদের ছেড়ে দেওয়ার খবর পেলাম। ফোন করে কৃতজ্ঞতা জানালেন গফুর গাজী। আলিফকে ধন্যবাদ দিলাম। বললাম, সামনে আর একটা অঘটনও যেন না ঘটে। তুমি তৈরি হও। সে বললো, আমাকে কেন এতো চাপ দিচ্ছেন বাপজান! আরও বাহিনী আছে। তাদের সারেন্ডার করাতে পারছেন না? বললাম, শোনো আলিফ।
তুমি কখন কোথায় থাকো সে খবর আমি জানি। প্রশাসন খুঁজে পায় না বলে যে আমিও তোমাদের খুঁজে পাবো না তা কিন্তু না। এখন পর্যন্ত তোমাদের ধরিয়ে দেইনি মানে যে সামনে ধরাবো না তা ভেবো না। আমার একটাই কথা, হয় সারেন্ডার করবে না হয় ধরা পড়বে। যদি সারেন্ডার না করো তবে তোমাকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমি নিবো না।
আলিফ হেসে দিলো। বললো, আমরা কোথায় আছি বলতে পারবেন? বললাম, তুমি আছো মামদো নদীর শব্দে-গুব্দে খালে। আর কিছু জানতে চাও? আঁৎকে উঠলো দস্যুনেতা। বললো, আপনি কি মোবাইল ফোন ট্র্যাক করছেন বাপজান? বললাম, তোমাদের খোঁজ খবর রাখতে আমার নিজস্ব ব্যবস্থা আছে।
এদিকে যে দুইজন মাঝি আলিফের ডেরা থেকে ফেরৎ এসেছে তাদের ঘিরে রেখেছো RAB এর এক সোর্স। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তথ্য বের করার চেষ্টা করছে সে। এই ঘটনায় সন্দেহ হলো। সর্দারকে বললাম, একটু খোঁজ নেন তো।
দুই মাঝিকে নাকী মুক্তিপণ দিতে হয়েছে। জনপ্রতি তিন লাখ না, এক লাখ করে টাকা দিতে হয়েছে। শুনে আমার মাথা খারাপ অবস্থা! বলার পরও আলিফ টাকা নিলো? অবশ্য জেলেরা তাতেই খুশি। তিন লাখের জায়গায় এক লাখ দাবি করেছে আলিফ। তাও নগদ দিতে হয়নি।
ফোন দিলাম দুবলার চরের গফুর গাজীকে। বললাম, আপনি তো বলেননি যে এক লাখ করে দুই লাখ টাকা দিয়েছেন আলিফকে। উনি বললেন, ছয় লাখের জায়গায় চার লাখই ওরা মাফ করে দিছে কাকা। ভাবলাম আর আপনাকে না জ্বালাই। বললাম, বিস্তারিত বলেন। আমার জানা প্রয়োজন।
ফোন দেওয়ার পর আলিফ নিজেই তাদের ফোন দিয়েছে। তারপর ক্ষেপেছে এই বলে যে আমাকে কেন জড়ানো হলো! তারপর বলেছে, জনপ্রতি এক লাখ টাকা লাগবেই। কারণ তার অনেক টাকা দেনা। আমার কথা চিন্তা করে বাকীতেই জেলেদের ছেড়ে দিয়েছে। তবে টাকার বিষয়টি আমাকে বলতে না করেছে।
গফুর কাকা বললেন, আলিফকে দুই লাখ টাকা পাঠালাম। বিকাশে টাকা নিলো। তবে বিকাশ খরচটা মাফ করলো না। তারপরও আমরা খুশি। বললাম, আপনি খুশি হলেও আমি খুশি হতে পারলাম না। উনি আমাকে চুপ থাকতে অনুরোধ করলেন।
আমি চুপ থাকলেও এই লেনদেনের বিষয়টি অনেক জটিল হয়ে গেলো। আলিফ তার দলের সদস্যদের বলেছে আমার অনুরোধে বিনা টাকায় জেলেদের ছেড়েছে সে। কিন্তু দুই লাখ টাকা নেওয়ার বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। দস্যু দলটির মধ্যে এনিয়ে ঝামেলা শুরু হলো। টাকার হিসাব নিয়ে প্রশ্ন উঠলো। আলিফ পুরো বিষয়টি আমার ঘাড়ে তুলে দিলো।
