রূপান্তরের গল্প ৩৭৫ | Rupantorer Golpo 375

বন্দুকটা একটু ধরবেন? | রূপান্তরের গল্প ৩৭৫

বন্দুকটা একটু ধরবেন? | রূপান্তরের গল্প ৩৭৫ | Rupantorer Golpo 375 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৭৫ : আগুন জ্বলছে ওই নৌকায়! কী সর্বনাশ! ওখানে তো লোকজন আছে! এই তোমরা করো কী? আগুন জ্বলে কেন? ওরা হাসছে। বললো, নৌকায় আগুন লাগেনি ভাই! রাজহাঁসের লোম পোড়াবে বাবুর্চি!

ট্রলারে আধশোয়া বসা আমরা। তাই পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম না। উঠে দেখি নৌকার উপর একটা কড়াই রাখা। তার উপর কাঠ রেখে আগুন ধরিয়েছে। সেই আগুনো রাজহাঁস দুটির লোম পোড়াচ্ছে একজন। দুপুর প্রায় তিনটা বাজে। ভাত রান্না হচ্ছে। এরপর উঠবে রাজহাঁস। ওদিকে দুইজন বসে মসলা বাটছে, আলু-পেঁয়াজ কাটছে।

দুপু্র গড়িয়ে উঠলো সূর্য মামা। তাপ ছড়াচ্ছে এখন। জ্যাকেটসহ গরম কাপড়গুলো ছাড়লাম। গোসল করে নিবো। এখানে গোসল করতে হবে লবণ পানি দিয়ে। খালে নামবো না। ওরা পানি তুলে দিকে বালতি দিয়ে।

প্রতিটি ট্রলারে ছোট বালতি থাকে। দড়ি লাগানো সেই বালতি দিয়ে নদী, খাল বা সমুদ্র থেকে পানি তোলা হয়। এই একটি সরঞ্জাম না থাকলে ট্রলার জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠবে। তাই বালতির ব্যাপারে কোনো গাফিলতি চলে না।

একজন পানি তুলে একটি ড্রামে রাখছে। মগ দিয়ে গোসল সেরে নিলাম। শীত কাল বলে একটু ঠান্ডা লাগছে। আবার ভালোও লাগছে। মাথায় শ্যাম্পু দিলাম, সারা গায়ে দিলাম সাবানের মতো করে। তারপর মগ দিয়ে মাথায় পানি ঢালছি। কিন্তু শরীর থেকে শ্যাম্পুর ফেনা কাটছে না। কেমন জানি পিচ্ছিল হয়ে আছে। অস্বস্তি লাগছে। পরে এক দস্যু এসে বালতি দিয়ে সারা শরীরে পানির ঝাপটা দিলো। কোনো রকমে গা মুছে গোসল শেষ করলাম। তারপর সরিষার তেল মেখে রোদে বসলাম। পলিনকেও গোসল সেরে নিতে বললাম।

রোদ পোহাচ্ছি। ভীষণ ভালো লাগছে। শরীরটা হাল্কা লাগছে। কী যে শান্তি লাগছে! এমন সময় আলিফ বললো, বন্দুকটা ধরবেন বাপজান? কী ব্যাপার? আলিফ ডাকাত বন্দুক হাতছাড়া করবে? বললাম, এখনই কি সারেন্ডার করবে? সে বললো, না বাজান, গোসল করবো! ট্রলারের সবাই অবাক! দয়াল গোসল করবে!

বন্দুক, গুলির ব্যাগ আমার হাতে দিয়ে গোসলে নামলো আলিফ। ঝাঁপ দিলো খালে। কিছুক্ষণ লাফ-ঝাঁপ দিয়ে উঠে এলো। গায়ে শ্যাম্পু মেখে আবার নামলো। গোসল সেরে উঠে পাশে বসলো। গুলির পোসেস এর বেল্ট লাগাতে লাগাতে বললো, এ দফায় জঙ্গলে নামার পর দ্বিতীয় বার গোসল করলাম। বললাম, ঘটনা কি বলো তো? আলিফ বললো, বন্দুক আরেকজনের হাতে দেওয়া মানে বুঝেন বাবাজি? মানে জীবনটা অন্যের হাতে তুলে দেওয়া। সুন্দরবনের ডাকাতির লাইনে এভাবে কতো লোক মরলো!

