ফরেস্ট অফিস থেকে বের হলো দস্যুনেতাদের স্ত্রী-সন্তান | রূপান্তরের গল্প ৬৫ | Rupantorer Golpo 65 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৬৫ : ও মাস্টার! কী খবর? মাস্টারের মুখে হাসি। অরেক দিন পর দস্যুনেতার মুখে হাসি দেখলাম। এর আগে দুই দফা দেখা হয়েছে। তখন দলের ভিতরে গ্রুপিং ছিলো। আর সেকারণে আমারও বেশ দুশ্চিন্তা গেছে। শহরে বসে থাকা গডফাদাররা কিছুতেই তাদের সারেন্ডার করতে দিতে চায় না। সেজন্য কাউকে মেরে ফেলতেও তাদের কোনো কিছুতে বাধতো না। নিজের হাতে তো আর এসব করতো না তারা। একজনকে দিয়ে আরেকজনকে হত্যা করাতো। নিজেদের কর্তৃত্ব আর টাকার জোগান চালু রাখতে ঘরে বসে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে ওস্তাদ ছিলো তারা। সারেন্ডার করবে জেনে সেই খেলা শুরু হয়েছিলো আমার করা প্রথম সংবাদটি দেখার পর থেকে। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্রের কথা জেনে ফেলি আমি। সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনলে মাস্টার বাহিনীতে অভন্তরীণ সংঘর্ষ ঘটে যেতো। হয়তো মাস্টারকে আর পেতাম না। হয়তো সারেন্ডার ভেস্তে যেতো!
ট্রলার থেকে নামছি আর ভাবছি অতীতের কথাগুলো। এরই মধ্যে ফরেস্ট অফিসের ভিতর থেকে বের হলো সোহাগ আকন ও মোস্তফা শেখ। ভাবী, বাচ্চারা কোথায়? মাস্টার বললো, অফিসের ভিতরে। দুই দিন আগে মাস্টার ও সোহাগের পরিবারের সদস্যরা এসেছে তাদের কাছে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দস্যুনেতাদের পরিবারের সদস্যদের এখানে আনানো হয়।
সোজা গিয়ে উঠলাম পাশাখালী ফরেস্ট অফিসে। যেখানে বনকর্মীদের থাকার কথা সেখান থেকে বেরিয়ে আসলো বনদস্যু নেতাদের স্ত্রী সন্তানেরা। সুন্দরবনের গহীনের খাল পাশাখালী। সেই খালের বন বিভাগের অফিসটি তখন বনদস্যুদের ঘরবাড়ি। কুশল বিনিময় হলো। মাস্টারের স্ত্রী আর কন্যার সঙ্গে আমার আগে থেকে পরিচয় ছিলো। নতুন করে পরিচয় হলো আরেক দস্যু সোহাগ আকনের স্ত্রী আর পুত্রের সাথে। নতুন জীবনের আশা মনে নিয়ে অপেক্ষায় তারা। স্বজনকে জঙ্গলের মৃত্যুর ঝুঁকিতে রেখে বেঁচে থাকা মূল্যহীন। সেই বোধ তাদের তাড়িত করেছে। সোহাগের স্ত্রী বলেই ফেললেন, টাকা পয়সা দিয়ে কী হবে, যদি মনের ভিতরে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা থাকে? স্বজনকে যদি কাছেই না পাই তাহলে সেই জীবনের মূল্য কোথায়? ‘ডাকাতের বৌ’ কথাটা শুনতে ভালো লাগে কার? বললাম, আমি চলে আসছি। নিরাপদে আর একটা দিন পার করতে হবে আমাদের।
বনকর্মীরা সবাই কোথায়? ওসি সাহেব কোথায়? তখন সম্ভবত মোট সাতজন বনকর্মীর পোস্টিং ছিলো ওই অফিসে। তাঁদের মধ্যে চারজন ছুটিতে। ওসি সাহেবসহ তিনজন আছেন। তাঁরা অফিসের পিছনে পুকুর পাড়ে বসা। এদিকে আমার সঙ্গে আসা দুই দস্যু সুমন আর সোলাইমান বেশ বদলে ফেলেছে। পরনে তাদের শর্টস আর গেঞ্জি। কোমড়ে গুলির ব্যাগ, হাতে বন্দুক। খালের পাশে কাঠের জেটির উপরে বসার জায়গায় একসাথে বসা মাস্টার, সোহাগ, ফজলু, সোলাইমান। তখনকার ডাকসাইটে জলদস্যুদলের এক একজন হিংশ্র মানুষ জীবনে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে! পিছনে কাঁকড়ার জেলেরা দাঁড়ানো। ওদিকে পুকুর পাড়ে বনরক্ষীদের সন্ত্রস্ত, অসম্মানবোধের জীবন। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি!
বেলায়েত সরদারসহ আমার সহযাত্রীরা সবাই গভীর ঘুমে। ট্রলারটা আরও ভিতরে নিতে হবে। সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে আধা জোয়ার পর্যন্ত। ফোন দিতে হবে বরিশাল RAB এর মেজর আদনান ও আমার পরিবারের কাছে।
(ছবিটি সেই দিনের। পাশাখালী। সুন্দরবন)