হঠাৎ সন্দেহজনক ট্রলার! | রূপান্তরের গল্প ৭০ | Rupantorer Golpo 70 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৭০ : ঘসিয়াঙ্গাড়ীর পাশ দিয়ে একটা ট্রলার যাচ্ছে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে। খালটি পশুর নদীর পূর্ব পাশে, একটু ভাটিতে। আমরা আছি তার বিপরীত পাশে, মানে পশুর নদীর পশ্চিম পাশে। পাশাখালী ফরেস্ট অফিসটি একদম নদীর তীরে।
এমনিতে নদী হিসাবে পশুর বেশ বড়। তবে পাশাখালীর এদিকটায় এসে সরু হয়ে গেছে। ওপাশে চাইলেবগীর ঠোঁটা। পূর্ব সুন্দরবনের দস্যুরা সেখানে ওঁৎ পেতে থাকতো। ছোট দুই/তিনটি খাল আছে ওখানে। ভিতরে ঢুকে থাকলে বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। জোয়ারের সময় যখন সাগর বা দুবলার চর থেকে জেলে নৌকা-ট্রলারগুলো ফিরে, তখন অতর্কিত হামলা চালাতো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাতেই চলতো সে অপকর্ম। টর্চ এর আলোর ইশারা দিয়ে থামতে বলা হতো জেলেদের। না শুনলে ট্রলার চালিয়ে দাবড়ে ধরতো, প্রয়োজনে চলতো গোলাগুলি। কাজটি বেশি করতো পূর্ব সুন্দরবনের ত্রাশ জুলফু বাহিনী। তবে ততোদিনে জুলফিকারের নেতৃত্বে সেই দস্যু বাহিনীর অবসান ঘটেছে। RAB এর অভিযানে পর পর দুই ভাই এর মৃত্যু হয়েছিলো। জুলফিকারের পর মর্তুজার ক্রসফায়ারের পর দস্যুদলটি কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়। ছোট ছোট সেই দস্যুদলগুলো বড় নদীতে এসে দস্যুতা করার সাহস পেতো না। জেলেরা জানে সে খবর। তাই পশুরের পূর্ব তীর ধরে তখন চলতো চলাফেরা। অন্যদিকে পশ্চিম পাড় ধরে চলাফেরা করলে মাস্টার অথবা জাহাঙ্গীর বাহিনীর মতো বড় দস্যুদলের হাতে ধরা পড়ার শংকা থাকে।
আমরা ঠিক তার বিপরীতে। পশুর নদীর পশ্চিমে পাশাখালী বন টহল ফাঁড়ীর ভিতরে বসে কথাবার্তা বলছিলাম। তখন দস্যুদের সবগুলো অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে। অস্ত্রধারী সবাই যার যার দায়িত্ব পালন করছে। বড় নদীর পাশে ও পিছনের খালে পাহাড়ায় ছিলো দু’জন।
এক কাপ চা নিয়ে হাজির মামুন। আয়েশ করে বসে সেই কাপ-এ চুমুক দিচ্ছিলাম। এসময় নদীর পাশে ডিউটিতে থাকা এক দস্যু দৌড়ে এসে জানালো নদীর উল্টো পাশ দিয়ে একটা ফিসিং ট্রলার আসছে! সেটা জেলেদের হতে পারে, আবার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীরও হতে পারে।
ঝটপট উঠে পড়লাম। নিরিবিলি একটু বসে থাকার সুযোগ ছিলো না। কারণ মনের মধ্যে অনেকগুলো দুশ্চিন্তা! কখন কোন অঘটন ঘটে যায় কে জানে! সারেন্ডার করতে না দেয়ার দলে তখন প্রশাশনের কোনো কোনো অংশ বেশ তৎপর। তাদের অভিযান চলতে পারে। আবার ঝাইলোর খালের মতো কোস্টগার্ডের অভিযানও চলতে পারে। আমরা বেশি দুশ্চিন্তায় ছিলাম জাহাঙ্গীর বাহিনীকে নিয়ে। তারা আশেপাশেই থাকে। মাস্টার বাহিনীর আক্রমণে এক সপ্তাহ আগ বেশ পর্যুদস্ত হয়েছিলো তারা। প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা ছিলো এমনিতে। তার উপর তারা যদি জানতে পারে যে মাত্র সাতজন সশস্ত্র অবস্থায় আছে, আবার সঙ্গে পরিবার! সঙ্গে নারী ও শিশু থাকলে এমনিতেই যে কেউ বন্দুক যুদ্ধে দুর্বল অবস্থায় থাকবে! যদিও তারা চাপাশের খবর রাখছিলো, আমিও রাখছিলাম। পরে জেনেছি জাহাঙ্গীর বাহিনী তখন বেশ দূরে ছিলো। শিবসা নদীরও পশ্চিমে কোনো এক গহীন খালে।
আকাশের পূর্ব-দক্ষিণ দিক পুরোটাই কালো হয়ে এসেছে। তাই খুব ভালো দেখছিলাম না আমি। তবে দস্যুরা স্পষ্ট দেখছে। সুন্দরবন আর সাগরে দূরের জিনিষ দেখার জন্য অভিজ্ঞতা লাগে। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যে দেখতে পেলাম একটি ফিসিং ট্রলার। কালো ধোঁয়া উড়ছে সাইলেন্সার পাইপ দিয়ে। তার মানে সর্বোচ্চ গতিতে চলছে।
কীসের ট্রলার এটা? সোহাগ আকন বললেন, বুঝা যাচ্ছে না। পরিচিতি কোনো ট্রলার না। মাঝে মাঝে RAB এমন ট্রলার নিয়ে অভিযান চালাতে আসে। কোস্টগার্ডের কোকিলমনি ও দুবলা অফিসও এমন ট্রলার ব্যবহার করে। তাহলে তারা আমাদের দিকে আসছে না তো? নির্দেশ দিলাম, সবাইকে সতর্ক করে দিন, ট্রলারগুলো ভেসে আছে কী না দেখেন, সবাইকে ট্রলারে উঠতে বলেন!
