রূপান্তরের গল্প ৯৪ | Rupantorer Golpo 94

মাছ শিকার ছিলো আমার ছদ্মবেশ! | রূপান্তরের গল্প ৯৪

মাছ শিকার ছিলো আমার ছদ্মবেশ! | রূপান্তরের গল্প ৯৪ | Rupantorer Golpo 94 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৯৪ : মাছ ধরতে কার না ভালো লাগে। আমিও উপভোগ করি। কিন্তু মাছ ধরার নেশা বলতে যা বোঝায় তা না। সুন্দরবনে যেতে যেতেই অভ্যাসটা হয়েছে। সাথে মাছ ধরার সরঞ্জাম রাখতাম সুন্দরবনের সফরগুলোতে দুটি কারণে।

২০০৯-২০১০ সালের দিকে সুন্দরবনে সহজে ঢুকতে পারতাম না। পর্যটক হিসাবে বনে গিয়ে আমার কাজ হবে না। তাই বাঁকা পথকেই বেছে নিয়েছিলাম। জেলেদের নৌকা করে জেলে সেজে ঢুকে পড়তাম বনে। বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার প্রশিক্ষণ শুরু হয় তখন। বনের মানুষদের সাথে মিশতে গিয়ে দেখলাম অনেক বড় জগৎ। যে জগৎটাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে পৃথিবী থেকে। সুন্দরবনের ভিতরটা আসলে দেখতে কেমন? কী কী আছে, কী নাই! কেমন করে জেলেরা মাছ ধরে, মধু কাটে সবই দেখতাম অবাক হয়ে।

বার বার খটকা লাগতো একটি বিষয় নিয়ে। সেটি হলো কাঁকড়ার নৌকা। ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় করে আসে যায়। কোনো জাল থাকে না সাথে। দড়ি দিয়ে দাওন পদ্ধতিতে কাঁকড়া ধরে তারা। তখনও বুঝতাম না কাঁকড়া কতো বড় সম্পদ, কতো দামী সম্পদ! পশুর নদীর পশ্চিমে জোংড়া, ঝাপসী, মরাপশুর, ভদ্রা মিলিয়ে ঘুরে বেড়াতাম জেলে নৌকায় করে। থাকতাম দিনের পর দিন, রাতের পর রাত।

এক দুপুরে দেখি ঝাপসির দোয়ায় নোঙ্গর করা কয়েকটি কাঁকড়ার নৌকা। হাতে সূতা নিয়ে বসা একজন। হঠাৎ করে টান দিলো, সূতা গুটিয়ে মুল আনলো মাছ। কী ব্যাপার? কী হচ্ছে? জেলেরা বললো, হাত বড়শি দিয়ে ওখানে মাছ হয়। অন্তত তাদের খাওয়ার মাছের ব্যবস্থা হয়ে যায় এভাবে। কাঁকড়ার কারবারে লাভ কেমন? জেলেরা এর উত্তরে যা বললো সেটা বিশ্বাস হলো না। কাঁকড়া শিকারীদের চেহারা দেখে সেই বিশাল বড় বাজার সম্পর্কে ধারণাও করা যায় না।

আমার মাছ শিকারের শুরুটা ওই ঝাপসীর খালে। জেলেদের কাছে থেকে একটা হাত বড়শি নিয়ে বসে পড়লাম। আধার হিসাবে দিলাম চিংড়ি মাছ। সূতার এক প্রান্ত আমার হাতে। অপর প্রান্তে পর পর দুটি বড়শি লাগানো। সেখানে বাঁধা একটি ঈটের টুকরো। আধার গেঁথে দিলো একজন। বড়শি মাটি ছুঁতে না ছুঁতেই মাছের টান। হ্যাঁচকা টান দিলাম। তারপর সূতা গুটিয়ে তুলে দেখি টেংড়া মাছ! নেশা লেগে গেলে সেদিন থেকে। এছাড়া সুন্দরবনে গিয়ে দীর্ঘ সময় কাটাতাম মাঝে মাঝে। তখন সময় কাটানোর জন্য এই মাছ শিকার দারুণ একটি বিষয় ছিলো।

পরবর্তীতে হুইল বড়শি নিতে শুরু করি। মাঝে মাঝে বনরক্ষীদের সঙ্গে দেখা হতো। মাছ ধরতে দেখে তারা সন্দেহ করতো না আমাকে।

