রূপান্তরের গল্প ৯১ | Rupantorer Golpo 91

কতো অসম্মান! কতো অপমান! | রূপান্তরের গল্প ৯১

কতো অসম্মান! কতো অপমান! | রূপান্তরের গল্প ৯১ | Rupantorer Golpo 91 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৯১ : কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছি আমি! ঢাকার উত্তরায় দুটি বাড়ি। গাড়ি তো আছেই। সুন্দরবনের দস্যুরা আমাকে টাকা দেয়। দস্যুদের পৃষ্ঠপোষকতা করি। তাদের সহযোগিতা করি। এই কথাগুলো কিছু মানুষ ছড়াতো শুরু থেকেই। সুন্দরবনের নয়, শহরের কিছু মানুষ বলে বেড়াতো, সাংবাদিক মোহসীনের সুন্দরবনে কী কাজ? সত্যিই তো, কী কাজ আমার সুন্দরবনে? যখন কাজ শুরু করি তখন নিজেও জানতাম না আসলে কী করতে যাচ্ছি আমি!

বনদস্যুদের অস্ত্র-গুলিগুলো ট্রলারে রেখে ফিরছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়লো পুরনো দিনের সেই অসম্মানের কথা। কেন দিন রাত এক করে ছুটছি? আর তারা কী বলছে? স্বার্থে যাদের সমস্যা হতে পারে তারা অনেক কথাই বলতে পারেন। কিন্তু দায়িত্বশীল লোকজন কেমন করে তথ্য প্রমাণ ছাড়া অপবাদ দেন? মন খারাপ হয়ে গেলো। চোখ ভিজে আসছে। হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে আলাদা করে নিলাম। সঙ্গীরা খেয়াল করেনি। তাই আলাদা হয়ে গেলেও আমাকে অনুসরণ করেনি কেউ।

কিছুক্ষণের জন্য কোথায় জানি হারিয়ে গেলাম। মনে পড়ছিলো কী কষ্টটাই গেছে আমার। পরিবার ছেড়ে, শহরের বিলাসী জীবন ছেড়ে পড়ে থেকেছি বনে। বর্ষার বৃষ্টি, বৈশাখের ঝড়, দম বন্ধ করা গরম, তপ্ত রোদ কিংবা কনকনে শীতের মধ্যে থেকেছি ওই বনে। কখনও ছুটে বেড়িয়েছি গভীর সাগরে। জীবন বিপন্ন করেছি কতোবার মনেও পড়ে না। চেষ্টার প্রশংসা না করে উল্টো অপবাদ দেয় কেন বুঝতেই পারতাম না। কষ্ট পেতাম মনে মনে। ভাবতাম, লেগে থাকলে একদিন এসবের ফয়সালা হবে।

কতোক্ষণ হাঁটলাম খেয়াল নাই। দূর থেকে হঠাৎ কানে আসলো আমাকে ডাকছে কেউ। চোখের সামনে না পেয়ে সবার মাথা খারাপ। পেছনে চলে যাওয়া মস্তিস্ক আমার মুহুর্তেই বর্তমানে ফিরে এলো। ডাকের বিপরীতে ডাক দিলাম। মিনিট খানেকের মধ্যে দুইজন ছুটে আসলো। দেখি গড়ান বনের ভিতর দিয়ে বেশ খানিকটা ভিতরে চলে এসেছি। ওদের সাথে সাথে ফিরলাম ফরেস্ট অফিসে। পাশাখালী ফরেস্ট অফিস তখন লোকজনে ঠাসা। অফিসের রান্নাঘরের চুলায় রান্না হচ্ছে হরিনের মাংস। বনদস্যুদের একটু গা ছাড়া ভাব। নেতারা সময় দিচ্ছে পরিবারকে। বললাম, সারা জীবন সামনে পড়ে আছে ভাই। এখন একটু চারপাশে খেয়াল রাখেন। সারেন্ডার করে পরিবারকে সময় দিয়েন। মাস্টার বললো, সারেন্ডার করেই তো লাল দালানে পাঠায়ে দিবেন। বললাম, শর্ত তো এমনই ছিলো।

সবাইকে সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিলাম আবার। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে কোনো অঘটন ঘটতে দেয়া যাবে না। সারেন্ডার যারা করবে না তাদের কেউ যেন না পালায়। কোনো অঘটন ঘটলে তাদের পরিবারের মামলা খেতে হবে। বলতে বলতে বেরিয়ে পড়লাম।

