শেষ অস্ত্রের ব্যবহার করলাম | রূপান্তরের গল্প ৭৩ | Rupantorer Golpo 73 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৭৩ : সুন্দরবনে যাওয়ার সময় আমি কি অস্ত্র বহন করি? নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে না? এই প্রশ্ন হাজার বার শুনেছি। উত্তরে সন্তুষ্ট হননা অনেকে। বলেন, আমি সঠিক তথ্য দিচ্ছি না। যে যাই মনে করুক, সুন্দরবনে কাজ করতে আমার বাড়তি কোনো প্রোটেকশনের প্রয়োজন হয়নি। কোনো ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আমি ব্যবহার করিনি, অস্ত্রের লাইসেন্সও নাই। সুন্দরবনের দস্যুরা যদি আমাকে মেরে ফেলতে চাইতো তাহলে এক দুইটা ছোট অস্ত্র দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার সুযোগ ছিলো না সেটা ভালোই বুঝতাম। এছাড়া আমি চলতাম বিশ্বাস আর সম্পর্কের ভিত্তিতে। সতর্ক থাকতাম সব সময়।
আমার পর পর ফরেস্ট অফিসের ওসি সাহেবও বাইরে বের হয়ে এসেছেন। চেহারা মলিন। ইশারায় ঘরের ভিতরের পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। হাত নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দিলেন। তার মানে লুকিয়ে রাখা অস্ত্রগুলো বের করা নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। আমি জানি যে চোখ বন্ধ করে নিজেদের সমর্পণ না করলে এই অস্ত্রগুলো তারা দিবে না। দেখানোর মতো ২২টা অস্ত্র তো আছেই। এক সাথে এতোগুলো অস্ত্র কে কবে কোথায় পেয়েছে? সরকারের খুশি থাকা উচিৎ এই নিয়ে, এমন কথাবার্তা চলছিলো তখন ভিতরে।
সুন্দরবনের দস্যুরা সবকিছু কিনতো দ্বিগুন বা তার চেয়ে বেশি দামে। অস্ত্র-গুলি তাদের কিনতে হতো অনেক বেশি দাম দিয়ে। আমরা যাওয়ার আগে মাত্র একশ’ গুলির একটি চালান এসেছিলো সেখানে। থ্রি নট থ্রি বন্দুকের গুলি। একশ’ গুলির দাম তিন লাখ টাকা। মানে একটি গুলির দাম পড়লো তিন হাজার টাকা! সাধারণ বন্দুকের গুলির দাম পড়তো ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা প্রতিটি। অবৈধ যে বন্দুক তারা ব্যবহার করতো সেগুলোর দাম পড়তো দেড় লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা। যে অস্ত্রগুলো চাপানো ছিলো সেগুলো তারা কিনেনি। অস্ত্র অন্য দস্যুদলের কাছে বিক্রি করলে অনেক টাকা পাবে। সেই লোভটা সামলাতে পারছিলো না তারা। ওই জগতে একটি একনলা বন্দুকের দাম ছিলো দেড় লাখ, দোনলা বন্দুক বিক্রি হতো দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায়। ৩০টি অস্ত্রের দাম হয় কতো? দুই হাজার গুলির দাম কতো হয়? করুক ওরা আলোচনা। মাথা গরম করে সংঘর্ষে না গেলেই হয়। হাতাহাতি হতে পারে, গোলাগুলির পর্যায়ে যেন না যায়। দস্যুনেতা মাস্টারের সাথে এবিষয়ে রেষারেষি চলছিলো আগে থেকে।
বৃষ্টির পর ফরেস্ট অফিসের পথঘাট কাঁদা কাঁদা হয়ে গেছে। হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এমনিতে শরীর আর মনের ওপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে। মনটা শক্ত ছিলো, কিন্তু শরীর আর কুলায় না। নিয়ম করে ঘন্টায় এক কাপ চা খাচ্ছি টিকে থাকার জন্য। রাতে ভেবেছিলাম যে দিনের কোনো এক সময় একটু বিশ্রাম নিবো। কিন্তু তখন মনে হচ্ছিলো যে এক ঘন্টার বিশ্রাম নেয়াও উচিৎ হবে না।
হেতাল গাছ বিছানো হাঁটা পথ। জেটি থেকে ফরেস্ট অফিস, সেখান থেকে পুকুর পাড়। সেই গাছ বিছানো রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আছাড় খেলাম। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জেলেরা এসে তুললো। তেমন ব্যাথা পাইনি। এগিয়ে গেলাম পুকুরের দিকে। সেখানে দস্যু নেতাদের পরিবারের সদস্যরা বসা। গল্পে বসলাম। আমার সবশেষ অস্ত্র ব্যবহারের সময় এসেছে।
ভাবী, কেমন আছেন? সোহাগের স্ত্রী উত্তর দিলেন। বললেন, খুব টেনশনে ভাই। কী যে হবে! মাস্টারের স্ত্রী বললেন, জীবনটা আপনার হাতে তুলে দিলাম। এখন বাঁচলেও সই, মরলেও সেটা আপনার ব্যাপার। বললাম, বাঁচাতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। কেন? প্রশ্নের আগেই উত্তরে গেলাম। বললাম, অস্ত্র লুকিয়ে রেখে সারেন্ডার হয়? সোহাগের স্ত্রী বললেন এক কথা, মাস্টারের স্ত্রী বললেন আরেক কথা। দুজনের মধ্যে একটু মতানৈক্য চলতে থাকলো। আমি নেমে পড়লাম পুকুরে। ফরেস্ট অফিসের ওই পুকুরের পানি ছিলো মিষ্টি। বাচ্চারা গোসল করছিলো। আমিও তাদের সঙ্গী হলাম। পুকুর পাড়ে বসে থাকা ভাবীদের বললাম, অস্ত্র-গুলি কিছু চাপানো আছে। সেগুলো বের না করলে আমি আপনাদের এখানে রেখে চলে যাবো। কথার কোনো নড়চড় হলে আমি কিন্তু থাকবো না এ সারেন্ডারের মাঝে। সাঁতরে তাদের কাছে এসে একটু নরম করে বললাম, ভিতরে যান। ওদের বুঝান। ঝট করে উঠে দাঁড়ালো তারা। হাঁটা দিলো বন অফিসের দিকে।
বাচ্চাদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ খেলাধূলা করলাম। পানিতে শরীর ডুবিয়ে নিজেকে ঠান্ডা করলাম। পুকুরটির সঙ্গে লাগানো গড়ান বাগান। ছোট ছোট গাছের ঝোপ। ভিতরে কিছু দেখা যায় না। এদিক দিয়ে বাঘ মামা চলে আসলে নতুন বিপদ ঘটবে। কাঁকড়ার জেলেরা খালের পাশে কী যেন করছে। দস্যুদের চারজন ফরেস্ট অফিসে। অন্যরা ট্রলারে। বাচ্চাদের নিয়ে পুকুর থেকে ওঠা প্রয়োজন। কিন্তু চার দস্যুর আলোচনা শেষ না হলে ওদিকে যাবো না। শেষ অস্ত্র হিসাবে ভাবীদের পাঠিয়েছি। দেখা যাক কী হয়!
(ছবি: পাশাখালী | ২৭ মে ২০১৬)