তোরা থামবি? নাকী গুলি চালাবো? | রূপান্তরের গল্প ৩৭৩ | Rupantorer Golpo 373 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৭৩ : এই কারা তোরা? থাম বলতিছি! এদিক থেকে হাঁক দিলো স্যুরা। ওদি দিয়ে দুটি নৌকা যাচ্ছে পর পর। বৈঠা নিয়ে এমন ভাবে পানিতে বাড়ি মারছে যেন কী একটা বিরাটি বিপদ তাড়া করেছে! একটু পরেই বুঝলাম, হ্যাঁ, সত্যিই বিরাট বিপদ। ওদের দাঁড়াতে বলছে সুন্দরবনের ডাকাতেরা। দস্যুনেতা ডাকছে, এই তোরা কী মরবি? একদম গুলি করে দিবো কিন্তু!
হঠাৎ অসাড় হয়ে আসলো সবকিছু। দুই নৌকার চার মাঝির শক্ত হাতগুলো যেন মুহুর্তেই শক্তি হারালো। আর কয়েক সেকেন্ড সময় পেলেই খালের আড়ালে চলে যেতে পারতো। কিন্তু হলো না। কিছুক্ষণ থেকে থেমে থাকলো ওরা। এখনও পালানোর সুযোগ খুঁজছে। এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। এর মধ্যে শুরু হলো অকথ্য গালিগালাজ।
দস্যুদের ট্রলার থেকে একজন বলছে, শু… বাচ্চা! তোরা মানুষ হবি না? ভালো ভাবে ডাকলে শুনিস না কেন? এরপর গালি দেই, মারপিট করি। তারপর তোরা বলিস, ডাকাতেরা খারাপ। আরে খারাপ তো আমরা এমনি এমনি হইনি। তোরাই আমাদের খারাপ বানাইছিস!
ডাকাতের খপ্পরে পড়া নৌকাগুলো কাঁকড়া শিকারীদের। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলো। দিনে দুপুরে দস্যুদলের সামনে পড়তে হবে বুঝতে পারেনি। হতভম্ব লোকগুলো এখনও পালানোর পথ খুঁজছে। যদি কোনো সুযোগ থাকতো তবে চেষ্টা করতো! বৈঠা বাওয়া বন্ধ করে ওরা এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। এসময় চিৎকার করে উঠলো দস্যুনেতা আলিফ। বললো, তোদের কি গুলি করবো এখন? এদিক আয় তাড়াতাড়ি।
সুন্দরবনের দস্যুদল আর জেলেরা মুখোমুখি। সকাল সকাল এই দৃশ্য দেখছি চোখের সামনে। উঠে বসলাম। কম্বল সরিয়ে বের হলাম ছইয়ের ভেতর থেকে। সামনে আলিফ বাহিনীর ট্রলার। সেখানে অস্ত্র হাতে বসা-দাঁড়ানো ১২-১৪ জন বনদস্যু। তাদের তাড়া খেয়ে নৌকাদুটি এগিয়ে আসলো। ভিড়লো ট্রলারের সাথে। একজন বললো, আমরা ওমুকের জেলে। বাড়ি হরিনগর।
আলিফ বললো, ওই ব্যবসায়ী তো আমাকে কোনো টাকা দেয়নি। তোমরা কয় নৌকা এদিকে কাঁকড়া ধরো? জেলে বললো, আমরা দুই নৌকা আছি। আর কয়জন আছে জানি না। তবে আপনাদের নামে টাকা দিছি নৌকা প্রতি দুই হাজার করে।
কাঁথা বালিশের ভেতর থেকে একটি কৌটা বের করলো জেলেরা। প্লাস্টিকের কৌটা। ভেতরে বন বিভাগের পাশ, কিছু খুচরা টাকা, বিড়ির প্যাকেট আর কিছু কাগজ পত্র। সেখান থেকে একটি ভিজিটিং কার্ড বের করলো। এগিয়ে দিলো।
কয়রার এক মাছ ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানের কার্ড। তাতে সাক্ষর দেওয়া, তারিখ দেওয়া। কার্ড হাতে নিয়ে আলিফ তার মুহুরির হাতে দিলো। বললো, দেখ তো! মিলায়ে দেখ টাকা জমা দিছে কী না!