মাছ ধরাটা সেই অর্থে নেশা ছিলো না। তবে সুন্দরবনে আমি মাছ ধরতে যাই, এমন কথা ছড়িয়ে যায় মুখে মুখে। বিশেষ করে দস্যুদের ভিতরেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতো। তারাও সন্দেহ করতো না। তখনও দস্যুদের সাথে সেভাবে যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। চেষ্টা করছিলাম তাদের সঙ্গে দেখা করতে। সাড়া না পেয়ে বনের ভিতরে তাদের চলাচলের পথে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতাম। যদি পথে দেখা হয়! সেভাবে দুই একটি ছোট দস্যু দলের সঙ্গে দেখা হলেও তারা এড়িয়ে গেছে। আমি বড়শি নিয়ে তবুও বসে থাকতাম গভীর বনে, সেটিই ছিলো আমার কাভার।

পাশাখালী খাল ততোক্ষণে প্রায় ভরে গেছে জোয়ারের পানিতে। পর পর দুইটা টেংড়া মাছ ধরলাম। মাছগুলো এতো বড় যে টেনে তুলতে কষ্ট হচ্ছিলো। আধা কেজি সাইজের এ জাতীয় মাছের শক্তি বেশি। হুইল বড়শি দিয়ে ধরতে গেলে সেটা টের পাওয়া যায়। মাছ ধরা দেখে ওসি সাহেব বেশ অবাক হলেন। অবাক অন্যরাও। আসলে সুন্দরবনের জলাগুলো যে কী সমৃদ্ধ তখন, বলে বোঝানো যাবে না।

দস্যুনেতা মাস্টার বলছিলো, বিষের কারণে মাছগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিষ মানে? তখন প্রথম জানলাম যে সুন্দরবনের গহীনের খালেও বিষ দিয়ে মাছ শিকার হয়। বলতে বলতে খালের ভিতর থেকে চিৎকার ভেসে আসলো। কেউ একজন বলছে যে, এই কাজ আর কখনও করবো না। কী হলো ওদিকে? ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। কোনো অঘটন না তো? কেউ কাউকে আক্রমণ করলো? সব শেষ হয়ে যাবে যদি তেমন কিছু ঘটে!

জোয়ার ধরে একটি ডিঙ্গি নৌকা এসে ভিড়েছে অফিসের পিছনের খালে। ওদিকে যারা পাহাড়ায় ছিলো তারা ধরে ফেলে তাদের। ডাক দিতেই দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলো তারা। পরে বন্দুক উঁচিয়ে ধমক দিলে দাঁড়িয়ে পড়ে। জেলেদের দৌড়াে পালানো দেখে সন্দেহ হয়। নৌকায় অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া যায় এক বোতল বিশ, টুনা চাল, আর বড়ফের মধ্যে মণ দুই চিংড়ি মাছ। তার মানে বিষ দিয়ে মাছ ধরছে তারা। উত্তম মধ্যম দিতে দিতে অফিসের দিকে নিয়ে আসে দস্যুরা।

দুইজন জেলে। বাড়ি কালাবগী। একটি ডিঙ্গি নৌকা, টুনা জাল আর দুই বোতল বিষ নিয়ে এসেছে তারা। এক বোতল বিষ দিয়ে ওই মাছ টুকু হয়েছে। পরের ভাটায় আবার জাল দিবে অন্য খালে। অফিসে এসেছে তারা পুকুর থেকে খাবার পানি নিতে। বললাম, বিষ নিয়ে ফরেস্ট অফিসে আসছেন আপনারা? সাহস তো কম না! ওরা বললো, চুক্তি করে মাছ ধরতে এসেছে। চুক্তি করেই চলে এসব। পরে খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম, আরও কয়েক বোতল বিষ আছে পাশের এক খালের পাশে। মাটিতে পুঁতে রেখেছে। বললাম বিষের বোতল গুলো নিয়ে আসেন।

সীমের গাছে দেয়া হয় যে কীটনাশনক। সেই বিষ দিয়ে মাছ ধরে তারা। খামোখা পরিশ্রম না করে দুই ভাটিতে নৌকা ভর্তি চিংড়ি মাছ ধরে ফিরে যায় তারা। এক বোতল বিষ দিয়ে আট মণ মাছ ধরেছে এমন দৃশ্যও পরে দেখেছি আমি। কী ভয়ঙ্কর বিষয়! খালে খালে যদি এসব বিষ পড়ে তাহলে সুন্দরবন আর থাকবে না। কিছুই বাঁচবে না। আধা ঘন্টার মধ্যে আরও কয়েকটি বোতল নিয়ে ফিরলো তারা। ছিলো সাদা পাউডারের মতো এক রকমের জিনিষ। বললো, সাদা মাছ ধরার জন্য খালে মারা হয় ওই পাউডার বিষ। মধ্য সুন্দরবনে নাকী এসব দিয়েই মাছ ধরা চলে সারা বছর।

