একটা অস্ত্র-গুলিও জঙ্গলে রেখে যাবো না! | রূপান্তরের গল্প ৬৭ | Rupantorer Golpo 67 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৬৭ : মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। মাস্টার বাহিনী বিভক্ত হয়ে যায় নি তো? সুন্দরবনে গেলে সচরাচর দস্যুদলের সবাইকে একসাথেই পাই। কিন্তু এবার সকাল থেকে দেখা হয়েছে ৫/৬ জন সশস্ত্র দস্যুর সাথে। আগেও লিখেছি, আত্মসমর্পণের বিপক্ষে বেশ কয়েকটি পক্ষ্য ছিলো সরব। তলে তলে তারা অনেক চেষ্টা করেছে। দস্যুনেতা মাস্টারকে নিয়ে দলের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। না পেরে নিজেদের বিশ্বস্ত একজনকে দস্যু বানিয়ে দলে ভিড়িয়েছিলো। সেই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঝে আরেকবার এসেছিলাম।
এতো বড় দস্যুদলের লোকজন কোথায়? মাস্টারকে জিজ্ঞেস করলাম। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনি বললেন, কিছু লোক উঠিয়ে দিয়েছেন, কয়েকজন স্বেচ্ছায় চলে গেছে। এখন তারা ২০/২২ জন আছেন। বললাম, সবাই সারেন্ডার করবে তো? জানলাম, সবাই নাও করতে পারে। বললাম, দস্যু যে ক’জনই থাকুক, সবগুলো অস্ত্র আমাকে জমা দিবেন। সোহাগ আকনের দিকে তাকিয়ে বললাম, একটা গুলির খোসাও যেন বাদ না পড়ে।
পাশাখালী ফরেস্ট অফিসকে বলা হতো জলদস্যুদের আস্তানা। সুন্দরবনের বড় দস্যুদলগুলো মরা গোনে এখানে চলে আসতো, থাকতো, বিশ্রাম নিতো কয়েক দিন। তারপর আবার ফিরে যেতো গোনের সময়। এই বিষয়টি সবার জানা। সেই তথ্য কখনও কখনও পেতো আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু লোকালয় থেকে এতো দূরে নৌপথে এসে এক একটি অভিযান চালানো ছিলো কঠিন এক বিষয়। প্রথমত সময় মতো রওনা দেয়া, নদী পথে সময় ব্যবস্থাপনা করা, পুরো বিষয়টি গোপন রেখে অভিযানে আসাটা ছিলো প্রায় অসম্ভব। আবার কেউ রওনা দিলে সে খবর চলে আসতো দস্যুদের কাছে।
জঙ্গলে এসে তাই দস্যুদের ধরাটা সহজ ছিলো না। অন্যদিকে পাশাখালীতে আসতে হলে বড় নদী ধরে আসতে হয়। দূর থেকে দেখা যায় সবকিছু। উজান বা ভাটি দুই দিকেই অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় বলে পাশাখালী ছিলো নিরাপদ আস্তানা। বন বিভাগের অফিস সেটি। কিন্তু বনকর্মীদের বের করে দেয়া হতো সেখান থেকে। সেখানে বন বিভাগের কোনো অস্ত্র থাকতো না। বনদস্যুদের ভয়ে অনেকগুলো ফরেস্ট ক্যাম্পে তখন অস্ত্র থাকতো না। কয়েকটি ফরেস্ট অফিস তো বন্ধই হয়ে যায়। গল্পে ফিরি।
মাস্টার ও সোহাগকে বললাম, ট্রলারের দিকে চলেন। নিজের চোখে দেখতে হবে অন্য দস্যুদের। একই সঙ্গে তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদের হিসাব বুঝে নিতে হবে। আমার একটাই চিন্তা ছিলো যে শুধু এক/দুইজনও যদি সারেন্ডার করে, করুক। অস্ত্র আর গুলি সবগুলো জমা দিতে হবে। দস্যুনেতাদের সেভাবেই বলেছিলাম।
হাঁটা দিলাম। বন অফিসের পিছনের পুকুর পাড় ধরে চলে গেলাম বনের ভিতর। তারপর সেই খাল। পুরো জোয়ার তখন। দস্যুদের দুটি ট্রলার নোঙ্গর করা। সাথে ১০/১২টা কাঁকড়ার জেলেদের নৌকা বাঁধা। আরেক পাশে নোঙ্গর করা আমাদের ট্রলার। দস্যুদের বেশির ভাগই নাই। কেউ ভয় পেয়ে চলে গেছে, কাউকে অবিশ্বস্ততার কারণে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। যে কয়জন আছে তাদের সবাই সারেন্ডার করবে না বলেই শুনছি। কোনো চাপ নাই। আবারও বললাম, শুধু অস্ত্রগুলো সব জমা দিবেন।
কিরা কেটে মিথ্যা বলাটা সুন্দরবনে বেশ প্রচলিত। আল্লাহর কিরা, মা বাবার কিরা, পানির কিরা, জঙ্গলের কিরা ইত্যাদি কিরা কেটে দস্যুরা মিথ্যা বলতো অহরহ। কোরআন ছুঁয়ে মিথ্যা বলা, বিশ্বাসঘাতকতা করার ইতিহাসও কম ছিলো না। তাই শুরু থেকে তাদের আস্থায় রেখেছি, বিশ্বাস করিনি। অস্ত্রের সংখ্যা নিয়ে তাদের কথা বিশ্বাস করলাম না। বললাম, যেখানে যেখানে অস্ত্র আছে বের করে আনেন। আমি একটা গুলিও জঙ্গলে রেখে যাবো না।
সাত সকালে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। মনে মনে করনীয় ঠিক করছিলাম। কারণ ততোক্ষণে বুঝে গেছি বেশ কয়েকটি অস্ত্র ও গোলাবারুদ জঙ্গলে চাপানো আছে।
(ছবি: বনদস্যুদের ট্রলার, সুন্দরবন, ২০১৬)