নৌকার উপর হাত জোড় করে দাঁড়ানো জেলে। বয়সে মুরুব্বি। একবার বলেন স্যার, একবার দয়াল। বলে, গরীব মানুষ আমরা। টাকাও দিছি। এই গোনে কাঁকড়া পড়েনি। চালানই উঠবে না। সূদের ভার আর বইতে পারতিছি না দয়াল। আমাদের একটু দয়া করো। আলিফ বললো, আমারও তো একই অবস্থা! সূদ টানতিছি তো আমিও। এছাড়া জঙ্গলে আসছি ডাকাতি করতে। দয়া মায়া নিয়ে ঘুরলে চলবে? না খেয়ে মরতে হবে তো। ডাকাতের মনে দয়া মায়া থাকলে চলে?
একটু দয়া করেো দয়াল! বলে উঠলাম আমি। ঘুরে তাকালো আলিফ। আমার কথা শুনে চমকে উঠলো সবাই। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো দস্যুনেতা। এগিয়ে আসলো।
নৌকা টেনে ট্রলারের কাছে নেওয়া হলো। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। লাফিয়ে নৌকায় উঠলো দস্যুনেতা। জড়িয়ে ধরলো। বললো, বাপজান আসছে আমার কাছে। আর কোনো চিন্তা নাই। এবার মনে হয় বাঁচতে পারবো। বললাম, তোমার বাঁচার লাইন তো দেখি না। যা শুরু করছো!
ভোর রাতে দেখা হলো। ঘুমাচ্ছিলাম তখন। এরপর কয় ঘণ্টা গেছে জানি না। ঘুমের ঘোরে বুঝতেও পারছি না কয়টা বাজে। রাতে ওদের সাথে কথা হয়নি। এই দলের দস্যুদের কাউকে চিনিও না আগে থেকে। ওদিক থেকে সালাম দিলো তারা। হাত তুলে উত্তর দিলাম। আলিফকে বললাম, দলের সবার সাথে কথা বলছো তো? এবার কিন্তু বাড়ি ফিরতে হবে!
দস্যুনেতা বললো, বাড়ি ফিরতে পারলে কি আর ডাকাতি করতে আসতাম? অনেক বার চেষ্টা করছি। কেউ আমাকে ভালো হতে দেয়নি। বললাম, এখন তো সেই সুযোগ আসছে। কিন্তু তুমি বাবা কথা মতো চলছো না। মাথা নিচু করে বললো, আমার মতো বিপদে আর কেউ নাই। উঠতে তো পারিই। কিন্তু পাওনাদাররা আমাকে বাড়িতে থাকতে দিবে? যার কাছে টাকা নিলাম তার কাছে তিনটা ব্ল্যাংক চেক দেওয়া আছে। টাকা না দিলে মামলা দিবে। চেক এর মামলা খুব কঠিন!
তাকিয়ে দেখি ওই কাঁকড়ার জেলেরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ঠিক বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে এখানে। শহুরে কাপড় পড়া মানুষগুলোকে নিয়ে বিরাট চিন্তায় তারা। মনে হয় ভাবছে, নতুন করে আবার কোন বিপদ আসলো না তো! এমনিতেই বিপদের শেষ নাই।
কী অসহায় সে চাহুনি! অথচ এই মানুষগুলোই জঙ্গল বাদায় বাঘের সাথে লড়াই করে। কুমির ভাসে নৌকার পাশে, সেখানে নেমে জাল ধরে, গোসল করে। কখনও কুমিরে টান দেয়, যুদ্ধ করে ফিরে আসে। বাঘের মুখ থেকে ফিরে আসার ঘটনা অসংখ্য। সেই মানুষগুলোই দস্যুদের সামনে অসহায় হয়ে পড়ে। সামনে বাঘ পড়লেও এই মানুষেরা হাতের লাঠিটা দিয়ে পাল্টা আঘাত করে। ঝড়-ঝঞ্ঝায় সাগর পাড়ি দেওয়ার সময়ও যাদের মুখে হাসি দেখি, সেই মানুষেরা অসাড় হয়ে পড়ে বনদস্যুদের সামনে পড়লে।
