রূপান্তরের গল্প ৩৭৭ | Rupantorer Golpo 377

সুন্দরবনে ইউ টার্ন; আলিফ আউট, জাহাঙ্গীর ইন! | রূপান্তরের গল্প ৩৭৭

সুন্দরবনে ইউ টার্ন; আলিফ আউট, জাহাঙ্গীর ইন! | রূপান্তরের গল্প ৩৭৭ | Rupantorer Golpo 377 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৭৭ : ডিঙ্গি নৌকাটা সামনে। চারজন মিলে বৈঠা বাইছে। ছপ ছপ ছপ ছপ, এক তালে পানিতে পড়ছে বৈঠার বাড়ি। ভাটার স্রোতে ছুটছে নৌকা। পেছনে দড়ি দিয়ে বাঁধা ট্রলার।

পূর্ব পাশের খাল থেকে বের হচ্ছে দস্যুদের বহর। মাঝারি ট্রলারটি সেই অর্থে মজবুত কিছু না। সাধারণ একটি ট্রলার। ভাঙ্গা গলুই, ভেতরটাও অগোছালো। দস্যুনেতা বললো, তালপট্টিতে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো এ ট্রলার। মনে হয় চোরাকারবারীদের। বিএসএফ-এর ধাওয়া খেয়ে পালিয়েছে তারা।

আলিফকে বললাম, সাগরে দস্যুতা করলে মাঝে। এই ট্রলার নিয়ে গেলে সেই অকাজ করতে? ট্রলারের যে অবস্থা, সাগরে চললে কী করে? সে বললো, শীতকাল তো বাবাজি! সাগর এখন পুকুরের মতো ঠান্ডা!

ওরা ভিড়লো সামনে। নোঙর করলো খালের মাঝ বরাবর। নৌকা থাকার কথা একটি। কিন্তু এখন দেখছি তিনটি। কারা ওরা? একজন বললো, ওই হারামিরা!

সকালে যে কাঁকড়ার জেলেদের সাথে দেখা হলো তারাই! মানে পালিয়ে গেলো যারা? বনদস্যুরা বললো, জ্বি ভাই। আসার পথে সামনে পড়ছে। টর্চ দিয়ে ইশারা করে তাদের কাছে আসতে বললাম। নৌকা বেয়ে আসলো তারা, ভিড়লো পাশে।

থরথর করে কাঁপছে ওরা। সেই চারজন কাঁকড়ার জেলে। বললাম, আপনারা এই বিপদ ঘাড়ে টানলেন! আমি বললাম, কাছাকাছি থাকেন। তাও শুনলেন না। এদিকে দস্যুদের একজন তুমুল গালিগালাজ করছে। পারলে মারে! বললাম, এই রাখো তোমরা! কিছু বলবে না ওদের।

রাত বাজে আটটা। চা নাস্তার আয়োজন চলছে। বনদস্যুরা ছুটোছুটি করছে। সদস্যরা কেবল মুখ খুলছে। সারা দিনের গুমোট পরিস্থিতি কেটে গেছে। দস্যুরা সারা দিন চুপচাপ ছিলো। এখন তারাই পাশে এসে বসেছে। অনেক কথা বলছে।

রেজাউলকে নিয়ে অস্বস্তি কেটেছে। সেও এখন হাসছে। কথা বলছে খোলামেলা। জামু ভাই বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে। হঠাৎ করেই সবকিছু উল্টে পাল্টে গেছে। বন উপকূলের এই মানুষদের আমরা গডফাদার বলি। অথচ তারাও জিম্মি বড় সাহেবদের কাছে। দস্যু বাহিনী নামানো, তাদের পরিচালনা করা, দল বদল, নেতা বদলের মতো কাজগুলো এদের দিয়ে করানো হয়। নাম ফোটে জামুদের। মামলা হয়, কখনও এনকাউন্টারেও পড়তে হয়। বিনিময়ে সাময়িক কিছু সুবিধা পায় তারা। তবে দিন শেষে বাড়িতে থাকতে পারে না। চব্বিশ ঘণ্টার দুশ্চিন্তার জীবন থেকে তাও বের হওয়ার পথ খুঁজছে।

বনদস্যুরা সবাই ঘিরে বসেছে। আমি বলছি, ওরা শুনছে। জীবনে ফেরার স্বপ্ন দেখছে তরুণ বনদস্যুরা। এই দলে আব্দুল্লাহ নামে একজন মধ্য বয়স্ক দস্যু আছে। কোনো কথা বলছে না। কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, আপনার মনে কোনো সংশয় আছে? পাশ থেকে একজন বললো, তার বউ দুইজন। সারেন্ডার করে কোন পক্ষের কাছে যাবে তা নিয়ে টেনশনে আছে। বললাম, আপাতত জেলখানায় যাবেন। পরেরটা পরে দেখা যাবে। সবাই হেসে দিলো।

