রূপান্তরের গল্প ৬৮ | Rupantorer Golpo 68

সারেন্ডার নিয়ে তখনও বিভক্ত দস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ৬৮

সারেন্ডার নিয়ে তখনও বিভক্ত দস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ৬৮ | Rupantorer Golpo 68 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৬৮ : বন্যা জোয়ার। মানে পানি উঠেছে জঙ্গলে। হাঁটু পানি ভেঙ্গে হাঁটছি আমরা। সাথে সোলাইমান আর সোহাগ। যেকোনো সময় পালানোর মতো ব্যবস্থা রেখে দস্যুদের ট্রলারগুলো নোঙ্গর করা। পাশাখালী খালটি বেশ ছোট। তবে শেষ ভাটা আর প্রথম জোয়ার ছাড়া বাঁকীটা সময় চলাফেরা করা যায়।

পশুর নদীতে খালের মুখে চর পড়ে গেছে। ফলে বড় নদী দিয়ে হুট করে কেউ ট্রলার বা স্পিডবোট নিয়ে খালের ভিতরে ঢুকতে পারবে না। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চলে আসলে পিছনের পথ দিয়ে বের হয়ে যাওয়া যায়। পাশাখালী থেকে নিশানখালী হয়ে চাইলেবগী, ভদ্রা, শিবসায় বের হওয়া কোনো ব্যাপার না। বেলমারীর ভাড়ানী হয়ে সোজা চলে যাওয়া যায় আদাচাই খালে, সেখান থেকে শিবসা। অর্থাৎ দস্যুদের চলাফেরার পথগুলো সব এসে মিশেছে পাশাখালীতে।

মাস্টার বাহিনীর প্রথম ট্রলারটি রাখা খালের মাঝখানে। সেখানে যেতে হলে ডিঙ্গি নৌকার উপর দিয়ে যেতে হবে। টলমলে পানির উপরে ৪/৫টা ডিঙ্গি নৌকা পেরিয়ে গিয়ে উঠলাম মাস্টার বাহিনীর এক নম্বর ট্রলারে। তার পাশে বাঁধা আরেকটি ট্রলার। সেটিও দস্যুদের।

বড় ট্রলারের গলুই-এ মাটির চুলা বসানো। বিশাল চুলা। তার উপর বড় হাঁড়িতে ভাত রান্না হচ্ছে। পাশের হাঁড়িতে রান্না করা তরকারি। হরিণের মাংস। ৪০ জনের রান্না হয়েছে আজ। বাবুর্চির হাতে ছোট একটা হাঁড়ি। তাতে রান্না করা আছে চিংড়ি ভুনা। যারা হরিণ খায় না তাদের জন্য ডাল আর ডিম ভাজি আছে। বললাম, আমার জন্য একটু শুকনা মরিচ ভেজে দেয়া যাবে? – ও ভাই, আপনার জন্য মরিচ ভাজা কমপ্লিট… বেলায়েত সরদার বললেন, আপনার জন্য মরিচ ভেঙ্গে রেখেছে মামুন। আপনার ঘুম ভাঙ্গলো? সরদার বললেন, দুই রাতের ঘুম স্টক করে ফেলছি ভাই! মামুনকে বললাম এক কাপ চা খাওয়াতে পারো? ততোক্ষণে দেখি ধোঁয়া ওঠা চায়ের মগ হাতে এগিয়ে আসছে মামুন।

দস্যু বহরের মাঝখানে দাঁড়ানো আমি। চুলা জ্বলছে। ১৭/১৮ জন সশস্ত্র দস্যু। কেউ দাঁড়ানো, কেউ বসা, কেউ আবার গভীর ঘুমে। দস্যুদলের হিসাব রক্ষক বা মুহুরি সুমন বসেছে খাতা কলম নিয়ে। শেষ সময়ের হিসাব চলছিলো সম্ভবত। সে দফায় আমার পাশে সব সময়ের জন্য দুইজন সশস্ত্র যুবক ছিলো। এইট শ্যুটার বন্দুক হাতে সোলাইমান আর একনলা বন্দুক হাতে হারুন। বুঝতে পারছিলাম যে হুট করে কেউ আক্রমণ যাতে করতে না পারে সেজন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা নেয়া। সবই বুঝছিলাম। কিন্তু আমি যে সব বুঝতে পারছি তা কাউকে বুঝতে দেইনি। স্বাভাবিক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে এক একজনের মনোভাব বুঝতে চাইছিলাম। বুঝলাম, বিভক্তি আছে এখনও। এদের সবাই সারেন্ডার করবে না।

পিছনের কেবিন থেকে উঠে আসলেন সুলতান কাকা। প্রবীন এই দস্যু ওই জগতে সুলতান কাকা নামে পরিচিত। প্রায় দুই যুগের দস্যু জীবন। দল বদল করতে করতে ক্লান্ত। দস্যু জীবন ছেড়ে একটু বাড়ি ফিরতে চান। নাতি-নাতনীদের নিয়ে কাটাতে চান শেষ বয়সটা। দস্যুদের প্রত্যেকের জীবনের গল্পগুলো অনেকটা এমন। নানা ভাবে চলে এসেছে এখানে। তারপর আর বের হওয়ার পথ নাই। মৃত্যু ছাড়া আর কোনো পরিণতি নাই ওই পথে।

আমার চেষ্টা ছিলো গল্পে গল্পে তাদের চিন্তায় ছাদ ঘটানো। ততোদিনে জঙ্গলের অপরাধীদের মনস্তত্ব কিছুটা বুঝতাম। অন্যদিকে সারেন্ডারের পথ খুলছে নিশ্চিত ছিলাম, সেই আত্মবিশ্বাসও ছিলো।

ওদিকে আমার সহযাত্রীরা সবাই ঘুম থেকে উঠে গেছেন। বেলায়েত সরদার, ইয়ামীন আলী, আহসান রাজীব আর বায়েজিদ ইসলাম পলিনকে বলা ছিলো, চারপাশে নজর রাখতে। ওই সফরটি খুব সহজ ছিলো না। অভ্যন্তরীণ গোলাগুলি ঘটে যেতে পারে যেকোনো সময়!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top