রূপান্তরের গল্প ৩৭৬ | Rupantorer Golpo 376

আঁধারে ফুটলো আশার আলো | রূপান্তরের গল্প ৩৭৬

আঁধারে ফুটলো আশার আলো | রূপান্তরের গল্প ৩৭৬ | Rupantorer Golpo 376 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৭৬ : শিকারীদের কোনো খবর নাই। দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আলিফ বলে, টেনশন করেন না বাবাজি। ওরা চলে আসবে। আর না আসলে না আসুক। বললাম, না আসলে চলবে কী করে? আমি পুরো আলিফ বাহিনীকে সারেন্ডার করাবো, অর্ধেক বাহিনী না। হেসে দিলো সে। বললো, আমার লোকজন তো রেডি। বললাম, তাহলে রেজাউলদের দলে ঢোকালে কেন? আলিফ বললো, উপায় ছিলো না বাপজান।

সন্ধ্যা হচ্ছে। জেঁকে নেমেছে শীত। ডুবার আগেই কুয়াশা গিলে ফেলেছে সূর্যকে। বুকের ভেতর টান লাগছে। কেন জানি মনে হচ্ছে নতুন কোনো বিপদ আসছে। সুন্দরবনে আসলে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় সক্রিয় হয়।

এখন যা লিখছি তার সাথে বিজ্ঞানের দূরত্ব অনেক। তবে বনদস্যুদের জগতে কিছু একটা ঘটছে। আমি অনুভব করছি। বড় কোনো ঘটনা ঘটবে। সেটা ভালো না মন্দ বুঝতে পারছি না। আসলে গেলো মাস খানেক সবকিছু উল্টে পাল্টে গেছে। ভাবছি অন্তত আলিফ বাহিনীটা এভাবেই থাকুক। ওরা আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত। দলের ভেতরে ঝামেলাটুকু কাটলেই হয়। রাতেই ফিরবো। উঠেই কথা বলবো RAB এর গোয়েন্দা প্রধানের সাথে। যদি সব ঠিক থাকে তবে এক দুই দিনের মধ্যে ওদের উঠিয়ে নিবো।

ভাত রান্না হয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগেই খেয়ে নিতে হবে। এদিকে সন্ধ্যার মধ্যে খাওয়ার দাওয়ার কাজ সেরে নিতে হয়। জেলে হোক বা বনদস্যু, দুই দিকের লোকজনই সন্ধ্যার পর আলো জ্বালে না। আলো জ্বালানো নিষেধ!

খাবারের আয়োজন বেশি কিছু না। ভাত আর রাজহাঁসের তরকারি। পলিনসহ সবাই মিলে বসলাম। রান্না ঠিক সেই পর্যায়ের হয়নি। বেলায়েত সর্দারের রান্নার মতো মুখরোচক রান্না সবখানে আশা করি না। কিন্তু এখানকার রান্না সাধারণ মানেরও না। সুন্দরবনের কাঁকড়ার জেলেদের রান্নাও অনেক স্বাদের হয়। কিছু করার নাই। কোনো রকমে পেট ভরাতে পারলেই হয়।

খাবার তেমন ভালো হয়নি। তবে সামনের বার যখন আসবেন তখন নিজের হাতে রান্না করবো। এবার ভালো মন্দ খাওয়াতে পারলাম না বাজান। বলছিলো দস্যুনেতা আলিফ। বললাম, সামনের বার কি দেখা হবে তোমার সাথে? হেসে বললো, উপরওয়ালা চাইলে হবে। বললাম, সবকিছু উনার ঘাড়ে ফেললে হবে? খাওয়া শেষে একটু ঘুরতে যাবো। যদিও সন্ধ্যা নেমে গেছে।

ঘুঁটগুঁটে অন্ধকার। নৌকার পেছনে বসেছে আলিফ। সামনে বৈঠা হাতে আমি। সশস্ত্র আলিফের হাতের বন্দুকটি কাঁধে রাখা। একটি বন্দুক দিলো আমার হাতে। দোনলা বন্দুক। গুলি ভরা। বন্দুক দিলো যাতে বিপদ আপদ হলে ব্যবহার করতে পারি। বললাম, অন্ধকারে কিছু দেখবো না। বন্দুকটা রাখো। আলিফ বললো, থাকুক নৌকায়।

