ময়না বললো- “আমিও যাবো” | রূপান্তরের গল্প ৩৮৬ | Rupantorer Golpo 386 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৮৬ : নৌকা থেকে এক লাফ। ট্রলারে উঠেই এগিয়ে আসলো জাহঙ্গীর। অন্ধকারে শুধু মানুষটাকে দেখছি। বুকের ভেতরে ড্রাম পিটাচ্ছে কেউ। মুহুর্তের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে সব। সরে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু নড়তে পারছি না। শীতের রাত। ঠকঠক করে কাঁপছি। শীত, ভয় আর উত্তেজনায় একদম কাঠ হয়ে গেছি। ভয়ঙ্কর সেই দস্যুনেতা আমার সামনে। হঠাৎ করে ঝুঁকে পড়লো। বসে পড়লো সামনে। তারপর…
ভাবছি আমার সাথে খুব খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সময় নাই। তার আগেই পায়ের সামনে বসে পড়লো জাহাঙ্গীর। ভাবছি পায়ের কাছে করছে কী সে? টান দিয়ে নিয়ে যাবে না তো?
ভুল ভাঙলো। দেখি পা ছুঁয়ে সালাম করছে জাহাঙ্গীর। কান্না ভরা কণ্ঠে শুধু বলছে, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন ভাই। অনেক বেয়াদবী করছি। আপনার অনেক বদনাম করছি। তার শাস্তিও পাইছি ভাই।
পেছনে ফিরে নৌকায় দাঁড়ানো দস্যুদের ডাক দিলো জাহাঙ্গীর। বললো, এই তোমরা আসো না কেন? উপরে উঠে আসো। ভাই আসছে, সালাম করো। সবাই শোনো, আজ থেকে আমাদের নতুন জীবন শুরু হলো।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কথাটি বইয়ে পড়েছি অনেক বার। কিন্তু বাস্তবে হাঁফ ছাড়া, বেঁচে থাকা, এসবের অনুভূতি লিখে প্রকাশ করা যায় না। কয়েক মুহুর্তপাহাড় সমান দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে তা কাটলো। মনে হচ্ছে মাথার উপর থেকে বিশাল পাথর নেমে গেলো। বুকের ভেতরের আতঙ্কের ধকধকানি পরিণত হলো আনন্দের হার্ট-বিটে। কাঁধে পলিনের হাতটি ভরসা যুগিয়েছে। আমরা হাত মিলালাম, বুক মিলালাম। চলছে কুশল বিনিময়।
আদাচাইয়ের ভাড়ানীতে আমরা। সুন্দরবনের ঝুঁকিপূর্ণ খালগুলোর একটি। কতো বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে! কতো মানুষের রক্ত ঝরেছে। গুলিতে প্রাণ গেছে কতো জনের তার হিসাব নাই। সেই খালেই আমরা। সামনে দুর্ধর্ষ দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর। আজ অবশ্য ভিন্ন চেহারায় সামনে এসেছে বনদস্যুরা।
কুশল বিনিময় হচ্ছে। গলুইয়ে গাদাগাদি করে দাঁড়ানো সবাই। দস্যুরা হাত মিলাচ্ছে, বুক মিলাচ্ছে। জড়িয়ে ধরা শরীরগুলো কাঁপছে থরথর করে। বন্দুকের নল-বাঁট, কারও গুলির পোসেসগুলো স্পর্শ করছে। বন্দুকের ধাতব অংশটুকু বরফের মতো ঠান্ডা। আমি ধাতস্ত হচ্ছি ধীরে ধীরে।
দস্যুনেতা উসখুস করছে। তার কারণও জানি। ইচ্ছা করে একটু সময় নিচ্ছি। জাহাঙ্গীর কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। থামিয়ে দিয়ে বললাম, আরে ভাই দাঁড়ান! এতো তাড়া কীসের? সমস্যা কোথায়? হাসি দিয়ে সে বললো, আমার ভাইয়ের কাছে আমার পরিবার নিরাপদ। টেনশন করি না।
পেছনে ঘুরে বেলায়েত সর্দারকে বললাম, এদিকের আলোটা জ্বালিয়ে দেন ভাই। নাটা জাহাঙ্গীরের চেহারাটা দেখি। আগে সিওর হয়ে নেই। এই লোক তো জাহাঙ্গীর নাও হতে পারে। বনদস্যুরা হাসছে।
আলো জ্বললো। এবার পরিস্কার দেখছি। নতুন, চকচকে শর্টগান হাতে দাঁড়ানো জাহাঙ্গীর। অন্যদের হাতেও ভালো ভালো সব অস্ত্র। তবে একটু আগে যে টানটান অবস্থা ছিলো তা কেটেছে। বন্দুক ধরে থাকা শক্ত হাতগুলো এখন শিথিল। কেউ কেউ কাঁধে ঝুলিয়েছে। কেউ আবার হাতের বন্দুক নামিয়ে রাখলো নিচে। এই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করতে হয়। কারণ আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত না করে পরের ধাপে আগানো যাবে না। মিনিট পাঁচ এর মধ্যে পরিস্থিতি পুরোপুরি আমার নিয়ন্ত্রণে আসলো। কেটে গেলো দুই দিন ধরে চলা শংকা, ভয় আর দুশ্চিন্তা। চিৎকার করে বললাম, ও সর্দার, আমাদের ভাবীকে বের করেন, এদিকে পাঠায়ে দেন।