এমন খবরের অপেক্ষায় অনেকে। মোহসীন উল হাকিম তাহলে ডাকাতদের কাছ থেকে টাকা নেয়! সব জায়গায় ছড়িয়ে গেছে, ওই দুই লাখ আমার কাছে। সেজন্যই গোয়েন্দা আর সোর্সরা দৌড়াদৌড়ি করছে। আমি টাকা নিয়েছি তা নিশ্চিত হতে চাইছে। সবকিছুই চলছে আমার জানার বাইরে।
এদিকে সুন্দরবনের আরেক দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর এখন বেশ মজবুত অবস্থানে। যোগ দিয়েছে পুরনো দস্যুরা। মোটামুটি কুড়ি জনের দল নিয়ে মহা দাপটে দস্যুতা করছে। ওদের ভয়ে বড় ভাই বাহিনী জড়োসড়ো। তারাও লোকবল বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এর মধ্যে রামপালের রফিক, ওলিসহ কয়েকজন যোগ দিবে দিবে করছে।
জাহাঙ্গীরের শক্তিমত্তা নিয়ে আলোচনা চলছে বিভিন্ন মহলে। বলে বেড়াচ্ছে, প্রশাসনের লোকজনদের সাথে তার সম্পর্কের কথা। এদিকে খুলনা RAB এ সারেন্ডার করবে এমন খবর ঘুরছে চারদিকে। বরিশাল RAB থেকে বলা হচ্ছে তারাও নাকী এই দলটিকে সারেন্ডার করাতে কাজ করছে। আমি অবশ্য এর কিছুই জানি না। কারণ জাহাঙ্গীর আমাকে অপছন্দ করে।
RAB এর গোয়েন্দা প্রধানের সাথে কথা বললাম। জানালাম, আলিফ বাহিনীর সাথে আমার দেখা হবে শিগগিরি। উনি বললেন, আলিফ নিয়ে ঝামেলা আছে। আপনি জাহাঙ্গীরের সাথে কথা বলেন। খটকা লাগলো।
আলিফের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ঢুকেছে আমার পকেটে। সেই খবর গোয়েন্দা প্রধানের কাছেও এসেছে। কিন্তু ঘটনা যে সত্য নয় তিনি তা জানেন। লেনদেনের তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। বললেন, আপনাকে নিয়ে একটু চাপে আছি। তবে দুশ্চিন্তা করবেন না।
মনটা খারাপ। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দস্যুদের পৃষ্ঠপোষকরা তাহলে সফল হলো? সারেন্ডারের প্রক্রিয়া থেকে আমাকে সরানোর চেষ্টা সফল হলো? ভাবছি, কাজটি এবার ছেড়েই দিবো। কিন্তু এ অবস্থায় ছেড়ে দিলে অপবাদটি খন্ডানো হবে না। এতো বড় অসম্মান মাথায় নিয়ে চলে যাওয়া উচিৎ হবে? এনিয়ে কারও সাথে কথাও বলতে পারছি না। কী করবো বুঝতেও পারছি না।
দুই দিনের ছুটি নিলাম। বন্ধ রাখলাম ফোন। তবে গোপন একটি নাম্বার চালু রাখলাম। সেই ফোন দিয়ে কথা চলছে আলিফের সাথে। মাথায় জিদ চেপেছে। তীব্র চাপ দিলাম। এক পর্যায়ে রাজি হলো সে।
এক শর্তে দেখা হবে আলিফের সাথে। কোনো ছবি তোলা যাবে না। সে কোনো সাক্ষাতকারও দিবে না। বললাম, তোমার শর্তে রাজি। এখন দিন তারিখ ঠিক করো।
জানুয়ারির ২৫ তারিখে দেখা হবে। আমরা রওনা দিবো ২৪ তারিখ। কী ভাবে যাবো, কোথায় দেখা হবে এসব নিয়ে পরে কথা হবে। অফিসে জানিয়ে রাখলাম। ভিডিওগ্রাফার পলিনকে জানালাম। সাতক্ষীরার সহকর্মী আহসান রাজীবকে ফোন দিলাম। বললাম, খুব গোপন একটি সফর আছে সামনে। তৈরি থাকবেন।
এবারের সফরটি কেমন হবে জানি না। শুধু জানি, পশ্চিম সুন্দরবনের কোনো এক খালে দেখা হবে তার সাথে। আলিফ বাহিনীকে সারেন্ডার করাতেই হবে। তবে সবকিছুই থাকবে গোপন। আপাতত আমি আর এই দস্যুনেতা ছাড়া কেউ কিছু জানে না। জানতে দিবোও না।
(জানুয়ারি ২০১৭, সুন্দরবন)