দুজন মিলে বৈঠা বাইছি। নৌকা চলছে বড় খালের দিকে। থৈথৈ করছে সুন্দরবন। মানে ভরা জোয়ার। এর মধ্যে কুকু পাখির ডাক শুনলাম। মানে ভাটা শুরু হয়েছে। এই ভাটা শেষ হয়ে যখন জোয়ার আসবে তখন রওনা দিবো আমরা। এখন বাজে বিকাল পাঁটটা। কুয়াশার কারণে মনে হচ্ছে গভীর রাত। আমরা ছোট খালটি ধরে পৌঁছালাম বড় খালে, যার নাম গুব্দে। মামদো নদীর একটি খাল। নৌকা নিয়ে এখান থেকে চারপাশের যেকোনো নদীতে বের হওয়া যায়।

খালের মুখে পাহাড়া আছে। দুজন বন্দুকধারী পর্যায়ক্রমে ডিউটি করছে। এখন জোয়ার। হিসাবে ওই দুইজনের গাছের মাথায় থাকার কথা। কিন্তু গিয়ে দেখি দুজনই কোমড় পানিতে দাঁড়ানো। ঘটনা কী?

নৌকা নিয়ে গেলাম তাদের কাছে। জানতে চাইলাম, ঘটনা কী? ওরা বললো, দুইটা শুয়োর তাড়া করছিলো। হাসবো না কী করবো বুঝতে পারছি না। আলিফ বললো, তোরা বোকা নাকি? শুয়োরের ভয়ে পানিতে নামলি? প্রশাসন আসলে করবি কী? বেশি ঝামেলা হলে গুলি দিবি! ওরা বললো, গুলি দিতে গেলাম। পরে মনে হলো মেহমান আছে!

ভাটা হয়ে গেছে। এখন আর পাহাড়ার দরকার নাই। তোরা নৌকায় উঠে বস। ওরা নৌকায় উঠে বসলো। শীতের সন্ধ্যা, ঠকঠক করে কাঁপছে। বললাম, এর চেয়ে তো জেলখানায় থাকা ভালো। কী করতে যে ডাকাতি করতে নামছো!

বৈঠা আর বাইতে হলো না। দুজনের একজন সামনে গিয়ে বসলো। আমরা যাচ্ছি পূর্ব দিকে। যেখানে ছিলাম দুপুর বেলা। আলিফের কাছে জানতে চাইলাম, আমরা কি শিকারীদের আনতে যাচ্ছি? সে বললো, দেখি বাপজান। ওদের পাবো কী না জানি না। বললাম, তাহলে যেতে দিলে কেন? সে বললো, সব কথা তো বলতে পারছি না বাপ! বললাম, এই কথা না বলতে বলতে কখন মারা পড়বে নিজেও জানবে না।

আলিফ বিয়ে করেছে কয়েক বছর আগে। এক সন্তানও আছে। তবে তারা কোথায় আছে কেউ জানে না। শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জে তার বাড়ি। প্রান্তিক পরিবার। সেখানে যেতে পারে না অনেক বছর হলো। দস্যুনেতা বলে, কী এক জীবনে আসলাম, টাকা কামাই কিন্তু সেই টাকা খাইতে পারি না। জঙ্গলে জঙ্গলে কাটে জীবন। এমনও হয় দিনে এক বেলাও খেতে পারি না। ঘুম তো দূরের কথা।

ধুম করে গুলি হলো! কেঁপে উঠলাম। বৈঠা বাওয়া থামালো ওরা। দ্রুত খালের কিনারে গেলাম। সবাই চুপ। একদম পিন পতন নিরবতা।

কয়েক মুহুর্ত কাটলো এভাবে। শুনশান চারপাশ। শুধু নিজের হৃৎপিন্ডের ধকধক শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ফিসফিস করে জানতে চাইলাম, গুলি হলো কোন দিকে? আলিফ বললো, দুপুরে যেখানে ছিলাম ওই দিক থেকে আসছে গুলির শব্দ। মাটিতে গুলি করছে। মানে ওরাই। জঙ্গলে গুলির মাধ্যমে বার্তা পাঠায় তারা। বিশেষ করে দস্যু দলের মধ্যে বা শিকারীদের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এটা করে তারা। গুলির শব্দের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানের জানান দেয়। আলিফ বললো, চলেন বাবাজি, রওনা দেই।