গোসল না করার কাহিনী তাহলে এই? তোমরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করো না। আবার একসাথেই থাকো! কী জীবন এটা? দস্যুনেতা বললো, শুধু গোসল না, ঘুমও দিতে পারি না সেই কবে থেকে! শরীরে ঘুম চায়। কিন্তু মনে হয় ঘুমালে আর উঠা হবে না। কেউ একজন গুলি করে পানিতে ভাসায়ে দিবে অথবা জঙ্গলের ভেতর পুঁতে ফেলবে। আমার পরিবারের লোকজন লাশটাও দেখতে পাবে না!

গত বছর আলিফ এসে নোয়া বাহিনীর সাথে মিলে। সেবার বিদ্রোহ হয়। আলিফ টেরও পায়নি কখন কী হলো! সে ফোন করতে উঠেছিলো একটি গাছের মগডালে। নামার সময় বন্দুকটা একজনকে ধরতে দিলো। সেই বন্দুকই তার দিকে তাক করলো প্রতিপক্ষ। তারপর নিরস্ত্র করে তাদের বন্দী করা হয়। মাস্টাররা তাকে মেরে ফেলেনি। একটু এদিক সেদিক হলে গুলি করতো। জীবন বাঁচলেও বেশ কয়েকটি বন্দুক আর গুলি খোয়া গেছে সেবার। এমন অনেক গল্প আছে সুন্দরবনের দস্যু জগতে।

নুরাবি (নূর হাবিব) নামের প্রবীন এক দস্যুনেতা উঠেছিলো গাছে। বাকীর সব তার নাতির বয়সী। তাশ খেলার অভ্যাস ছিলো খুব। সদস্যদের নিয়ে নিয়মিত জুয়া খেলতো। একবার পশুর নদীর বাওনে ধানসিদ্ধে এলাকায় এমন আড্ডা বসেছে। তাশ খেলতে খেলতে সে একটু বিরতি নেয়। কিছু জরুরি ফোন করতে গাছে চড়ে। উঠার সময় বন্দুকটি সবচেয়ে বিশ্বস্ত সদস্যের হাতে দিয়ে যায়। মাথায় উঠে বসতেই নিচ থেকে গুলি চলে। গুলি খাওয়া পাখির মতো গাছ থেকে পড়ে দস্যুনেতা নুরাবির লাশ!

শুধু আলিফ না। সবগুলো দস্যুদলেই এই আতঙ্ক আছে। তাই কেউ নিজের বন্দুক হাতছাড়া করে না। লোড করা থাকে চব্বিশ ঘণ্টা। যাতে মুহুর্তেই চালানো যায়। সুন্দরবনের দস্যুদের বেশির ভাগ অস্ত্র একনলা ও দোনলা বন্দুক। পুরনো অস্ত্র সব। অবৈধ বাজারে শত শত বন্দুক কোত্থেকে আসে বুঝি না। অনেককে জিজ্ঞেস করেছি। কেউ বলতে চায় না। যারা বলে তারা বিভ্রান্ত করে। সব কিছুই জানতে পারছি। চোখের সামনে দেখছি জলদস্যুতার ভেতর বাহির। শুধু অস্ত্রের কারবারীরা এখনও চোখের আড়ালে। ওদের অনেককে চিনি। অনেকে বন্দুকযুদ্ধে মারা পড়েছে, কেউ জেলখানায়। তবে আমরা দেখি না যাদের তারা ভালো আছে। ওরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

আপনারা তো শুধু পুঁটি মাছ ধরেন, মারেন। এদিকে বড় ব্যবসাটা যারা করে তাদের সাথে এক টেবিলে বসেন। শহরের ভদ্রলোকদের সাথে তারা মিশে আছে। কেউ কিছু বলে না। চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়, অথচ অস্ত্রের কারবারীদের আপনারা খুঁজে পান না। বলেই কতোগুলো গুলি বের করলো আলিফ। বললো, এক পিস গুলি ১২শ’ টাকা। ওরা বিক্রি করে। কিন্তু অর্ধেক গুলিই ড্যাম।

