রূপান্তরের গল্প ৫৮ | Rupantorer Golpo 58

পিছনে বিপদ, সামনেও বিপদ! | রূপান্তরের গল্প ৫৮

পিছনে বিপদ, সামনেও বিপদ! | রূপান্তরের গল্প ৫৮ | Rupantorer Golpo 58 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৫৮ : এক কাপ দুধ চা-এর জন্য কতোক্ষণ অপেক্ষা করা যায়? তারপরও ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যেই চা জ্বালানো হলো। চা বানাতে গিয়ে মামুনকে সরদারের বকা খেতে হলো। ঘন্টা দুই নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে চলার পর হাতে আসলো চা। ভাবছিলাম যে সামনে আর তেমন কোনো ঝামেলা হবে না। হাড়বাড়ীয়া বন টহল ফাঁড়ী থেকে সাধারণত ট্রলার আটকানো হয় না। এই টহল ফাঁড়ীটি একটি পর্যটন কেন্দ্র। বনকর্মীদের সেই দিকটা সামাল দিতে দিতেই দিন পার হয়ে যায়।

হাড়বাড়ীয়ার কাছাকাছি মাঝ পশুরে বড় বড় জাহাজ নোঙ্গর করা থাকে। লাইটারেজ জাহাজ বা কার্গোতে মালামাল লোড আর আনলোডের কাজ চলে ২৪ ঘন্টা। এছাড়া মংলা থেকে ট্রলার ও স্পিডবোট আসে এখানে। জাহাজগুলোর সঙ্গে নানা রকম ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে যাদের তাঁরা আসা-যাওয়া করেন। কখনও জাহাজের দেশি-বিদেশি কর্মীরাও লোকালয়ে যান। এছাড়া লোকালয় থেকে জাহাজে বাজার সরবরাহ করতে আসে ট্রলার। কিছু ট্রলার তো পুরো কাঁচা বাজার সাজিয়ে নিয়ে ফেরি করে বেড়ায়। সব মিলিয়ে মংলা থেকে হাড়বাড়ীয়া পেরিয়ে ভদ্রা নদীর আগ পর্যন্ত রাতেও প্রচুর নৌযান চলাফেরা করে। কার্গো, বাণিজ্যিক জাহাজ, বন্দরের জাহাজ, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীর জাহাজ ও মৌসুম ভেদে পর্যটকবাহী লঞ্চগুলো চলে। আমাদের মতো চোরের মতো চলাফেরা করা ট্রলারগুলো এই ব্যাস্ত পরিবেশের সুযোগ নেয়, আমরাও সেই সুযোগের ব্যবহার করেছি সময় সময়।

সেই রাতেও ভেবেছিলাম পার হয়ে যাবো। কিন্তু মাঝ নদীতে ইলিশ ধরার জাল বিছানো এমাথা-ওমাথা। তাই পশুর নদীর পূর্ব পাশ দিয়ে বন ঘেঁষে যাচ্ছিলাম আমরা। লুকিয়ে চলাফেরার জন্য একদম বন ঘেঁষে চলাটাও এক ধরনের কৌশল। সেই কৌশল সম্পর্কে শিখেছি পরে। বেলায়েত সরদার বলছিলেন যে বাদা’র গা ঘেঁষে গেলে দূর থেকে আমাদের কেউ দেখতে পাবে না।

ডেক-এ বসে চা হাতে নিয়ে ভাবছিলাম আকাশ পাতাল। এর মধ্যে নতুন বিপদ, হাড়বাড়ীয়ার ফরেস্টারদের সিগন্যাল! চিৎকার করে মামুনকে বললাম সামনে যেতে। আয়েশের সময় শেষ। হাতের পাশের দড়িটা ধরে টান দিলেন সরদার। গতি বাড়ানো হলো। হুট করেই ঘুরে গেলো আমাদের ট্রলার। আবারো শুরু হলো চোর-পুলিশ খেলা!

রাত তখন তিনটার মতো বাজে। হঠাৎ করে বড় ঝামেলায় পড়ে গেলাম। বন বিভাগের তাড়া খাওয়াটা ভালো কিছু না। বড় বিপদও হয়ে যেতে পারে। অপরাধীদের নৌযান ভেবে ওদিক থেকে গুলি করলে কতো কিছুই ঘটে যেতে পারে! হাড়বাড়ীয়া বন বিভাগের ট্রলারের ইঞ্জিন চালু হলো। সরদারকে বললাম, গুলি করলে কী হবে? বন বিভাগ কী এরকম সময় গুলি করে? সরদার বললেন, তাদের হাতে বন্দুক-রাইফেল কি এমনি এমনি দিছে সরকার? গুলি তো করতেই পারে। কিন্তু আমাদেরকে পাইলে তো! বললাম, গুলি তো দূর থেকেই করে। সরদার বললেন, আমরা তাদের গুলির রেঞ্জ এর বাইরে চলে যাবো।

ততোক্ষণে আমরা মুখ ঘুরিয়ে মাঝ নদীর দিকে যাচ্ছি। মাঝ নদীতে আবার ইলিশের জাল। পুরো নদীতে ভাসছে জ্বলন্ত টেমি (কোরোসিনের বাতি)। পিছনে বন বিভাগ ছুটছে, সামনে এলোমেলো ভাবে ফেলা জালের ফাঁদ। যদি প্রপেলারে আটকে যায় তবে রেহাই নাই, ধরা পড়ে যেতে হবে। এবার ধরা পড়লে আর যাই হোক রাতটা নষ্ট হবে, আমাদের সুন্দরবনে যাওয়ার গোপন বিষয়টিও জেনে যাবে সবাই! দস্যু আত্মসসর্পণের প্রথম চেষ্টাটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে! এসব দুশ্চিন্তা করতে করতে বিশাল এক ঢেউ ধাক্কা দেয় পাশ থেকে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন ক্যাপ্টেন বেলায়েত। আমার হাত থেকে পড়ে যায় চা-এর কাপ। একটা চুমুকও দিতে পারিনি!

বেলায়েত সরদারের হাসিটা ছিলো তখন দেখার মতো। চিৎকার করে বলছিলেন- ও ভাই, আগে বাঁচি তো! তারপরে চা খাবেন। ট্রলারেে গতি নিয়ন্ত্রণের দড়িটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন টান করে ধরে রাখেন! এভাবে প্রায় ২০ মিনিট চললাম। মাঝ নদীতে আসতে হঠাৎ থেমে গেলো ট্রলার। যে আশঙ্কা করেছিলাম তাই হলো! ধরা পড়েই গেলাম তাহলে?

(ছবিটি সেই সময়ের, তবে ওই সফরের নয়। তখন বেলায়েত সরদারের ট্রলারটিছিলো বেশ ছোট) 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top