ফরেস্ট অফিস তখন দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে | রূপান্তরের গল্প ৮৩ | Rupantorer Golpo 83 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৮৩ : আমরাও বাদায় মাছ ধরতাম-কাঁকড়া ধরতাম। এই পশুরের বাওনে আসা-যাওয়া সেই ছোটবেলা থেকে। বাপ, ভাই আর আমি। ভালোই চলতো। মোশাররফ নামের এক ডাকাত দল ধরলো। ৫০ হাজার মুক্তিপণ। কিছু টাকা ছিলো, ১৫ হাজার টাকা সূদে ঋণ নিলো বাবা। এরপর কিস্তি দিবো না সূদ দিবো! এই করতে করতে ১৫ হাজার টাকা আর শোধ হয় না। সূদের মহাজন মামলা দিলো। ওই মামলায় ওয়ারেন্ট হলো। পালায়ে চলে আসলাম জঙ্গলে। তখন রাজু ছিলো বড় পার্টি (দস্যুদল)। যোগ দিলাম সেই দলে। ডাকাত হয়ে গেলাম। কথাগুলো এক নি:শ্বাসে বলে গেলো তরুন এক বনদস্যু।
অনর্গল বলতে থাকলো…!! ভাবলাম গোপনে ছয় মাস দস্যুতা করবো। মাসে ১৫ হাজার করে দিবে। ছয় মাসে ৯০ হাজার টাকা। তারপর নিরবে বাড়ি ফিরে ধার দেনা শোধ করবো। একটা মামলায় ওয়ারেন্ট আছে। জামিন করিয়ে বাড়িতে গিয়ে থাকবো। চোখ টলটল করছে পানিতে। বলে গেলো একটানা…. মাত্র ১৫ হাজার টাকা সূদে ধার নিয়ে শোধ করতে পারেনি সে। আবার ফাঁকা চেক দেয়া ছিলো। তাতে ৫০ হাজার টাকা লিখে চেক এর মামলা দেয় সূদে মহাজন। ওয়ারেন্ট হয়।
এরপর পুলিশ খোঁজে, পুলিশের সোর্সরা ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা নেয়। ঘরেই যদি থাকতে না পারি তাহলে রোজগার করবো কী করে? তখন জঙ্গল করার পরিবেশও নাই। দস্যুদের চাঁদা আর ফরেস্টের ঘুষ দেয়ার টাকা না থাকলে জঙ্গল করা যায়? রাজু বাহিনী ছয় মাস পর তাকে টাকা দেয়নি, বরং ততোদিনে নাম ছড়িয়ে গেছে। বাড়ি যাওয়ার পথ পুরোপুরি বন্ধ। এর পর কয়েকটি দস্যুদল ঘুরে মাস্টার বাহিনীতে যোগ দেয়া।
হাতে অস্ত্র নিয়ে পশুর পাড়ে পাহাড়ায় সেই তরুন। গুরু দায়িত্ব। সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে হচ্ছে। দূর থেকে কোনো ট্রলার বা স্পিডবোট দেখা মাত্র খবর দেয়া কাজ তার। ওই তরুনকে বললাম, তুমি নিজেই তো সুন্দরবনের জেলে ছিলে। বললো, জেলেদের কাছে থেকে চাঁদাবাজি-মুক্তিপণ নিতে খারাপ লাগে, কষ্টও লাগে। কী করবো বলেন? জঙ্গলে টিকে থাকতে হলে জেলেদের আতঙ্কে রাখতেই হবে। ভয় না পেলে মাইনষে চাঁদা দিবে না। …আমরা টার্গেট করি ব্যবসায়ীদের; কথাগুলো বলছিলো সেই তরুণ দস্যু।
মাস্টার বাহিনীর মোট সাতজন দস্যু সারেন্ডার করবে বলে প্রস্তুত। অষ্টম ব্যক্তি হিসাবে শাহীন নামের একজন সারেন্ডারে রাজি। কিন্তু শুরুতে রাজি না থাকায় তাকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছিলাম, হাতে অস্ত্র রাখতে দেইনি। শাহীন বললো, তার একটা মেয়ে আছে। তার জন্যই আত্মসমর্পণ করবো। আপনি আমাকে রাইখে যাইয়েন না ভাই… বললাম, নিয়ে যাবো। কিন্তু হাতে অস্ত্র দিবো না। শাহীন রাজী। মানে আটজন বনদস্যু আদ্মসমর্পণ করবে। ডাকসাইটে দস্যুদল মাস্টার বাহিনী সারেন্ডার করবে মাত্র ৮ জন? কী বলবে লোকে? আসলে প্রথম সারেন্ডারে ভরসা পাচ্ছে না সবাই। যদি অন্যকিছু হয়ে যায়? যদি ক্রসফায়ার হয়? চাপ দেইনি কাউকে।
পুকুর পাড়ে বসে একটার পর একটা অস্ত্র জোড়া লাগাচ্ছিলো দস্যুরা। সুলতান কাকার নেতৃত্বে ততোক্ষণে ৩০টির বেশি অস্ত্র জোড়া লাগানো শেষ। বাঁকীগুলোও জুড়ে দেয়া হবে কিছুক্ষণের মধ্যে। নিউজের জন্য শ্যুটিং এর কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছি। একদিকে চলছে দস্যুদের সারেন্ডারের প্রস্তুতি, অন্যদিকে আমাদের কাজ। সমান তালে সব শেষ করবো বড় বৃষ্টি আসার আগে।
দক্ষিণ-পশ্চিমে মেঘ করেছে। কালো হয়ে আসছে চারপাশ। দ্রুত কাজ গুছিয়ে নিলাম। ভিডিওগ্রাফার হিসাবে পলিনের বিশেষত্ব ছিলো, বৈরী পরিবেশে সেরা কাজ। ঝড়বৃষ্টি বা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে তার কাজ চলমান থাকে। দিন শেষে এই নিউজটিই আমার সম্বল।
ফরেস্ট অফিসের চুলায় চা রান্না হচ্ছিলো। রান্নাঘরে দস্যু সরদারের স্ত্রী চা বানিয়ে পাঠাচ্ছে সময় সময়। সাথে কখনও বিস্কিট, কখনও মুড়ি মাখা, কখনও ফলমূল। সকাল থেকে মনে হয় কুড়ি কাপ চা খাওয়া হলো। ক্ষুধা নাই। তবুও অন্যদের সাথে খেতে বসলাম দস্যুদের ট্রলারে গিয়ে। দুপুরের রান্নায় হরিণ! আমার চলে না। সরদারের ট্রলারে ছিলো পান্তা ভাত। একটা ডিম ভেজে খেয়ে নিলাম। তারপর আবারও চা। জোয়ার শেষে ভাটা শুরু হলো। বড় বৃষ্টি নামবে যেকোনো সময়।
(ছবি: দস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি। পাশাখালি, সুন্দরবন। ২৭ মে ২০১৬)