আলিফের মুহুরি বললো, ও দয়াল, এদের গোনের টাকা তো জমা হয়নি। খাতা কলম নিয়ে বসে সে হিসাবের খাতা চেক করছে। ওদের মহাজনের নামে কোনো টাকা জমা হয়নি। কী করবো? আলিফ বললো, ওদের বাইন্দে রাখো। মিথ্যা কথা বললো কেন? জেলেরা বললো, আমরা তো টাকা দিয়ে দিছি। নৌকা প্রতি দুই হাজার টাকা তো আপনার নামে নিলো কোম্পানি। স্লিপও দিলো।
মনটা খারাপ লাগছে। জেলেদের জন্য মায়া লাগছে। জেলেদের হয়ে বললাম, শোনো দয়াল। ওদের ছেড়ে দাও। আমি আসছি এই উছিলায় ছাড়ো। দস্যুনেতা বললো, এমনি ভয় দেখাচ্ছিলাম বাপজান। ওদের কাছে টাকা নিবো না। কিন্তু এখন ছাড়াও যাবে না।
পাশ থেকে একজন বললো, এদের এতো দয়া দেখালেও বিপদ। যদি ছাড়ি তো এক টানে আশেপাশে যেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় সেখানে যাবে। তারপর প্রশাসনকে জানিয়ে দিবে আমাদের অবস্থানের কথা। এমনিতেই এই খালে আমাদের থাকা উচিৎ না। তারপরও দেরি হবে বলে এখানে আসতে হলো। এরপর জেলেরা নৌকা বাঁধলো আমাদের সাথে। চোখে মুখে তাদের ভয় আর অবিশ্বাস। বললাম, আজকের দিনটা এখানে দাওন পাতলে হয় না? এই খালে কাঁকড়া পাওয়া যাবে না? জেলেরা বললো, চেষ্টা করে দেখতে পারি।
দস্যুনেতাকে বললাম, এদের একটু দাওন বড়শি বাইতে দাও। আশেপাশেই থাকুক। প্রয়োজনে তোমার লোক একজন দিয়ে দাও। কিছু বলতে যাচ্ছিলো সে। বললাম, রাতে কাঁকড়া খাওয়া যেতো তাহলে। আসলে কাঁকড়া খাওয়ার এতো আগ্রহ আমার নাই। কথাটি বললাম যাতে ওদের কাজ করতে ছাড় দেয় আলিফ। এক বেলা নষ্ট হলে বিরাট লোকসান। আলিফ ইশারা দিলো। বললো, আশেপাশে দাওন ফেলো। নজরের বাইরে যাবা না।
কাঁকড়ার জেলেরা বিশ্বাস অবিশ্বাসের মধ্যে। বুঝতে পারছে না কী করবে! বললাম, এখন কি দাওন ফেলার সময়? ওরা বললো, কয় টান দেওয়া যাবে। বললাম, এখানে কাঁকড়া হবে? বললো হতে পারে। দাওন মানে কাঁকড়া ধরার পদ্ধতি। দড়িতে আধার দিয়ে ফেলতে হয়। ওদের সাহস দিলাম। বললাম, যান আপনারা। কাঁকড়া ধরেন। ওরা নৌকা নিয়ে এগিয়ে গেলো।
হাতমুখ ধুতে হবে। টুথপেস্ট-ব্রাশ আনিনি। ওদের কাছ থেকে টুথ পাউডার নিয়ে দাঁত মাজলাম। মুখ ধুতে গিয়ে খালের পানি মুখে নিলাম। মনে হলো বিদ্যুতের শক লাগলো মুখে! এতো লবণ? পানি একদম তিতা! এদিকের খাল-নদীগুলোর পানিতে লবণ অনেক বেশি। জেলেরা বলে, লবণ বেশি হলেও মামদো কিংবা রায়মঙ্গল নদীতে মাছ-কাঁকড়া বেশি হয়। তবে সুন্দরবনের জন্য এই পরিবেশ একেবারেই বৈরী। লবণ পানি আর মিঠা পানির সংমিশ্রনেই জন্ম সুন্দরবনের।
বিশাল এই জঙ্গলের বাংলাদেশ অংশ ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটার। ভারত অংশে সুন্দরবন চার হাজার বর্গ কিলোমিটার। আমাদের পূর্ব দিকে বলেশ্বর নদীর পশ্চিম পাশ থেকে শুরু সুন্দরবন। শেষ হয়েছে সীমান্ত নদী রায়মঙ্গলে। তারপর থেকে ভারতের সুন্দরবন। পশ্চিমে লবণাক্ততা বেশি। পদ্মার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এটি ঘটেছে।