সোলাইমান বললো, ও কাকু, আপনে টেনশন নিয়েন না। ওদের এখানে ভিড়তেই দিবো না। বললাম, তোমরা কেমন ফাইটার সেটা জানি! ঝাইলোর খালে গোলাগুলির সময় এক মাস্টার ছাড়া কাউকে খুঁজে পাইনি! আর তোমরা মাত্র সাতজন, কয়দিক সামলাবে? তার চেয়ে সবাইকে সতর্ক করো, এখান থেকে সরে যাওয়ার প্রস্তুতি নাও। এসময় কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলায় যাওয়া যাবে না! সহকর্মী ইয়ামীন ভাইকে ডেকে বললাম, আমাদের ট্রলারের সবাইকে সতর্ক হতে বলেন।
অপেক্ষা করছি তীরে দাঁড়িয়ে। সেখানে ছোট গড়ানের বন। কিছু গেওয়া গাছ আছে। সেগুলোও ছোট। আমরা সেই ছোট গড়ার ঝোপগুলোতে নিজেদের আড়াল করে রাখলাম! সবাই খুব টেনশনে। এসময় ফরেস্ট অফিস থেকে মাস্টার আর সোহাগের বাচ্চাদের সাথে নিয়ে দাঁড়ালো হারুন। বললো কী দেখেন আপনারা মামা? ওটা তো ওমুক সাহেবের মাছ পরিবহনের ফিসিং! তারপর আরেকজন এসে নিশ্চিত করলো যে ট্রলারটি কোনো আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর না! তবুও সবাইকে সতর্ক থাকতে বললাম। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে নিশ্চিত হলাম যে ট্রলারটির গন্তব্য আমাদের দিকে না, সোজা উত্তরে। ঝড়ের আগে কোনো নিরাপদ খালে আশ্রয় নেয়ার জন্য তারা ফুল স্পিডে ট্রলার চালাচ্ছিলো!
মনের মেঘ কাটলো। কিন্তু আকাশের মেঘ আরও গাঢ় হলো। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশ ভেঙ্গে বড় ঝড়-বৃষ্টি নামবে আবার। সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে গেলো। আমি গেলাম বন বিভাগের অফিসের ভিতরে। ফরেস্টের ওসি সাহেব আমাকে ভিতরে যেতে বললেন। বললাম, একটু সরে বসেন ভাই, আপনার পাশে বসি। ভিতরে নারীরা আছেন। আমি বরং কিছুক্ষণ আপনার পাশে বসি।
ফরেস্ট অফিসের বারান্দায় একটি ভাঙ্গা টুল। জেলেরা এসে বসতো সেখানে। ওসি সাহেব সেখানেই বসে আছেন। অফিস দখলে নিয়েছে বনদস্যু বাহিনী। থাকার ঘর দখল করে আছে দস্যুদের স্ত্রী সন্তানরা। ওসি সাহেব বিগলিত! হাসি মুখে উঠে দাঁড়ালেন, বসতে বললেন। আমি বললাম, চলেন ভাই এক সাথে বসি। বসতে বসতে বললাম আপনাদের কাছে তো অস্ত্র নাই। বললেন, বনদস্যুদের ভয়ে অস্ত্র রাখা হয়নি এ ক্যাম্প এ। তাহলে অপরাধী ধরবেন কী করে? চোর ডাকাত ধরবেন কী ভাবে? আপনার জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? বাঘ আসলে কী করবেন?
ফরেস্টের সেই ওসি সাহেব বললেন, সেই কথা কাকে বুঝাবো? ডিপার্টমেন্টের অবস্থা আপনি জানেন না? মনটা খারাপ হলো। বরনক্ষীরা এই গহীনে বনে অস্ত্র ছাড়া বন পাহাড়া দিচ্ছেন! কী করে সম্ভব? পাশাখালী ফরেস্ট অফিসটি ছিলো নড়বড়ে, তাদের ডিপার্টমেন্টের মতোই! অঝোরে বৃষ্টি নামলো, সাথে কালবৈশাখী ঝড়! ওই নড়বড়ে ঘরেটা সেই ঝড়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিলো!
(ছবিটি প্রতিকী)