পুকুর পাড়ে কে যেন ফোনে কথা বলছে। তার মানে নেটওয়ার্ক এসেছে! গতি বাড়িয়ে হাঁটলাম। সত্যিই একজন ফোনে কথা বলছে। ফোন খুলে উঁচি করে ধরলাম। কিন্তু নেটওয়ার্কের খবর নাই। একই জায়গায় দাঁড়িয়েও আমার ফোনে নেট নাই। কথা বলা শেষ হলো সেই বনদস্যুর। তারপর ফোনটি এগিয়ে দিয়ে বললো, আপনার ফোনে নেট আসবে আরবও এক ঘন্টা পর। জোয়ারের পানি আরেকটু বাড়লে পাবেন। আপনি কী করে পাচ্ছেন নেট? বললো, স্মার্ট ফোনের চেয়ে বাটন ফোনে ভালো নেট পাওয়া যায়। ফোনটি হাতে নিয়ে দেখি সত্যিই এক তাগ নেটওয়ার্ক আছে। ফোন দিলাম আমার স্ত্রীর কাছে। অচেনা নাম্বার বলে হয়তো ফোন ধরলো না সে। এরপর ফোন দিলাম RAB কর্মকর্তা মেজর আদনানের ফোনে।

মোহসীন ভাই কেমন আছেন? ওদিকের সব ঠিকঠাক তো? বুদ্ধিমান কর্মকর্তা। অচেনা নাম্বার দেখেই তিনি বুঝে গেছেন যে আমি ফোন দিয়েছি। বললাম, এদিকে সব ঠিক। শুধু সারেন্ডারে আগ্রহীদের সংখ্যা কম। কাউকে জোর করে সারেন্ডার করাবো না। বরং পৌঁছে দিতে হবে নিরাপদে। সেই দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলেন আদনান। কী বিচক্ষণ! আমাকে একটা বড় দুশ্চিন্তা খেকে মুক্ত করে দিলেন। মাথাটাও বেশ হাল্কা হলো।

আদনান জানালেন, বরিশাল থেকে সড়ক পথে রওনা দিবেন একটু পরে। মংলায় লঞ্চ প্রস্তুত করা আছে। আমার প্রতিষ্ঠান যমুনা টিভির লাইভ টিমকে সাথে নিয়ে আসবেন তাঁরা। ভাবলাম, এরকম সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব যদি অন্যদের সবার মধ্যে থাকতো তাহলে সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসর্পণ শুরু হতো আরও ছয় বছর আগে। সেটা তো হয়নি। বরং উল্টো আমাকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণের অপচেষ্টা হয়েছে। শুভাকাঙ্খীরা বলতেন, এসব করতে গিয়ে তো কাজ হচ্ছে না। হচ্ছে শুধু বদনাম।

কিছু একটা করতে হবে সেই তাড়না ছিলো মনে। বদনাম, দুর্নাম হলেও সময় নিয়েছি, ধরে থেকেছি। মান বাঁচাতে সুন্দরবনের দস্যুদের নিয়ে কাজটি ছেড়ে দিতে পারতাম। সাংবাদিকতা করার আরও অনেক বিষয়ই তো ছিলো। কিন্তু মন বলতো কিছু একটা সম্ভব। সেই কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে একটি পথ খুঁজে পাই। সংবাদ প্রচারের পাশাপাশি সেই পথে হাঁটা শুরু করি।

২০১১ সালে রাজু বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে রীতিমতো ভিলেইন বনে যাই। ২০১৩ সালে ইলিয়াস বাহিনী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একই ঘটনা ঘটলো। বার বার ব্যর্থ হয়েও কেন হাল ছাড়ছি না? সেই প্রশ্নটি তীর্যক ভাবে করতেন সমালোচক বন্ধুরা। তবুও দমে যাইনি। পরদিনই আত্মসমর্পণ করবে মাস্টার বাহিনী। আবার আমার হাত ধরে উঠবে তারা।

অফিস থেকে বের হয়ে ফরেস্টের ওসি সাহেব বললেন, ভিতর থেকে ওরা ডাকছে আমাকে। অফিসের সামনে যেতেই দস্যুরা বেরিয়ে আসলো। একজনের হাতে একটা চটের ব্যাগ। এগিয়ে আসলো আমার দিকে। কিছু একটা আছে সেই ব্যাগে! বললাম, ব্যাগে কী? বললো, আপনার জন্য একটু উপহার আছে। হাতে নিয়ে দেখি অনেকগুলো টাকার বান্ডিল!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top