নৌকা ভাসলো মামদো নদীতে | রূপান্তরের গল্প ৩৭১ | Rupantorer Golpo 371 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৭১ : ভারী কুয়াশার মধ্যে চলছে গাড়ি। ছোট সড়ক। দুই পাশে মাছের ঘের। একটু এদিক সেদিক হলেই গাড়ি পড়বে খাদে। কী যন্ত্রণায় যে পড়লাম। ওদিকে জামু ভাইয়ের ফোন বন্ধ। আলিফের ফোনে চেষ্টা করছি, কোনো সাড়া নাই।
রাত দশটা হবে। প্রথম গিয়ারে চলছে গাড়ি। রাস্তা এদিকে এতো সরু! সামনে থেকে আরেকটি গাড়ি আসলে কী যে হবে! কপাল ভালো। এদিকের লোকজন মনে হয় আগেই ঘুমিয়ে যায়। গাড়ির সামনে বসা আমি। চোখ সামনের দিকে। দুই পাশে তাকিয়ে রাস্তা মাপছি আর আগাচ্ছি।
বংশীপুর থেকে এই রাস্তায় ঢুকেছি আধা ঘণ্টার বেশি হলো। এদিক দিয়ে আগেও চলাফেরা করেছি। গেছি সীমান্ত ঘেঁষা কৈখালীতে। একবার ওদিক দিয়ে ট্রলারে করে সুন্দরবন গেছিলা। সীমান্ত নদী ধরে কাচিকাটায় রাত কাটিয়েছি। উত্তর তালপট্টি পর্যন্ত ঘুরে আবার ফিরেছি। সমুদ্র সীমা নিষ্পত্তির পর দেখতে গিয়েছিলাম আসলে দক্ষিণ তালপট্টি আছে কী না তা দেখতে।
সেবার মটরসাইকেলে গেছিলাম। এবারের গন্তব্য অবশ্য তারও আগে, কালিঞ্চি। কিন্তু নিজে নিজে পথ চিনে যেতে পারবো না। তার উপর গাড়ি নিয়ে যেতে হিমসিম খাচ্ছি। আধা ঘণ্টার পথকেই অনেক লম্বা মনে হচ্ছে। দুশ্চিন্তার আরেকটি কারণ জামু ভাইকে ফোনে না পাওয়া। আরেকটি সমস্যা হলো, যতো এগুচ্ছি ততোই ফোনের নেটওয়ার্ক কমছে। কমারই কথা। সামনেই ভারত সীমান্ত।
মিনিট দশ পর একটি সেতু পড়লো। রাস্তা থেকে একটু উঁচু। জামু ভাই একটি ব্রিজ পর্যন্ত আসতে বলেছিলেন। সম্ভবত এটাই সেই ব্রিজ। কারণ এখানেই গাড়ির রাস্তা মনে হচ্ছে শেষ। গাড়ি থামালাম। বলা যায় থামতে হলো।
ফোনটা হাতে নিয়ে নামলাম। তীব্র শীত। কুয়াশার মধ্যে হাল্কা বাতাস দিচ্ছে। একদম হীম শীতল। হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এমনিতে শীত মোকাবেলার অভ্যাস আছে। তবে আজ বেশ কষ্ট হচ্ছে। কারণ ক্ষুধা লেগেছে। সহকর্মী পলিন গাড়ির ভেতর ঘুমাচ্ছেন। পরিস্থিতি যতো জটিলই হোক, তার ঘুমের কোনো সমস্যা হয় না। একবার ভাবলাম ডেকে তুলি। আবার ভাবলাম, থাক। দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে লাভ নাই, নিজের মধ্যেই থাকুক।
ব্রিজের রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছি। মনে হয় নতুন হয়েছে। নিচ দিয়ে বয়ে গেছে একটি মাঝারি খাল। নদীও হতে পারে। পুরো জোয়ার চলছে। তীব্র স্রোত। সেই স্রোতের সাথে চলছে একটার পর একটা ডিঙ্গি নৌকা। কুয়াশায় সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। তবে নৌকা বাওয়ার শব্দ আর জেলেদের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছি।
রাত প্রায় এগারোটা। দূর থেকে মটরসাইকেলের শব্দ আসছে। ঘন ঘন হর্ন বাজাচ্ছে চালক। কয়েক মিনিট পর কাছাকাছি এসে থামলো তারা। ভাবছি আমার কাছে জামু আসবেন তো?
