আলিফের খাল ‘শোব্দে-গুব্দে’ | রূপান্তরের গল্প ৩৭২ | Rupantorer Golpo 372 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৭২ : ছপ ছপ ছপ ছপ… বৈঠা চলছে। লাও চলছে ভাটার স্রোতে, দক্ষিণে। এদিকে নৌকাকে বলে নাও, লাও বা লা। সাতক্ষীরার এদিকটার ভাষা একেবারেই অন্য রকম। শ্যামনগরের পূর্ব দিকে গাবুরা থেকে কৈখালী পর্যন্ত মানুষের ভাষা একটু অন্য রকম। প্রতিটি শব্দের শেষ অক্ষরটি হারিয়ে যায়। শুনতে ভারী মিষ্টি লাগে।
ঘন কুয়াশায় দুই পাশ দেখা যায় না। অবশ্য এই জেলেদের তা দেখার দরকারও নাই। সুন্দরবনের এদিকটা তারা চোখ বন্ধ করে দেখতে পায়। কুয়াশা বা অমাবশ্যার অন্ধকার কোনো সমস্যা না। হীম শীতল সুন্দরবনে মামদো নদী ধরে চলছি। কম্বল মোড়ানো বিছানায় শোয়া আমরা। নরম বালিশে মাথা রাখতেই নেমে আসলো ঘুম। আমি জেগে থাকার চেষ্টা করছি। মাথার মধ্যে ঘুরছে দুটি নাম- শোব্দে-গুব্দে। মনে মনে সেই খালগুলোর অবস্থান বুঝতে চাইছি। কিন্তু সবকিছুই ঝাপসা।
ছোট্ট নৌকার ছোট্ট ছই। তার মধ্যে দুজন মানুষ। স্বাচ্ছন্দে বসে থাকাই মুশকিল। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় সব জিনিষপত্র রাখা। জেলে নৌকায় যা থাকে তার সব কিছুই আছে। সুন্দরবনের নৌকাগুলোতে কিছু বাড়তি জিনিষ থাকে। অন্ধকারে দেখছি না কিছু। কিন্তু বুঝতে পারছি সব। এর মধ্যে পলিন দেখি উসখুস করছে। আমার সহকর্মী পলিন বেশ লম্বা। ছোট্ট ছইটিতে জায়গা হচ্ছে না তার। পা দুটো কম্বল থেকে বের হয়ে আছে। পা দুটো তার ঝুলছে নৌকার খোলের উপর। পানি জমলে এখান থেকেই ফেলানো হয়। বিপত্তিটা বাধলো তখনই।
একজন পানি ফেলতে আসছে। কিন্তু পলিনের পা দুটোর ঝামেলা করছে। পানি লাগছে তার পায়ে। হীম শীতল পানির ছোঁয়ায় সিউড়ে উঠছে সে। কিন্তু এক কম্বলের ভেতরে থাকায় নড়তেও পারছে না। একটু উঠে বসতে গেলেও কম্বল সরে যাবে। আমার ঘুম ভেঙে যাবে। এই চিন্তা করে চুপচাপ আমার এই সহকর্মী।
ইচ্ছা করছে না। তবুও উঠে বসলাম। পলিনের এই জটিল সমস্যার সমাধান করা যায় কী না দেখি।
মাথা থেকে কম্বল সরাতেই ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা খেলাম। মনে হচ্ছে ডিপ ফ্রিজ। তারপরও উঠে বসলাম। জামু ভাই ঘুরে তাকালেন। বললেন, ঘুমান ভাই। সময় হলে ডাক দিবো। বললাম, একটু নড়েচড়ে শুচ্ছি ভাই। পলিনের পা রাখার জায়গা পাচ্ছি না। সামনের জেলে বললেন, জঙ্গলে এরকম লম্বা লোক আনলে চলে? আনবেন ছোট খাটো মানুষ। মুহুর্তেই পরিবেশ বদলে গেলো। গম্ভীর, গা ছমছমে পরিবেশটা ভালো লাগছিলো না। পলিন বললো, সমস্যা নাই ভাই। আপনি ঘুমান। আমি না হয় সকালে ঘুমাবো।
আমাদের পৌঁছাতে আর কতোক্ষণ লাগবে ভাই? জামু ভাই বললেন, শেষ ভাটির মধ্যেই পেয়ে যাবো মনে হচ্ছে। ও তো ভালো লোক না। খুব খামখেয়ালী। কখন কী করে বলা মুশকিল! বললাম, আজকেও খামখেয়ালী করবে মনে হয়? উনি বললেন, ওর নাটাই আমার হাতে। শয়তানি করে পার পাবে না। আপনি চিন্তা করবেন না, ঘুম দেন। সময় আসলে ডেকে দিবোনে।
গল্প করতে করতে চুলা জ্বললো। চা উঠলো। বিশ্রি রকমের কড়া লিকারের চা। শীত কাটাতে চুমুক দিলাম। তবে এই চা আমার পোষায় না। তবুও ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছি। আসলে এবারের যাত্রাটি বেশ অনিশ্চিত। এতো দুশ্চিন্তা নিতে পারছি না। আলিফ যদি দেখা না দেয় তবে সুন্দরবনে আমার কাজ সত্যি সত্যি থমকে যাবে।