মুড়ি মাখা আসলো। সাথে বড় এক গ্লাস দুধ চা। শীতের রাতে এই জঙ্গলে আর কিছু লাগে না। আর ঘণ্টা দুই পর ফিরতি পথ ধরবো। রাতে আর খাওয়া হবে না। তাই মুড়ি খেয়ে পেট ভরিয়ে নিলাম।

কাঁকড়ার জেলেরা পাশেই বসা। খোল থেকে এক ডালা কাঁকড়া তুলে সামনে রাখলো। বললো, এগুলো বাড়ি নিয়ে যাবেন। বললাম, আমি তো এখন বাড়ি যাবো না। ওগুলো নষ্ট হবে। তার চেয়ে রাখেন আপনারা। বিক্রি করলে কিছু টাকা পাবেন। ওরা নাছোড়বান্দা। বললাম, আজকে কাঁকড়া পাইছেন কেমন? বললো, আল্লাহ কয়টা কাঁকড়া দিলো ভাই! বললাম, তাহলে পালালেন কেন? বললো, ভয়ে পালাইছি। বললাম, তাহলে ধরা পড়লেন কেন? পাশ থেকে আলিফ বললো, আজ না হলেই কাল তো ধরতামই ওদের! বললাম, এই দফায় কেউ কিছু বলবে না। ওরা আমার মেহমান আজ। দস্যুরা বললো, আপনি না থাকলে ওদের যে কী করতাম!

আমি মোবাইল ফোন বের করে গুগল ম্যাপ খুলে ফিরতি পথটা দেখে নিচ্ছি। পাশে পলিন বসা। বললো, আমরা কি রাতেই রওনা দিবো ভাই? বললাম, একটু পরেই নৌকা ছাড়বো। বললো, কাজ করবো না কোনো? বললাম, আজ কোনো ইন্টাভিউ করবো না। সামনের বার এসে একবারে তুলে নিয়ে যাবো। কথা বলতে বলতে গুগল ম্যাপ দেখে লোকেশন বুঝার চেষ্টা করছি।

উসখুস করছে দস্যুনেতা আলিফ। ব্যাগ থেকে নিজের ফোনটা বের করলো। বললো, ম্যাপটা একটু দেখান তো বাপজান! নেটওয়ার্ক নাই। তবে গুগল ম্যাপ কাজ করে। ফোনের জিপিএসটা বন্ধ ছিলো। পলিনকে বললাম, একটু দেখিয়ে দেন তো ভাই।

সহকর্মী পলিনের প্রযুক্তি জ্ঞান খুব ভালো। আলিফের ফোনে জিপিএস অ্যাকটিভনকরে দিলো। সাথে সাথে অফলাইন ম্যাপে দেখালো লোকেশন। বেশ মজার ব্যাপার! ব্রাউজ করে আশপাশের সুন্দরবনটা দেখছে সে। চোখে রাজ্যের বিস্ময়! ম্যাপ নিয়ে দস্যুনেতার আগ্রহ দেখে ভাবছি, কাহিনীটা কী?

ম্যাপ দিয়ে কী করবা তুমি? আলিফ বললো, এই দিয়ে তো ডাইরেক্ট সাগরে যাওয়া যাবে! আবার ফিরাও যাবে। বললাম, যাবে তো। তুমি চাইলে যেকোনো জায়গায় যেতে পারবে। কিন্তু এখন এটা দিয়ে কী করবে? সময় দিবো না। তোমরা রেডি হও। নতুন করে কোনো রকম অকাজ করবে না। খবরদার!

রাত নয়টা বাজে। এখনও ভাটা আছে ঘণ্টা খানেক। আলিফ উসখুস করছে। বললাম, সমস্যা কোথায়? বিদায় নিবে? দস্যুনেতা বললো, এই ভাটিতে নামলে সুবিধা হতো বাপজান! বললাম, অসুবিধা নাই। আমরা এখানেই থাকবো। জোয়ার শুরু হলো রওনা দিবো।

গোছগাছ করে রওনা দিবে আলিফ বাহিনী। বিদায় নেওয়ার সময় শুধু বললাম, সাবধানে থাকবে। রেজাউলসহ সবার সাথে হাত মিলালাম। বললাম, শিগগিরি দেখা হবে। ট্রলারের ইঞ্জিন চালু হলো। গুব্দে খাল ধরে তারা বের হবে মামদো নদীতে। তারপর কোথায় যাবে জানি না।