ওদিকে টর্চ হাতে কেউ একজন হেঁটে আসছে। ঘন ঘন আলো জ্বলছে আর নিভছে। টর্চের লক্ষ্য আমাদের দিকে। আশায় বুক বাঁধলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে লুঙ্গি পড়া একজন এসে দাঁড়ালেন। গাড়িতে আলো ফেলে নিশ্চিত হলেন। তারপর বললেন, মোহসীন ভাই? বললাম, জামু ভাই নাকী? বললেন, জ্বি ভাই। রাতের বেলা খুব কষ্ট হয়ে গেলো। খেয়া ঘাটে নৌকা ছিলো না। তারপর মটর সাইকেল জোগাড় করতেও দেরি হলো। এই রাতে কে দিবে গাড়ি?
বললাম,আমাকে একটু জানাবেন তো? অচেনা জায়গায় দাঁড়ানো সেই কতোক্ষণ ধরে। দেখলে কে কী মনে করবে সেটাও ভাবছিলাম। সীমান্ত এলাকায় রাতের বেলা যারা চলাফেরা করা তারা সবাই সবাইকে সন্দেহ করে। অন্ধকারে একটা অঘটনও ঘটে যেতে পারে না? জামু বললেন, এদিকে নেটওয়ার্ক থাকেই না। তার উপর খেয়া পার হতে গিয়ে ফোনটা পানিতে পড়ে গেলো। আমি কি আর বসে আছি ভাই। আপনার সাথে কথা বলার পর পরই রওনা দিলাম। যাই হোক, চলেন। লোকটির মুখ ঢাকা মাফলার দিয়ে। চেহারাটা দেখতে পারলাম না।
একটা মাত্র মটরসাইকেল। মানুষ আমরা তিনজন। তাতেও অসুবিধা ছিলো না। আমাদের ব্যাগ বোঁচকা নিবো কী করে? অবশেষে শুধু শীতের কাপড়, মোবাইল ফোন আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ নিয়ে তৈরি হলাম। গাড়ি ঘুরিয়ে দিলাম। চালককে বললাম, সাতক্ষীরা শহরে গিয়ে থাকবে। আমি ফোন দিলে চলে আসবে এখানে।
শুনেছি যাত্রীবাহী মটরসাইকেলকে এদিকে হেলিকপ্টার বলে। এর উৎপত্তি অবশ্য সাইকেল থেকে। এই অঞ্চলে সাইকেলের ক্যারিয়ারের সাথে কাঠের তক্তা বেঁধে আরেক জনের বসার ব্যবস্থা করা হতো। সেজন্যই ওই দুই চাকার বাহনকে মজা করে হেলিকপ্টার বলা হতো। এখন তার জায়গায় নেমেছে ভাড়ায় চালিত মটরসাইকেল।
সামনে জামু ভাই। তিনিই চালাচ্ছেন। মাঝে আমি, আমার পেছেন পলিন। অন্ধকার ফুঁড়ে চলছে মটরসাইকেল। কোনো রকমে বসেছি। বেশ কষ্ট হচ্ছে। কারণ পাকা রাস্তা থেকে আমরা নেমে পড়েছি ইটের রাস্তায়। মাছের ঘেরের মাঝখানের সরু পথ।
কিছু দূর গিয়ে মটরসাইকেল থেমে গেলো। নামলাম আমরা। বললাম, ভালো রাস্তা নাই ভাই? মটরসাইকেলে কিক দিতে দিতে বললেন, সোজা রাস্তায় গেলে মানুষ দেখে ফেলবে না? আমরা যে কাজে যাচ্ছি বুঝতে পারেন? বললাম, তা বুঝি। কিন্তু কষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে!
