রূপান্তরের গল্প ৩০ | Rupantorer Golpo 30

পথ ভুলে সাগরে চলে গেছি! | রূপান্তরের গল্প ৩০

পথ ভুলে সাগরে চলে গেছি! | রূপান্তরের গল্প ৩০ | Rupantorer Golpo 30 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩০ : গভীর ঘুমে আমি। কিন্তু ট্রলারের ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। শুনছি বাতাসের শব্দ। কান খোলা রেখে ঘুম দিচ্ছি। শেষ নভেম্বরে বেশ শীত পড়ে। রীতিমতো ঠকঠক করে কাঁপছি। শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। সকালে কিছু খাওয়া হয়নি। শরীরটা অবসাদে ভরা। উত্তরা বাতাসে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম। বেলায়েত সরদার ট্রলারের ভিতরে যেতে বললেন। কিন্তু উঠে ছই পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি ছিলো না। আবার পথ ভুল না করি সেবিষয়টাও মাথায় ছিলো। সরদার একটা কাঁথা নিয়ে আসলেন। ঢেকে দিলেন আমাকে। বেশ আরাম পাচ্ছিলাম। মাথার উপর কাঁথাটা টেনে নিয়ে ঘুম দিলাম। একটানা চলছে ট্রলার। সুকানিতে বেলায়েত সরদার। ভাবলাম মংলা পর্যন্ত পুরোটা পথ ঘুম দিয়ে কাটাবো।

আযানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। এতো তাড়াতাড়ি লোকালয়ে চলে আসলাম? লাফ দিয়ে উঠলাম। চারপাশে পানি আর পানি। কুয়াশা কাটেনি। এসময় আমাদের বড়জোর চরাপুটিয়ায় থাকার কথা। সেখানে আযানের শব্দ পাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। আরও তিন ঘন্টার পথ পেরুলে মংলার প্রথম জনপদ জয়মনিরঘোল। কিন্তু চারপাশে লোকালয়ের কোনো আলামত নাই। অথচ আযান হচ্ছে। ফজরের আযান। তাহলে কি দিক হারিয়ে ফেললাম?

ঘুম থেকে উঠে দেখি ট্রলারের ভিতর থেকে ফারুক ভাই আর সুজন বেরিয়ে এসেছে। বেলায়েত সরদারের চোখ ভর্তি ঘুম। তিনজনে মিলে আমাদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছেন। কুল কিনারা নাই, আমার ফোনের ম্যাপও কাজ করছে না। এবার মাথা খাটানোর পালা। কারণ কুয়াশার জন্য বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না।

আযান আসছে আমাদের বাম পাশ থেকে। মংলার দিকে গেলে লোকালয় পড়বে ডানদিকে। বুঝলাম, আমরা উল্টোদিকে চলে এসেছি। অর্থাৎ দক্ষিণে। আমরা সাগরে চলে এসেছি। আর আযানের শব্দ আসছে দুবলার চর থেকে।

ট্রলারের আহ্নি ঘুরালাম। এবার আযানের শব্দ যেদিক থেকে আসছে সেদিকে যাত্রা শুরু। মানে সেই দুবলার চরেই ফিরছি আমরা। উত্তরে যেতে যেতে কখন ট্রলার উল্টোদিকে ঘুরে গেছে বেলায়েত সরদার সেটা বুঝতে পারেননি। ঘুমের ঘোরে ঘটেছে ঘটনাটি। আমি বললাম ভালোই হলো। সকালের নাস্তাটা তাহলে দুবলার চরে হবে।

মরণ চরে নোঙ্গর করবো ট্রলার। সেখানে দুটি দোকান আছে। তারা সকালের নাস্তা করে। পলিন ও রাজীবের ঘুম ভেঙ্গেছে এরই মধ্যে। সবাই মিলে নেমে পড়লাম দুবলার চরে। তখন সকাল ৭টার মত বাজে। আমাদের সবারই সারা গায়ে কাঁদা। শার্ট প্যান্টের কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। শরীরের এখানে সেখানে কাটাছেঁড়া। দুবলার চরের আলোর কোলের জেলেরা আমাদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। আমাদের এই হাল কেন? অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু তার জবাব তখন দেইনি। সোজা নাস্তা করতে বসলাম। তারপর চা খেয়ে একটু বাজার সদা করে নিলাম। এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। দ্রুত ট্রলারে ফিরলাম। দিনের আলোয় ধরলাম মংলার পথ।

পশুর নদীর মোহনা থেকে মংলা পর্যন্ত আমাদের নৌপথের দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার। পথে রান্না হলো। ডাঙ্গায় ফিরলাম গভীর রাতে। সঙ্গে ডাকসাইটে এক দস্যুদলের আত্মসমর্পণের আবেদন।

(ছবিটি ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসের। পথ ভুলে সাগরে গেছি। সেখান থেকে আবার ফিরেছিলাম দুবলার চরে)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top