এতো টেনশন নেওয়া যাবে না। পলিনকে বললাম, চলেন ভাই, শুয়ে পড়ে। বিছানাটা টেনেটুনে একটু লম্বা করার চেষ্টা করলাম। তারপর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।
নৌকার এক রকম ছন্দ আছে। সেটি দেশের অন্য অঞ্চলের নৌকার মতো না। জোয়ার, ভাটা, শ্রোত আর বাতাসের উপর নির্ভর করে নৌকা চলার ধরণ। বৈঠা চলে সেভাবেই। সামনে, পেছনে বসে মাঝি। তালে তালে পানিতে পড়ে বৈঠার বাড়ি। নদী বা খালের মোহনায় আসলে পানির গতি প্রকৃতি বদলে যায়। ঢেউ থাকলে এক রকম, স্রোত বেশি হলে নৌকা চলে আরেক রকম। জেলেরা বা মাঝিরা ছোটবেলা থেকেই অভ্যস্ত। তাই নৌকা চালানো তাদের কাছে ছেলে খেলা। স্রোতের বিপরীতে চলার সময় মাঝখানে বসে দাঁড় বায় তৃতীয় জন। কখনও কাঁথা দিয়ে বাদাম তোলে তারা। কতো কিছু দেখছি এই জঙ্গলে এসে!
প্রায় ঘণ্টা দুই হলো। ভাটা আছে আর ঘণ্টা খানেক। তার মানে এই মামদো নদী ধরে আমরা চলবো আর এক ঘণ্টা। মাঝে মাঝেই ঘুম ভাঙছে। পানির শব্দ শুনছি। মাঝিদের গল্প শুনছি। স্রোত আর বাতাসের সাথে সাথে যাচ্ছি বলে পানিতে ঢেউ নাই। নৌকা চলছে নিরিবিলি।
জামু ভাই মাঝে মাঝে হাঁক দিচ্ছেন। আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। গত কয়েক বছরে সুন্দরবনে এসেছি অসংখ্য বার। বনদস্যুদের সাথেও দেখা হয়েছে অনেক বার। কিন্তু এমন অনিশ্চিত সফর আর হয়নি। আধো ঘুমের মধ্যে নানা রকমের চিন্তা আসছে মাথায়।
এই দাঁড়াও। এখানে একটু স্লো করো! জামু ভাই বলছেন, বামের খালো ঢুকো! সামনের জন বললো, কোন খালে ঢুকবো? আগেরটায় না পরেরটায়! জামু বললেন, ট্রলারের ভাড়ানী আছে কোনটাতে? মাঝি বললেন, দুটোরই ভাড়ানী আছে। জামু ভাই বললেন, তাহলে এই নদীতেই রাখো। খালের মুখে নোঙ্গর করো। মাঝি বললেন, এখানে আবার ফরেস্ট এসে ধরবে না? জামু বললেন, ফরেস্টার কি আমরা কেয়ার করি? ঠেকাও নৌকা। সামনের ওই গেওয়া গাছের সাথে বাঁধো।
কোথায় আছি জানি না। তবে টানা তিন ঘণ্টা ভাটায় নৌকা চলেছে। সেই হিসাবে আমরা খুব বেশি দূরে আসিনি। এদিকের খাল নদী সম্পর্কে ধারণাও কম। আবার দস্যুদের সাথে দেখা করতে আসলে বেশি কিছু জিজ্ঞেসও করা যায় না। তাই চুপ করে শুয়ে রইলাম। এখন পর্যন্ত আলিফ ডাকাতের কোনো খবর নাই। কোনো ইশারা নাই, আলামতও নাই। জামু ভাই বললেন, আপনি একটু ঘুম দেন তো ভাই। ও দেখা না দিলে ওর বাপ দেখা দিবে।
কুয়াশার কারণে চারপাশ বেশ ঝাপসা। তাই পাশের খালের মুখেই যে জাল টানানো তা খেয়াল করিনি। শেষ ভাটায় জাল উঠে। এই জালের লোকও এসেছে নৌকা নিয়ে। আমাদের দেখেও না দেখার মতো করে বেয়ে গেলো নৌকাটি। এর মধ্যে এক দুই শব্দে কথা হলো। কী বললো দুজন দুজনকে বুঝলাম না।
জাল তোলার শব্দ ছাড়া আশেপাশে আর কোনো শব্দ নাই। মামদো নদী একদম ঠান্ডা। নৌকা ভাসছে। ভারী কম্বলের ওম নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর ঘুম। ঘণ্টা দুই কাটলো।
বাপজান উঠেন! কেউ একজন ডাকছে। বলছে, বাবাজি, আমি চলে এসেছি! ঘুম ভাঙলেও চোখ খুলতে পারছি না। ভোর হয়ে গেছে। কিন্তু চারপাশে আলো ফোটেনি। আমার গায়ে হাত দিয়ে ডাকছে একজন। মাথাটা এলোমেলো। কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। কে ডাকছে, কোথায় আছি সবকিছু নিয়ে এলোমেলো অবস্থা!