এর মধ্যে মটরসাইকেলের ইঞ্জিন চালু হলো। উঠে বসলাম আবার। তারপর আরও মিনিট কুড়ি চললাম। থামলাম একটি খেয়া ঘাটে। জায়গার নাম কালিঞ্চি। নৌকা ঘাটেই বাঁধা। মটরসাইকেল ঘাটে রেখেই উঠে পড়লাম। উল্টো পাশের লোকালয়ের নাম গোলাখালী। সুন্দরবনের ভেতরে বাংলাদেশের একমাত্র বসতি এটি। দুই দিকে নদী। বাকী দুই পাশে সুন্দরবন। গোলাখালীর সাথে সুন্দরবন একদম লাগানো। মাঝে মাঝেই বাঘ আসে।
জঙ্গলের পাশ দিয়ে হাঁটছি আমরা। ভেড়ি বাঁধে মাটি কাটা হয়েছে ইদানিং। বাম পাশে জঙ্গল, ডানপাশে মাছের ঘের। হাঁটতে হাঁটতে এক কোণায় পৌঁছালাম। সেখানে ভাসমান একটি ঘর আছে। ভেতরে জ্বলছে কুপি বাতি।
নাম ধরে ডাক দিলেন জামু ভাই। সাথে সাথেই সাড়া এলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলেন এক বৃদ্ধ। সাথে ছোট্ট একটি ছেলে, বয়স হবে বড়জোর আট বছর। জামু বললেন, মেহমান আসছে। একটু নামো। দেখো কয়টা চিংড়ি মাছ পাও কী না। বললাম, শীতের রাতে কষ্ট করায়েন না ভাই। আমরা ডাল ভাত খাবো। আর কিছু লাগবে না।
উনি বললেন, আপনি আমাদের সাহেবের মেহমান। ভালো মন্দ না খাওয়ালে হবে? বলেই নেমে পড়লেন ঘেরে। সাথে যোগ দিলেন প্রবীন ব্যক্তি ও তাঁর নাতি। কয়েক মিনিটের চেষ্টা ধরা হলো কেজি পাঁচেক চিংড়ি মাছ, হরিণা চিংড়ি। সাথে বেশ কয়েকটি কাঁকড়া।
মাছ-কাঁকড়া নিয়ে আবার দশ মিনিট হাঁটলাম। চারপাশে ঘের দিয়ে ঘেরা একটি বাড়িতে ঢুকলাম। এই রাতেও সেখানে ব্যস্ততার শেষ নাই। ভাবী বাচ্চারা রান্নাঘরে কাজ করছে। এর মধ্যে দেশি মুবগির ঝোল হয়েছে। ঘেরের পারশে মাছ ভাজা চলছে। একটু আগে ধরা চিংড়িও রান্না হবে। কাঁকড়াগুলো কাটতে না করলাম।
রান্না শেষ হতে হতে রাত বারোটা বাজলো। লদিকে ক্ষুধায় কাহিল আমরা। তবে সেকথা বলছি না। এমনিতেই ওদের ব্যস্ততার শেষ নাই। লোকালয়ের শেষ প্রান্তের এই ছোট্ট জনপদ গোলাখালীতে শ খানেক ঘর আছে। জেগে আছে শুধু এই ঘরের মানুষ।
বড় বড় পারশে মাছ, চিংড়ি ভুনা, দেশি মোরগের ঝোল আর গরম ভাত। সাথে পাতলা ডালও রেঁধেছেন জামু ভাইয়ের স্ত্রী। পলিনসহ বসে পড়লাম। ভরপেট খেয়ে সেখানেই ছেড়ে দিলাম শরীরটাকে। সেই সকালে রওনা দিয়েছি। একটানা প্রায় ষোল ঘণ্টা সফর করেছি আজ। ক্লান্তির কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় ছিলো না। এর মধ্যে চা হয়েছে। ডাকাডাকি করেও নাকী জাগানো যায়নি আমাকে।
রাত দুইটার দিকে ঘুম ভাঙলো। দেখি কম্বল, কাঁথা বালিশ নিয়ে তৈরি জামু ভাই। সাথে আরও দুইজন। বাজারের ব্যাগ-বোঁচকা আর কয়েকটি হাঁস-মুরগি নিয়ে দাঁড়ানো। চোখ ডলতে ডলতে উঠলাম। দেখি পলিন দাঁড়ানো। হাতে তার চায়ের কাপ। বললেন, আমরা মনে হয় রওনা দিবো ভাই। আপনি উঠেন। চোখমুখে একটু পানি দেন। তারপর চায়ে চুমুক দেন।
শীতে কাবু আমরা। ভেড়ি বাঁধের রাস্তা ধরে হাঁটছি। কষ্ট হচ্ছে। শরীরটাকে টেনে নিচ্ছি তবুও। কুয়াশা পড়ে মাটির পথটি বেশ পিচ্ছিল। পা ফেলতে হচ্ছে সতর্কতার সাথে। অবশ্য পলিন এক হাতে আমাকে ধরে আছেন। আরেক হাতে টর্চ। পা টিপে টিপে হাঁটছি। কোন পর্যন্ত যাবো জানি না।