জামু ভাইসহ আমরা রয়ে গেলাম। শীত বাড়ছে। এভাবে কতোক্ষণ ভাসতে হবে বুঝতে পারছি না। কাঁকড়ার জেলেরা বললো, এখানে রাতের বেলা থাকা ঠিক হবে না। খালের আগায় যেতে হবে। বললাম, কেন? জামু ভাই বললো, এক ডাকাত গেলো। এখন অন্য দস্যুদল চলে আসলে ঝামেলায় পড়বো ভাই। বিশেষ করে জোনাবকে নিয়ে ঝামেলা বেশি। ও কথায় কথায় গুলি করে।

আসুক না হয়। লোকটার সাথে দেখা হয়নি। তবে ফোনে কথা হয়েছে। বেশ ভারী গলা। শুনেছি, পুরনো দস্যুদের মধ্যে এই একজনই বেঁচে আছে। কতোবার গুলি খেয়েছে তার হিসাব নাই। মার খেয়ে উঠে যায়। কিছুদিন পর আবার ফিরে আসে। লোকে বলে, বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে এই দস্যুনেতার বসবাস।

জোনাব নাকী এদিকেই আছে। কাঁকড়ার জেলেদের বললাম, আপনারা চলে যান। নিরাপদ জায়গায় গিয়ে থাকেন। যাওয়ার সময় কাঁকড়াগুলো নিয়ে যান। ভবিষ্যতে দেখা হলে আবার চেয়ে নিবো। ওরা চলে গেলো। বললো, প্রথম জোয়ারে আবার দাওন টানবে পাশের কোনো খালে। তারপর কোনো সরু খালের আগায় উঠে নিজেদের আড়াল করবে। বৈঠা বেয়ে চললো ওরা। মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে।

আমরা কি এখানেই থাকবো? সাথের মাঝিরা বললো, মরা গোন চলে। স্রোত নাই। চাইলে রওনা দিতে পারি। জামু ভাই বললো, নৌকা ছাড়ো। জিনিষপত্র গুছিয়ে ছইয়ের ভেতরে বসলাম। রওনা হলাম ডাঙ্গার দিকে।

গুব্দে আর শোব্দে খালের সংযোগস্থলটা দারুণ! সাথেই মামদো নদী। উল্টো পাশের জঙ্গল পার হলেই রায়মঙ্গল। ওই নদীর অর্ধেক বাংলাদেশে, বাকী অর্ধেক ভারত। ওদিকে বুড়ির ডাবড়ী নামে একটি খাল আছে। শুনেছি সেখানকার ফরেস্ট অফিসে পর্যটকরা ঘুরতে আসে। বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের এদিকটায় পর্যটকদের বেড়ানোর সুযোগ নাই। সীমান্ত নদী হওয়ায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তৎপরতা আছে। চোরাকারবারীদের তৎপরতাও আছে পুরো অঞ্চল জুড়ে। এদিকের বনদস্যুদের কেউ কেউ ব্ল্যাকের সাথেও জড়িত।

নৌকা ছাড়লো। খাল থেকে বের হলাম। মামদো নদীতে উঠতেই একটু ঢেউয়ের মুখে পড়লাম। কোনো রকমে সামলে নিলাম। নদীর উল্টো পাশ দিয়ে যাওয়ার কথা আমাদের। কিন্তু নদীর যে অবস্থা! ডান পাশ ধরে ধীরে ধীরে চলছি আমরা। জানতে চাইলাম, সময় লাগবে কতোক্ষণ? মাঝি বললো, ঘণ্টা তিন তো লাগবেই। বললাম, মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পাবো কখন? জামু বললেন, ঘণ্টা খানেকের মধ্যে।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারি না। ঘুম ভাঙলো জামু ভাইয়ের কথায়। ফোনে কার সাথে জানি কথা বলছে। উঠো বসলাম। পকেট থেকে ফোন বের করলাম। ড্রাইভারকে ফোন দিতে হবে। বাসায়ও একটু কথা বলা দরকার।

ফোন খুলতেই দেখি অনেকগুলো মিসড কল অ্যালার্ট! অনেকেই খোঁজ করেছে। তার মধ্যে দস্যুনেতা জাহাঙ্গীরের নাম্বার থেকে কল এসেছে পঞ্চাশ বারেরও বেশি! ঘটনা কী? জাহাঙ্গীর কেন আমাকে খুঁজছে? এই রাতে তাকে পাওয়ার কথা না। তবুও ফিরতি কল করলাম। ফোন ধরলো জাহাঙ্গীর। হাউমাউ করে কান্না করছে ভয়ঙ্কর ওই দস্যুনেতা!

(২৫ জানুয়ারি ২০১৭, মধ্যরাত, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top