এমনিতেই সন্ধ্যা থেকে মনে টান দিচ্ছে। তার মধ্যে বের হওয়া, বন্য শুকরের তাড়া খেয়ে দুই বনদস্যুর পানিতে নামা, গুলির শব্দ, সব মিলিয়ে যে পরিবেশ তৈরি হলো, তা ভাবনার মধ্যেও ছিলো না। ভর সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে কেন নৌকা ভাসালো আলিফ, তার হিসাবও মিলাতে পারছি না।

নৌকা চলছে পশ্চিম দিকে। যেদিক থেকে গুলির শব্দ আসলো সেদিকে। কেবল ভাটা হয়েছে। স্রোত ঘুরতে শুরু করেছে। আমরা যাচ্ছি স্রোতের সাথে সাথে।

খালের ভেতরটা ছমছম করছে। সাধারণত জোয়ার আর ভাটার সাথে সাথে বনজীবীদের কাজ আর চলাফেরা চলে। শেষ জোয়ার আর শেষ ভাটায় জাল তোলে জেলেরা। বাকী সময় চলাফেরা করে। এখন ভাটা হলো। স্রোত নামবে নিচের দিকে, মানে দক্ষিণে। যাদের নিচের দিকে যাওয়া দরকার তারা এসময় রওনা দেয়। যখন কোনো জেলে বলে ভাটি দিবো তখন বুঝি দক্ষিণে যাবে তারা। জোয়ার দেওয়ার অর্থ উজানের দিকে রওনা দেওয়া। উজান বলতে উত্তর দিক। তারা দূরত্ব মাপে জোয়ার বা ভাটার হিসাবে। আগে বুঝতাম না এসব। এখন অনেকটা জেনেছি, শিখেছি কিছুটা।

আধা ঘণ্টা নৌকা বেয়ে সেই জায়গায় পৌঁছালাম। আমাদের নৌকায় কোনো আলো নাই। তবে নৌকা বাওয়ার শব্দ আছে। আমরা চলে গেলাম খালের এক পাশে, যেখান থেকে ঢুকে গেছে ছোট খাল। যে খাল ধরে শিকারে গিয়েছিলো জামু ভাইসহ তিনজন।

নৌকা ভিড়তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলো নৌকা। বুকটা ধকধক করছে। ভাবছি যদি ওরা না হয়ে অন্য কেউ হতো! যদি প্রশাসন এসে তাদের ধরে রাখতো? মনে মনে এসব ভাবছি। বলছি না। কারণ এতো ভয় পাচ্ছি তা প্রকাশ করতে চাই না। সবাই আমাকে সাহসী জানে, তাই জানুক।

শিকার পাইছেন? ওরা বললো, কপাল খারাপ ভাই। আজকে কী যে হলো! পুরো ছয় ঘণ্টা ঘুরেও একটা শিকার করতে পারলাম না! ইজ্জত শেষ! নৌকাটি পাশে আসলো। ছোট টর্চ দিয়ে আলো মারলাম। বললাম, শিকার পাননি খুশি হইছি। তো আপনারা হুট করে গেলেন কেন? একবার জিজ্ঞেস তো করবেন! উত্তর দিলো না। আমি আলো জ্বালিয়েছি তাদের চেহারাটা দেখার জন্য। মনে হলো, সত্যি শিকারে গেছে তারা। তবে তার মধ্যে নিজেদের কাথাগুলোও সেরেছে।

চলেন ভাই। নৌকা ঘুরান। ট্রলারের কাছে চলেন। আলিফ বললো, এখন গেলে উজান বাওয়া লাগবে। দুই নৌকা নিয়ে যাওয়ার দরকার নাই। একটা যাক।

ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার! শীত পড়েছে। আপাতত চুপ করে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নাই। ওই নৌকা যাবে, ট্রলারটি নিয়ে ফিরে আসবে এখানে। আশেপাশে কেউ নাই। কোনো জেলেও দেখছি না। নৌকায় চুলা জ্বললো। চা উঠলো। আপাতত ঘণ্টা খানেক সময় কাটাতে হবে। নৌকায় এসে বসেছে রেজাউল আর জামু। আড্ডা জমলো বেশ।

