ঝাইলো থেকে হংসরাজ, কেটে গেলো সারা রাত | রূপান্তরের গল্প ২৮ | Rupantorer Golpo 28 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৮ : সঙ্গীদের ভিতরে যেতে বললাম। ইঞ্জিন রুমে ফারুক ভাই। বিকালে ট্রলার সারাইয়ের সময় এক্সহস্ট পাইপে পিঠ পুড়েছে তার। তবুও তাকেই চালু করতে হবে ইঞ্জিন। সুকানিতে বেলায়েত সরদার। তখনকার ট্রলারের হালটি ছিলো ছাদের ওপর। আমি আর বেলায়েত সরদার সেখানে বসা। বনদস্যুদের ট্রলার বহর রওনা দিয়েছে পশ্চিমে।
আমাদের ট্রলার চললো পূর্ব দিকে। সম্ভবত পঞ্চমী বা ষষ্ঠীর চাঁদ। শীতের রাত। জমাট বাঁধা কুয়াশা ছেয়ে আছে চারপাশ। ঝাইলোর খালটি সেখানে বেশ প্রশস্ত। তবে আমরা যাবো আগার দিকে। সরু হতে থাকবে খাল।
পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। চালু করতে একটা নোটিফিকেশন আসলো। কেইশ মেমোরি পরিস্কার করতে বলছে। ওকে বাটনে চাপ দিলাম। কেইশ মেমোরি ক্লিয়ার! সুন্দরবনের ওদিকটায় তখন কোনো অপারেটরের নেটওয়ার্ক নাই।
ট্রলার এগুচ্ছে। আমরা দু’জন নিচু স্বরে কথা বলতে বলতে এগুচ্ছি। সরদার এদিকে আগে আসেননি। ফলে পথ চিনে বের হওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। দায়িত্ব আমার ঘাড়েই। বললাম চিন্তা নাই। গুগল ম্যাপ আছে! ফোন বের করে ম্যাপস অ্যাপটি খুললাম। সবকিছু সাদা। অফলাইনে ম্যাপ নাই। সাদার ওপর শুধু আমাদের লোকেশন দেখাচ্ছে! কী সর্বনাশ! করলাম কী আমি? কেইশ মেমোরি মুছে দেয়ার আগে একবারও ভাবলাম না?
কাউকে কিছু বললাম না। সমানে পকেট হাতড়াতে শুরু করলাম। এই পকেট ওই পকেট করে পেলাম সেই ছোট্ট কাগজ। দস্যু সোহাগের হাতে আঁকা সেই ম্যাপ। মানচিত্র বা ম্যাপিং যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেবার বুঝলাম। মুহুর্তেই সহজ একটি পথ জটিল ও কঠিন হয়ে পড়লো। তার সঙ্গে যোগ হলো ভারী কুয়াশা।
বেলায়েত সরদারের চোখে সমস্যা। রাতে ভালো দেখেন না। বললাম গতি কমিয়ে খালের একপাশ ধরে এগুতে থাকেন। আমি ম্যাপটা ভালো করে দেখে নেই। মোবাইল ফোনের আলোতে চিরকুটের ওপর আঁকানো সেই মানচিত্রটি বুঝতে শুরু করলাম। হাতে সময় নাই। এই রাতে বের হতে না পারলে বড় ঝামেলায় পড়তে হবে।
মানচিত্র ধরে এগুতে থাকলাম। ট্রলারের কেউই ভিতরের খালগুলো চিনে না। তাই মাথা ঠান্ডা করে বসলাম সুকানির পাশে। সামনে একটা দোঢালা পড়লো। বাম পাশের খালে ঢুকলাম। খাল আরও সরু হচ্ছে। সরদার বললেন ভুল খালে ঢুকেছি আমরা। বললাম আরেকটু আগাই।
এ পথে ট্রলার চলে না। ভাড়ানীগুলো মূলত ছোট নৌকার পথ। তবুও ঝুঁকি নিতে হবে। আনুমানিক ২০ মিনিট যাওয়ার পর একটা বাইন গাছে ধাক্বা খেলাম। ট্রলারের একপাশে কিছু অংশ ভেঙ্গে গেলো। সরদার ব্যাক গিয়ারে রেখে ট্রলার সরালেন। তারপর বাম পাশ ঘেঁসে এগুতে থাকলেন। আমি তখন বেশ হতাশ। কিন্তু সরদার তখন আশাবাদী। বললেন, সামনে খাল চওড়া হচ্ছে।
আরো দশ মিনিট এগুতেই বড় একটা দোয়ায় এসে পড়লাম। দোয়া মানে কয়েকটি খালের মিলনস্থল। এবার টর্চ জ্বালিয়ে দেখি সাতটি খাল মিশেছে এখানে। তার মানে এটাই শতমুখী। ম্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে নিলাম আবার। এবার সোহাগের দেখিয়ে দেওয়া খালে ঢুকে পড়লাম। প্রায় এক ঘন্টা চললো ট্রলার। রাতের আলো বিদায় নিচ্ছে। আমরা উঠলাম বড় নদীতে। তার মানে হংসরাজ। খুলনা রেঞ্জ এর সুন্দরবনের বেশ খরস্রোতা নদী। পশুর নদী আর আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে এ নদী। মাঝের বড় ছোট খাল আর ভাড়ানী দিয়ে যাওয়া যায় পূর্ব থেকে পশ্চিমে, আসাও যায়।
ভাটা তখন শেষের দিকে। ছইয়ের ভিতরে সহযাত্রীরা। বেলায়েত সরদারও ঘুম। সুকানি হাতে আমি। ভাটার স্রোত আর ইঞ্জিনের গতি মিলিয়ে বেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ট্রলার। পশুর নদীতে উঠতে পারলেই আপাতত চিন্তামুক্ত হই। ট্রলারে আমি ছাড়া সবাই গভীর ঘুমে।
(ছবিটি সেই সকালের। হংসরাজ নদীতে উঠেছি মাত্র। সরদারের হাতের ক্লিক)