জামু বললেন, ও ভাই উঠেন। আপনার ছেলে আইছে! চোখ খুললাম। দেখি আরেকটি নৌকা ভিড়ানো সাথে। সেখান থেকে মুখ বাড়িয়ে আমাকে ডাকছে একজন। কৃষ্ণকায়, ইয়া বড় দাড়ি-গোঁফওয়ালা একজন। একমুহুর্তও দেরি হলো না চিনতে, আলিফ ডাকাত!
শরীর আজ সায় দিচ্ছে না। তাই উঠবো উঠবো করেও উঠছি না। আলিফের সাথে দেখা হয়ে গেছে। দেড় দিনের দুশ্চিন্তা কেটেছে। অনেকটা নির্ভার হলাম। আলিফকে বললাম, তুমি আসছো? আচ্ছা থাকো। আমি আরেকটু ঘুমাবো, আমাকে বিরক্ত করো না। আর কোনো কথা না। সে বললো, তাহলে আমরা একটা খালের ভেতরে ঢুকে দাঁড়াই? এই জায়গাটা নিরাপদ না। বললাম, যেখানে খুশি নিয়ে যাও। আমার ঘুম দরকার! আলিফ তড়িঘরি বিদায় নিলো। আমি আবার ঘুম দিলাম। নৌকা বহর রওনা দিলো। কোনো এক নিরাপদ খালে গিয়ে দাঁড়াবো।
কতোক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। যখন উঠলাম তখন বেশ রোদ উঠে গেছে। আলো ঝলমল করছে চারপাশ। কম্বল সরিয়ে উঠবে বসলাম। পলিন তখনও ঘুমে। উঠে দেখি, পাশেই একটি ট্রলার বাঁধা। সেখানে অস্ত্র হাতে চলাফেরা করছে বনদস্যুরা। ভাবছি, এটা আলিফ বাহিনী! পশ্চিম সুন্দনবনের জেলেদের যম! ট্রলারের সুকানির কাছে দাঁড়ানো যুবকটিই আলিফ। আলিফ বাহিনীর প্রধান। যার নামে থরথর করে কাঁপে সুন্দরবনের পশ্চিম পাশ!
আমাদের আরেক পাশে একটি নৌকা বাঁধা। ভোর রাতে এই নৌকাতে করে জাল ধরছিলো জেলেরা। একজন বসা। বললাম, এটা কি ডাকাতির নৌকা? লোকটি বললো, না কাকা। আমরা জেলে, রাতের বেলা দেখা হলো না? বললাম, ওই বড় নদীর মুখে দেখলাম, জাল তুললে সেটা তোমরা? বাড়ি কোথায়? বললো, মুন্সিগঞ্জ। বললাম, তোমাদের কি আপহরণ করছে আলিফ? বললো, না কাকা। এমনি আসলাম। বললাম, ডাকাতের কাছে জেলেরা কি এমনি আসে? পাশে থেকে একজন বললো, ও তো দয়ালের ভাই!
মানে আলিফ ডাকাতের আপন ভাই সে। জঙ্গলে মাছ ধরে। আর গত রাতে সেই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে আলিফ বাহিনীর কাছে! বললাম, এই খালের নাম কি শোব্দে? ছেলেটি বললো, না কাকা, গুব্দে। পরের খালটার নাম শোব্দে। মামদো নদী থেকে একসাথে ঢুকেছে দুটি খাল। তাই জেলেরা এই জায়হার নাম বলে, শোব্দে-গুব্দে।
(২৫ জানুয়ারি ২০১৭, সুন্দরবন)
ছবি: আলিফ তখন সুন্দরবনের ত্রাশ