কতোক্ষণ হাঁটবো আমরা? জামু ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, এই তো ভাই। বেশিক্ষণ না। অর্ধেক ভাটায় নদীতে চর জেগে গেছে। নৌকা এই ঘাট পর্যন্ত আনতে পারেনি ওরা।
হাঁটছি আর ভাবছি মংলা দিয়ে কাজটা কতো সহজ। ট্রলার তৈরি থাকে। বেলায়েত সর্দার বাজার সদা করে তৈরি থাকেন। আমি শুধু গাড়ি থেকে নেমে উঠে পড়ি। আজকেও সুন্দরবনে যাচ্ছি। একটি দস্যুদলের কাছে যাচ্ছি। কিন্তু এবারের পথটি একেবারেই অন্য রকম। একই সাথে ভাবছি, এখানে যদি অপরাধীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় তবুও তাদের সম্ভব না। সুন্দরবনের ভেতর থেকে অপরাধী ধরা তো আরও দূরের কথা। এদিকে অভিযান চালানো সম্ভব। কিন্তু ততোক্ষণে অপরাধীদের টিকিটিও ছুঁতে পারবে না কেউ। এদিকের বনদস্যু ও চোরাকারবারীরা এই সুযোগটিই নেয়।
একটি ডিঙ্গি নৌকা ভিড়ানো নদীর পাড়ে। যতোটা সম্ভব কাছাকাছি আনা। আমরা উঠার আগে নৌকার মাঝিরা উঠলো। জিনিষপত্রগুলো রাখলো নৌকায় পাটাতনের তলায়। ভালো করে সেঁচে জমা হওয়া পানি ফেললো। তারপর ছইয়ে ভেতরে পাতা হলো মোটা কম্বল। আরেকটি ভারী কম্বল গায়ে দিবো। বালিশগুলো জামু সাহেবের বাসা থেকে আনা, বেশ আরাম হবে।
নৌকায় উঠলাম। ছইয়ের ভেতরে ঢুকে বসলাম। শীতের মধ্যে বিষয়টি বেশ উপভোগ করার মতো। গোলপাতার ছইয়ের ভেতরটা বেশ ছোট। তবে আরামের যে ব্যবস্থা রাখা তা বলে বুঝানো যাবে না।
ঠেলে নামানো হলো নৌকা। পানিতে ভাসলাম। সামেন পেছনে দুইজন মাঝি। ছইয়ের ভেতরে আমি আর পলিন। আমাদের পেছনে বসেছেন জামু ভাই। লোকটি রহস্যময়। নাম শুনেছি তার। কিন্তু তার সাথে মিলাতে পারছি না একদম। আজ তিনিই আমার একমাত্র ভরসা। নিয়ে যাবেন আলিফ ডাকাতের কাছে।
নৌকা চলছে। কোনো বাতি জ্বালানো হয়নি। কুয়াশা ঘেরা নদীতে কিছুই দেখছি না। মনে মনে ভাবছি কোন জায়গায় আমরা। কিন্তু কিছুতেই মাথায় আসছে না। শেষ পর্যন্ত জামু ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, কোন নদীতে আমরা? বললেন, মাহমুদা নদী। এই নদীতে আগেও এসেছি। তবে এর সাথের খালগুলো ভালো চিনি না। বললাম, কতোক্ষণের পথ? উনি বললেন, তা কে কবে? ওরা কোথায় আছে এখন কে জানে? আমরা বাইতে থাকবো, ওরা সিগন্যাল দিয়ে ডেকে নিবে। বললাম, তাহলে নৌকা চলতে থাকুক। আমি একটু ঘুম দেই।
এমন সফরে আসলে আমার ঘুম আসে না। দুই তিন দিন ঘুমাইনি এমন সময়ও গেছে। তবে আজ ঘুম আসছে। কম্বল টেনে নিলাম। ওম আর ক্লান্তি মিলিয়ে বেশ লাগছে। চোখ বন্ধ করলাম। তবে যতোক্ষণ পারলাম কান খোলা রাখলাম। মাঝিরা একে অন্যের সাথে কথা বলছে। নিচু স্বরে বললেও বুঝতে পারছি।
ভাটার স্রোতের সাথে চলছি আমরা। নদীটির আনুষ্ঠানিক নাম এখন মাহমুদা। তবে এর মূল নাম মামদো। এখান থেকে সোজা নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে। কম্বল মুড়ি দিয়ে জেলেদের কথোপকথন শুনছি। পেছনের মাঝি জানতে চাইলো, দয়াল আছে কোন খালে? জামু ভাই বললেন, ওই শোব্দে-গুব্দের দিকে যাও।
(২৫ জানুয়ারি ২০১৭, সুন্দরবন)