একটা বন্দুক নিয়ে সামনে রাখলো আলিফ। গুলি ভরলো। নল পানির দিকে রেখে দিলো টান। টাক করে শব্দ হলো। কিন্তু গুলি ফুটলো না। আমি তো ভয়েই শেষ। আলিফ বললো, বন্দুকগুলোর একটারও সেফটি লক ঠিক নাই। কিছু বন্দুক তো নষ্টই আসে। প্রতিটি দেড় খেকে তিন লাখ টাকা নেয়। টাকা আগাম দিতে হয়। ব্যবসা করে, ঠকায়ও। কিন্তু কিছু বলতেও পারি না। ওই সাহেবেরা ক্ষেপলে আমরা জঙ্গলেও টিকতে পারি না।

পাশ থেকে তরুণ এক বনদস্যু বললো, এই জগত বেঈমানে ভরা। সবাই সুযোগ মতো কামাই করে নেয়। আমাদের হাতে বন্দুক, ব্যবসা অন্যদের। ক্রসফায়ারে মরি আমরা। দস্যুতার টাকা ভাগ হয় শহরে। আমরা জঙ্গলে বসে একজন আরেকজনকে মারি। বড় ভাইদের কথা মতো না চললে কাউকে দিয়ে মারিয়ে দেওয়া হয়। অন্তত নেতৃত্ব থেকে তাকে সরানো হয়। বিষয়টি বেশ জটিল।

গল্প জমে উঠেছে। এতোদিন ধরে আলিফ কেন সারেন্ডার করছে না, কেন ঘুরাচ্ছে তা বুঝতে পারছি। দলনেতা সে হলেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, এসব জানতে পারছি। পশ্চিম সুন্দরবনের দস্যু বাহিনীগুলোকে নিয়ে নতুন করে জানছি। কেন আলিফ অস্ত্রটি কারও হাতে রেখে এক মুহুর্তও থাকতো পারে না। অন্ত্রটি কারও হাতে দিয়ে গোসলও করতে পারে না।

রাজু বাহিনীর প্রধান রাজুকে নিয়ে এমন অনেক গল্প আছে। গল্প করতে করতে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার ঘটনা আছে। অন্য দস্যু দলকে দাওয়াত দিয়ে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে। আলিফের দস্যু জীবনেও এমন ঘটেছে, সে নিজেও ঘটিয়েছে অন্যের সাথে।

গল্পে গল্পে দুপুর গড়িয়ে গেছে। চা চলছে একটু পর পর। এই দস্যুদল সম্পর্কে RAB এর গোয়েন্দা তথ্যের সাথে বাস্তবতা মিলছে না। দস্যুনেতা আণিফ কিছুতেই সারেন্ডার করবে না, এমন তথ্যই ঘুরছে। শুনেছি, কিছুদিন ডাকাতি করে সে আত্মগোপনে যাবে। কিছুতেই সারেন্ডার করবে না, খোদ গোয়েন্দা প্রধান আমাকে বলেছেন। কিন্তু মাঠে এসে দেখছি বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে এসে দেখি আলিফ আমার সাথেই ফিরতে চায়।

খালের মাথায় ডিউটি বদল হলো। নতুন দুজন গেলো। আগের দুজন বললো, ওদিকে কোনো ঝামেলা নাই। সন্দেহজনক কোনো চলাফেরা নাই। কিছু জেলে নৌকা গেছে। বললাম, জামু ভাইদের কোনো খবর আছে? সাথে কে কে গেছে? আলিফ বললো, রেজাউল গেছে সাথে আরেকজন। মনে মনে ভাবছি, রেজাউলকে নিয়ে সন্দেহ করছিলাম। জানি না আজ আর তারা ফিরে কী না!

রেজাউলকে সস্প্রতি নামানো হয়েছে ইদানিং। জামুর মাধমেই নেমেছে তারা। আলাদা দল না করে ভিড়ানো হয়েছে আলিফের সাথে। এদিকে যা বুঝলাম, হঢতো আলিফকে সরিয়ে তাকেই বানানো হবে দলের প্রধান। ওরা না ফেরা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারছি না।

(জানুয়ারি ২৫, ২০১৭, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top