দস্যুনেতার শক্ত চোঁয়ালে পরিবর্তন আসছে। আমি এসব খেয়াল করি, খেয়াল করতে হয়। একই সাথে সশস্ত্র অন্য দস্যুরাও আস্থার মধ্যে আছে কী না তাই খেয়াল করি। কারণ দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্য যেকোনো বন্দুকের একটি গুলিই যথেষ্ট। বনদস্যুদের এই দুনিয়ায় কাউকে বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করার অভিনয় করি। অন্য সময় এসব খেয়াল করার সময় পাই। আজ সবকিছু ঘটছে একসাথে। এতোক্ষণে আমার সহকর্মীরা সবাই বের হয়েছেন।
কেবিন থেকে বের হলো ময়না। আগে থেকেই বলা ছিলো। সেভাবে তাকে নিয়ে এগিয়ে আসলেন বেলায়েত সর্দার। আমি সরে একটু জায়গা করে দিলাম। জাহাঙ্গীর ছুটে গেলো। জড়িয়ে ধরলো ময়নাকে। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। হাউ মাউ করে কাঁদছে সে। বলছে, হায় রে আমার কতো সুন্দর বউ! একটুর জন্য বেঁচে গেছো! আমার ভাই না থাকলে কতো কিছু হয়ে যেতো! ময়না তাকে সান্তনা দিচ্ছে।
আমার ইয়াসিন কোথায়? দস্যুনেতা তার সন্তানকে খুঁজছে। বলছে, বাকীরা কোথায়? এটা আরেকটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার। উত্তেজনায় ভুলেই গেছিলাম। কথা ছিলো, পরিবারের সবাইকে নিয়ে আসবো। কিন্তু কৌশলগত কারণে তাদের আনিনি। এমন কী বাচ্চাটাকেও রেখে এসেছি যাতে অন্য কোনো পরিকল্পনা করতে না পারে!
বললাম, ও ভাই, বাচ্চাটাকে আর কতো কষ্ট দিবেন? ওকে নানীর কাছে রেখে আসছি। ওই ভদ্রার গোঁড়ায় অফিসের সামনে মেজর আদনানরা আছে। ইয়াসিন ওখানেই আছে, নিরাপদে আছে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো জাহাঙ্গীর। থামিয়ে দিলো ময়না। বললো, আমি তো আসছি। এতো চিন্তা করো কেন? জাহাঙ্গীর বলে, ওকে একটু দেখবো না? ময়না বললো, ফিরেই তো দেখবে। এখন চলো, গোছগাছ করো। সারেন্ডার করতে হবে। অনেক কাজ।
পুরো পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। দস্যুনেতাকে বললাম, আমাদের নেওয়ার জন্য তো আপনার আসার কথা ছিলো না। অন্য টিম আসবে জানতাম। সে বললো, মনকে মানাতে পারিনি ভাই। বললাম, আপনার ট্রলারটা কোথায়? বাকীরা কোথায়? অস্ত্র আর গুলি সব সাথে আছে তো? গোছগাছ করতে হবে। রওনা দিতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। দুপুরে অনুষ্ঠান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার কি আসবে ভাই? কোথায় হবে অনুষ্ঠান? বললাম, বরিশালে। মন্ত্রী আসবেন। আজকেই আপনারা অস্ত্র জমা দিবেন। আত্মসমর্পণ করে সোজা থানায় যাবেন, সেখান থেকে যাবেন জেলখানায়। চলেন, রওনা দেই।
ট্রলারের ইঞ্জিন চলছে। স্রোতে ভাসতে ভাসতে এক পাশের জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আমাদের ক্যাপ্টেন বেলায়েত সর্দার গেলেন সুকানিতে। দস্যুদের নৌকাটি বাঁধা হলো ট্রলারের সাথে। সবাই মিলে ধাক্কা দিয়ে সরানো হলো ট্রলার।
জানতে চাইলাম, কোন দিকে যাবো? আপনাদের ট্রলার কোথায়? জাহাঙ্গীর বললো, ঘুরায়ে ফেলেন। আমরা ট্রলার ঘুরিয়ে রওনা দিলাম। যে পথে এসেছি সে পথেই ফিরছি। আদাচাই এর ভাড়ানী শেষ করে পৌঁছে গেলাম ভদ্রা নদীতে। ওখান থেকে ডান পাশের একটি খালে ঢুকলাম। ওই পথ ধরে ছুটলো ট্রলার।