ওরা ওদের কথা বলছে। আমি শুনছি। টুকটাক কথার মধ্যে বুঝার চেষ্টা করছি ওদের সম্পর্কে। সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করার উপায় নাই। তাই শুধু শুনছি আর অনুমান করছি। বুঝার চেষ্টা করছি, আমি যাওয়ার পর কী হতে পারে! রেজাউল আর আলিফের সম্পর্কে টানপোড়েন, মাঝে স্থানীয় পৃষ্ঠপোষক জামু ভাইয়ের মধ্যে একটা যোগসূত্র টেনে না গেলে সবকিছু ভেস্তে যাবে। দলের মধ্যে এই মুহুর্তে গোলাগুলি বা খুণোখুণি হলে বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে।

এই মুহুর্তে এদের আত্মসমর্পণের উপর নির্ভর করছে সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ। দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের মাঝপথে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বনদস্যুদের পৃষ্ঠপোষকরা এখন তৎপর। তাদের মতো করেই ঘুরছে সব। সারেন্ডার থামাতে যে অপচেষ্টা চলছে তা ঠেকাতে এই ঝুঁকি নিলাম আমি। কাউকে না জানিয়ে সুন্দরবনে আসা, বনদস্যু দলের সাথে দেখা করা, এসব জানাজানি হলে অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে। তার আগেই এই সফর নিয়ে বিস্তারিত জানাতে হবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। ওদের বুঝানোর চেষ্টা করছি। বাঁচার সুযোগ কাজে লাগাও।

আলিফকে নিয়ে আর চিন্তা নাই। রেজাউলকে বুঝাচ্ছি। কিন্তু সে ভাঙছে না। পরিস্কার কিছু বলছে না। জামু বলে, সারেন্ডার করলে ওরা বেঁচে যাবে। আমি বাঁচবো কী করে? বললাম, আপনি তো বাড়িতে থাকেন। সে বললো, আমিও পলাতক জীবন কাটাই। মামলা আছে কতোগুলো। এছাড়া ডাকাতদের সাথে আমার যোগাযোগের কথা প্রশাসন জানে। ধরতে আসে মাঝে মাঝে। কিন্তু খবর পেয়ে যাই। প্রশাসন আসলে জঙ্গলে পালাই। চলে গেলে আবার ফিরি। এছাড়া দিনে বের হতে পারি না।

বুঝলাম। বড় সাহেবরা এদেরও ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে। এদের ব্যবহার করে। আবার সময় আসলে ধরিয়ে দেয়। সেই পুরনো খেলা। হুট করে বলে বসলাম, আলিফের সাথে তাহলে আপনিও আত্মসমর্পণ করেন! চিন্তায় পড়ে গেলো জামু। বললো, আমি সারেন্ডার করতে পারবো? বললাম, সে দায়িত্ব আমার!

অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি না। তবে বুঝতে পারছি, জামু ভাই বেশ উত্তেজিত। মনে হচ্ছে কথাটা মনে ধরেছে। বড় গডফাদারদের চক্র থেকে বের হওয়ার পথটি তার পছন্দ হয়েছে। গল্পে গল্পে সে বললো, আমিও তাহলে আত্মসমর্পণ করি। কী বলিস তোরা?

মনে মনে হাসছি আমি। আমার টেনশনের ওদের মাথায় ঢুকাতে পেরেছি। বেঁচে ফেরার পথটি দেখাতে পেরেছি। এখন আর আমার কিছু করতে হবে না। ওরা নিজেরাই উঠে আসবে। রেজাউল বললো, ফিরবেন কবে ভাই? বললাম, কেন ভাই? আজকেই উঠবেন? বললো, উপরে গিয়ে কথা বলে জানান। আমরা রেডি আছি!

আকাশের দিকে তাকালাম। কিছু দেখছি না। তবুও মনে হলো সৃষ্টিকর্তার কথা। মনে হচ্ছে উনি আমাকে সাহায্য করছেন। জামু ভাইকে বললাম, শিকার তো পাননি। এমন হইছে কোনোদিন? সে বললো, জীবনেও না। শিকারে গিয়ে খালি হাতে ফিরিনি কখনও! মনে মনে হাসলাম। ভাবছি, কাহিনী বোধ হয় টার্ন নিতে যাচ্ছে! এই সময়টির অপেক্ষায় ছিলাম আমি!

(জানুয়ারি ২৫, ২০১৭, সুন্দরবন)
(ছবিতে পলিন, আলিফ ও আমি)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top