আগেও লিখেছি, সুন্দরবনের ভিতরটা তখন নিয়ন্ত্রণ করতো বনদস্যু-জলদস্যুরা। কয়েকটি দস্যুদল এই বিষের জেলেদের পৃষ্ঠপোষকতা করতো। জেলেদের খাল বরাদ্দও করতো দস্যুরাই। বনরক্ষীরা চেয়ে চেয়ে দেখতেন। যেমন ফরেস্ট অফিসের সামনে গুলি করে হরিণ শিকারও হজম।করতে হতো তাদের। বাঘ শিকার নিয়েও ঘটেছে অনেক ঘটনা! শিকারী আর বনদস্যুরা তখন কাউকেই পরোয়া করতো না।

মাস্টার বাহিনীর দস্যুরা বলছিলো যে বিষের নৌকা থেকে তারা চাঁদা নিতো না। তবে কয়েকটি ছোট দস্যু দল এসব পরিচালনা করতো। ঢাংমারী আর বৈদ্যমারীর জেলেদের বিচরণ ছিলো বেশি। কয়রা, কালাবগীর জেলেরাও আসে।

সুন্দরবনের দস্যুদের একটা বাজে স্বভাব ছিলো। কথায় কথায় মারপিট করতো। নৌকার জিনিষপত্র লুট করতো। সেদিনও একজন একই কাজ করছিলো। বললাম, শেষ দিনে এসেও ভালো হবেন না আপনারা? অন্যের সম্পদ লুট করার এই অভ্যাস নিয়ে আত্মসমর্পণ করে লাভ হবে না। আবারও বিপথে যাবেন, আবারও বিপদে পড়বেন। সাথে সাথে অন্যরা বকাঝকা দিয়ে পরিস্থিতি ঠান্ডা করে। ওই জেলে দু’জনকে বসিয়ে বললাম, এই ডাকাতরা যা না করছে তারচেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করছেন আপনারা। সুন্দরবনটাকে শেষ করে দিচ্ছেন। কেন বিষ মারতেই হয় বলেন তো?

মহাজন এই দুই মণ মাছের দাম দিবে খুব বেশি হলে তিন হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে করবো কী? জঙ্গলে আসলে বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিয়ে আসতে হয়। ডাকাতদের চাঁদা দিতে হয়। নামার সময় ৪/৫ হাজার টাকার বাজার সদা করতে হয়। বিষের বোতলও কিনতে হয় বেশি দামে। এতো কিছু করে নামি। তারপর মাছের যে দাম ধরে তা দিয়ে খরচও ওঠে না। জাল দিয়ে মাছ ধরতে গেলে আমাদের চালানও থাকবে না। বারো মিশালী চিংড়ি মাছের দাম তখন মহাজনেরা ধরতো কেজি প্রতি ২৫/৩০ টাকা। মণ ধরতো ৪৫ কেজিতে। তার মানে আট/দশ মণের নিচে মাছ ধরে পোষাবে না।

আগে ভাবতাম সুন্দরবন উপকূলের জেলেরা জিম্মি বনদস্যুদের কাছে। পরে দেখলাম সকলেই জিম্মি কিছু মাছ ব্যবসায়ীর কাছে। অথচ ব্যবসায়ীরা বলতো তারা জিম্মি বনদস্যুদের কাছে। আর বনদস্যুরা বলতো, লাভের বড় অংশই নিয়ে যায় ওই ব্যবসায়ীরা।

সুন্দরবনের দস্যুতা নিয়ে যে সাহেব মহাজনরা সারা বছর অভিযোগ জানাতো, কান্নাকাটি করতো, সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করার পর তাঁরা কেউ একটি ধন্যবাদও জানাননি। মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর উনারা বলেছেন, দস্যু সারেন্ডার একটি নাটক। ওই সাংবাদিক আর RAB এর কিছু অফিসার পুরস্কার নেওয়ার জন্য এই নাটক করছে!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top