এই খালটির নাম জানি না। তবে বুঝতে পারছি অনেক জায়গায় যাওয়া যাবে এ পথ ধরে। দস্যুদের জিজ্ঞেস করলাম, ট্রলার ওই পর্যন্ত যাবে? একজন বললো, খাল এখানে একটু ছোট। তবে সামনের দিকে বড়। কোথায় ঠেকবে না।
প্রায় আধা ঘণ্টা চললাম। এরপর ডান পাশের একটি ছোট্ট খালে ঢুকতে বললো ওরা। মুখের দিকটা সরু। তবে একটু পরেই খালটা বেশ প্রশস্ত। ওই তো দেখা যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর বাহিনীর ট্রলারটি আছে, পাশে বেশ কয়েকটি জেলে নৌকা।
ভোর সাড়ে চারটার মতো বাজে। ট্রলার ভিড়লো দস্যুদের ট্রলারের পাশে। এখনও চারপাশ অন্ধকার। দুই ট্রলারের সবগুলো আলো জ্বালানো হলো। আমি গিয়ে উঠলাম বনদস্যুদের ট্রলারে। প্রত্যকের সাথে হাত আর বুক মিলালাম। বুঝতে পারছি মহা দুশ্চিন্তায় তারা। প্রত্যেকেই কাঁপছে। চেহারা মলিন, আতংকে ঠাসা চোখগুলো।
এই বনদস্যুরা প্রায় সকলেই আমার পরিচিত। রাজু বাহিনী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলে দস্যুতা করেছে তারা। রামপালের মারুফ, কিস্তেন ফরিদ, বাছেরসহ সবাইকেই চিনি। ওরাও আমাকে চেনে খুব ভালো করে। বুক মিলাতে মিলাতে বললাম, এতো বড় বড় ডাকাত সব। কাঁপাকাঁপি করলে চলবে? বাছের বললো, কয়দিন যা গেলো মামা! মনে হলো আর বাঁচবো না। ভাগ্যিস আপনি আসছেন। দলের মধ্যে যে অবস্থা চলছিলো তাতে আর একদিন পর কী হতো বলাম মুশকিল!
বললাম, সারা রাত না খাওয়া। চা জ্বালান। সর্দার বললেন, চা কি আমরা বানাবো না ওরা বানাবে? বললাম, আমাদের বানানো ঠিক হবে? আমরা মেহমান না? সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলো জাহাঙ্গীর। বললো, এই শোনো সবাই। আমাদের ভাই আসছে। রান্না চড়াও। বললাম, এখন আবার কীসের রান্না? চা বানাতে বলেন। হাল্কা নাস্তা করে আমরা রওনা দিবো।
ট্রলারের এক কোণায় দাঁড়ানো জাহাঙ্গীর আর ময়না। এই পরিবেশেও মনের আনন্দে প্রেম করছে তারা। বললাম, উপরে চলেন। তারপর তো এক ঘরেই থাকবেন! জাহাঙ্গীর বলে, আগে তো জেলখানায় যেতে হবে ভাই। বললাম, তারপর তো ফিরবেন!
দস্যুনেতাকে বললাম, খালের গোঁড়ায় কোনো পাহাড়া আছে? না থাকলে একটা নৌকা পাঠান। এতো রিল্যাক্স থাকার কোনো কারণ নাই। অন্য কোনো বাহিনী আসলে আবার দৌড়াতে হবে। সাথে সাথে তিনজন বনদস্যু রওনা দিলো।
ফিরে আসলাম ট্রলারে। জাহাঙ্গীর আর ময়নার পাশে বসলাম। বললাম, গোছগাছ করে নেন। বললো, সবকিছু রেডি ভাই। বললাম, বন্দুক আর গুলিগুলো সব কাছে আছে? কোথাও কিছু চাপানো নাই? জাহাঙ্গীর বলে, না ভাই। বললাম, ভালো করে ভেবে বলেন। একটা গুলিও জঙ্গলে রেখে যাওয়া যাবে না কিন্তু! বলেই তাকালাম, ময়নার দিকে। বললাম, এই হিসাব না মিললে কিন্তু আমি নাই। এখান থেকেই ফিরে যাবো। সারেন্ডার আমি করাবো না।
ময়না বললো, আমি দেখছি ভাই। আপনি চা খান। চোখ দিয়ে ইশারা করলো। উঠে পড়লাম। অন্যদের সাথে গল্পে বসলাম। একটু দূরে বসলেও নজর আমার ওদের দিকে। একটু পর উঠে আসলো জাহাঙ্গীর। বললো, কোনো রকম গ্যাপ রাখবো না ভাই। বললাম, বৌয়ের ঠেলা বলে কথা। লুকানো অস্ত্র কি এমনি বের হয়? জাহাঙ্গীর হাসছে। পেছন থেকে তার স্ত্রী ময়না বললো, আমি থাকতে কোনো টেনশন নাই ভাই। অস্ত্র সব জমা না দিলে ওকে আস্ত রাখবো না!
অস্ত্রগুলো চাপানো আছে কোথায়? এখান থেকে কতো দূরে? জাহাঙ্গীর বললো, কাছেই ভাই। যেতে আসতে দুই ঘণ্টা। বললাম, আপনি যাবেন না লোক পাঠাবেন? বললো, ওখানে আমাকেই যেতে হবে ভাই। বললাম, চলেন, আমিও যাবো। ময়না বললো, আমিও যাবো ভাই!
(২৯ জানুয়ারি ২০১৭, সুন্দরবন)