বেরিয়ে আসলো অনেকগুণো অস্ত্র | রূপান্তরের গল্প ৭৮ | Rupantorer Golpo 78 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৭৮ : প্যাকেট খুলতেই গলগল করে বেরিয়ে আসলো লুব্রিকেন্ট। কালো রঙ এর ওই তরলের ভিতর থেকে বের হয়ে আসলো একটার পর একটা বন্দুকের অংশ। পুকুর পাড়ের ঘাসের উপর ঝরঝর করে পড়লো লোহা লক্কর।
সুন্দরবনের দস্যুরা তাদের অব্যবহৃত অস্ত্রগুলো এভাবেই সুরক্ষিত রাখতো। লবণ পানির হাত থেকে লোহা লক্কর নিরাপদ না, নষ্ট হয়ে যায়। তাই চাপানোর সময় মবিলে ডুবিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা লাগে। হাতে যে অস্ত্রগুলো থাকে সেগুলোরও বাড়তি যত্ন লাগে। এমনিতেই আগ্নেয়াস্ত্র পরিস্কার রাখতে হয়। নিয়মিত তেল দিতে হয়। ব্যারেল পরিস্কার রাখতে হয়। সুন্দরবনে এই কাজ বেশি বেশি করতে হতো। যেকোনো সময় গোলাগুলি শুরু হতে পারে। প্রস্তুতি থাকতো এমনই।
সুলতান কাকার মনটা আজ বেশ ভালো। বলছিলো, এই মেশিনগুলোর ওজন এখন অনেক বেশি লাগে। এগুলো নিয়ে যান। বাঁচান আমাদের। বললাম, বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। আর এতোদিন যে বেঁচে আছেন সেটাও বিরাট ব্যাপার! শুকরিয়া করেন।
অস্ত্রগুলো পরিস্কার করতে করতে বলছিলেন, নব্বই দশকের শেষ দিকে দস্যুতা শুরু। পশ্চিম সুন্দরবনেই কেটেছে। কখনও মোতালেব, কখনও মান্নান, কখনও রাজু আবার কখনও আলিফের দলেও দস্যুতা করেছে। বনদস্যু জগতে দুই যূগের প্রাপ্তি কয়েকটি মামলা। আর নামের সাথে জুড়ে গেছে- ডাকাত। সমাজে তার স্ত্রী-সন্তানদেরও চলতে হয় মাথা নিচু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো বাড়িতে কাটানোর খুব শখ। নাতি-নাতনীদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর শখটাও পূরণ হবে সারেন্ডার করতে পারলে।
সকালের বৃষ্টির পর রোদ ঝলমলে দিন ছিলো। ওদিকে ভাটা শেষ হয়ে জোয়ার লেগেছে বড় নদীতে। এই মৌসুমে জোয়ার আর ভাটার শুরুতে বৃষ্টি নামে। কোনো নিয়ম আছে কী না জানি না। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এমনই দেখেছি। পশ্চিম আকাশে মেঘ। সম্ভবত বৃষ্টি হচ্ছে শিবসার ওদিকে। মাস্টার আর সোহাগকে বললাম, জোয়ার শুরু হলো। সবাইকে সতর্ক করে দেন। এই জোয়ারটা পার করতে হবে ভালোয় ভালোয়।
উজান অর্থাৎ উত্তর থেকে নৌযানগুলো ছাড়ে জোয়ারে। সেই সাথে খুলনা-মংলা থেকে ছেড়ে আসে জেলেদের ট্রলার, বন্দরের জাহাজ-কার্গো, নৌ-বাহিনীর জাহাজ, কোস্টগার্ডের নৌযান আর বন বিভাগের ট্রলার। অন্য জলদস্যুরাও চলাফেরা করে জোয়ার লাগলে। আমরা আছি বড় নদীর পাশে। তাই আমাদের অবস্থান নিয়ে কারও কাছে তথ্য চলে গেলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। সেই বিপদ যদি আসে তবে এই জোয়ারেই আসবে।
সোহাগ বললো, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ মংলা বা খুলনা থেকে রওনা হলে খবর পাওয়া যাবে। বললাম, কোকিলমনি, দুবলা বা কাগা থেকে কোস্টগার্ড আসলেও খবর পাবেন? বললো, তা পাবো না। বললাম, তাহলে সব জায়গায় পাহাড়া বসান। ঝাইলোর খালের মতো গোলাগুলিতে পড়তে চাই না আর। সেবার বেঁচে গেছি বলে আবার বাঁচবো সেটা কে বলতে পারে?
সামনে শাহীন এসে দাঁড়ালো। জঙ্গলের নাম- ত্রাণ শাহীন। কী কারণে এ নাম হলো জানি না। সুন্দরবনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের মানূষ ত্রাণ শাহীন বললেই চিনে। সকালে সারেন্ডারে আগ্রহী ছিলো না শাহীন। কিন্তু দুপুর গড়াতে গড়াতে মত বদলালো সে। আমি বলেছিলাম রাজি তবে অস্ত্র হাতে দিবো না। সেই শর্তেই রাজি শাহীন। সারেন্ডারের বহরে যোগ হলো আরও একজন। মাস্টার বাহিনীর মাত্র ৮ জন দস্যু সারেন্ডার করলে প্রশ্ন উঠবে। তবে অস্ত্র সব জমা দিতে পারলে, গুলিগুলো সব সারেন্ডার করাতে পারলে সেই জায়গায় মুখ দেখানো যাবে। কাজেই অস্ত্রগুলো সব জমা হলে নজর দিবো গুলির দিকে। চার ঘন্টা হয়ে যাচ্ছে। ফজলু শেখ ও ইয়ামীন আলীর নৌকাটা ফিরেনি তখনও!