উজানে ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে পদ্মার পানি প্রবাহ কমে গেছে। এর উপর নির্ভরশীল অন্য নদীগুলোও তাই মরতে বসেছে। গড়াই নদী দিয়ে দেশের পশ্চিম অংশে পানি নামতো। গড়াইয়ের পানিতে বেঁচে থাকতো আরও বেশ কয়েকটি নদী। কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা আর খুলনা হয়ে নদীর পানি বইতো সুন্দরবনে। সেই মিঠা পানির স্রোত জোয়ারের লবণ পানিকে চাপ দিয়ে রাখতো।
এখন সেই পরিবেশ নাই। তাই লবণাক্ততা বাড়ছেই, ক্রমেই সেটি ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম-দক্ষিণের পানি আর মাটিতে। পানিতে লবণ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে ভুগছে এদিকের মানুষ। আর তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভালো বলতে পারবেন বিজ্ঞানীরা।
এতোক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘুম থেকে উঠেছি ঘণ্টা খানেক হলো। কিন্তু বেলা এগারোটা বেজে গেছে বুঝতে পারিনি। কুয়াশা আছে এখনও। সূর্য মাামও ঠিকঠাক উঠতে পারছে না। পলিন এখনও ঘুমাচ্ছে। ডেকে তুললাম। সকালের নাস্তা তৈরি হয়েছে। খেতে বসবো এখন।
আলিফ বাহিনীর দস্যুদের সাথে এবার পরিচয়ের পালা। ট্রলারে উঠে জনে জনে পরিচিত হলাম। সামনের দিকে মাটির চুলা বসানো। তাতে আগুন জ্বলছে। পাতিলে কিছু একটা চড়ানো। পাশেই কেরোসিনের চুলায় গরম হচ্ছে চায়ের পানি। এখানে রান্নাবান্নার কাজ করছে জেলেরা। সকালে রান্না হয়েছে গরম ভাত আর কাঁকড়ার তরকারি।
পলিন আসলো। তারপর সবাইকে নিয়ে খেতে বসলাম। তরকারিটা ভালো লাগছে না। রান্নায় মনে হয় একটু সমস্যা। গন্ধ লাগছে। চুলার পাশে বসা লোকটিকে বললাম, একটু মরিচ পুড়ায়ে দিতে পারেন? শুকনা মরিচ আছে? কিছুক্ষণের মধ্যে মরিচ পোড়া, পেঁয়াজ কুঁচি আর সরিষার তেলের বোতল এনে রাখলো একজন। সাদা ভাতে পানি দিয়ে পান্তা বানিয়ে ফেললাম। ঝাল পেঁয়াজ মাখিয়ে খেয়ে নিলাম। একটু জোর করেই ভাত খেলাম। কারণ পরের বেলার খাবার কখন হবে বলা মুশকিল।
আলিফ একটু অপ্রস্তুত! বললো, আপনি তো সময় দিলেন না বাপজান। একটু ভালো মন্দ খাওয়াবো সেই সময়ও পাইনি। মরা গোন চলে। নদীতে বড় মাছের জেলেরাও নাই। বললাম, এ নিয়ে চিন্তা করো না। তুমি কী করবে শেষ পর্যন্ত সে কথা ভাবো। এতো ঝামেলা করে আসছি একটাই কারণ। তোমরা সারেন্ডার করো।
আলিফ শুধু জামুর দিকে তাকায়। কিছু একটা বলবে বলবে করেও বলছে না। এই মুহুর্তে আমার সেই না বলা কথাটাই এখন জানতে হবে। মনে হচ্ছে আলিফের সারেন্ডার করা না করার বিষয়টি ওই প্রশ্নের উত্তরে আটকে আছে। এখানে রেজাউল নামে এক বনদস্যু আছে। তাকে চেনা চেনা লাগছে। জামু আর আলিফ ঘন ঘন তাকাচ্ছে তার দিকে।
(জানুয়ারি ২৫, ২০১৭ । সুন্দরবন)
ছবি: আলিফ