রূপান্তরের গল্প ৯৫ | Rupantorer Golpo 95

কঠোর গোপনীয়তায় চলছিলো সব | রূপান্তরের গল্প ৯৫

কঠোর গোপনীয়তায় চলছিলো সব | রূপান্তরের গল্প ৯৫ | Rupantorer Golpo 95 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৯৫ : শেষ জোয়ার। পশুর নদীর তীব্র স্রোত প্রায় থেমে এসেছে। জোয়ারে উঠে গেলো বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক জাহাজ। কোস্টগার্ডের একটি বড় জাহাজ গেছে মাঝ নদী দিয়ে। একই পথে উত্তরে উঠে গেছে তিনটি নৌ-বাহিনীর জাহাজ। সাগর থেকে ফিরেছে বড় দুটি মাছ ধরার টলি। শেষ জোয়ারে এসে একটি বাণিজ্যিক জাহাজ নোঙ্গর করলো আমাদের বরাবর। আরেকটি থামলো ভদ্রার একটু নিচে, মানে দক্ষিণে। পশুরের এই জায়গায় জাহাজ চলাচলের পথ নদীর পশ্চিম ঘেঁষে। মানে আমাদের বরাবর নোঙ্গর করা জাহাজটি থেকে আমাদের দেখা যাবে। বড়ই মুশকিলে পড়লাম। আমরা নিজেদের আড়াল করতে চাই আর নিত্য নতুন ঝামেলা এসে পড়ে সামনে।

বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা ওই জেলেরাও নতুন বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালো। বন বিভাগকে দিলে তাদের ধরে চালান দেয়া হবে। আবার ছেড়ে দিলে তারা আমাদের অবস্থানের খবর জেনে যাবে। যদি কোস্টগার্ড জেনে যায় যে পাশাখালীতে দস্যুরা আছে তবে অভিযান অবধারিত। শেষ সময়ে সেই সুযোগ দেয়া যাবে না। ওই জেলেদের থেকে যেতে বললাম। কাঁকড়ার জেলেদের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিলাম তাদের। নৌকাগুলো একসাথে বেঁধে রাখা হলো দস্যুদের ট্রলারের সাথে।

এক ঝাঁক সাধারণ জেলে সাথে। তাদের নিয়ে বেশ জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। কখন কী হয়ে যায় কে জানে! বড় ভয় ছিলো তাদের পালানো নিয়ে। কোনো ভাবে যদি কেউ পালিয়ে হারিয়ে যায়? সাধারণ জেলেরা ডাকাতদের বাঘের চেয়েও বেশি ভয় পায়। পালিয়ে গেলে দীর্ঘ সময় বনের ভিতরে থাকতে হয় তাদের। সেক্ষেত্রে বাঘের শিকার হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। বিশেষ করে এক দুই দিন যদি অন্য কোনো জেলেদের না পায় সেক্ষেত্রে খাবার ও পানির অভাবে শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বাঘ মামার নজরে পড়লে তখন সহজ শিকারে পরিণত হয়ে পড়ে মানুষ। একে তো জীবনটা যায়। অন্যদিকে এসবের কোনো সাক্ষী-আলামত থাকে না। তখন তার পরিবারের সদস্যরা মামলা দিয়ে দেয়। এ দফায় কেউ হারালে সেই দায় আমার ঘাড়েও পড়বে।

জেলেদের সবাইকে ফরেস্ট অফিসের ভিতরে আনতে বললাম। সবাইকে একসাথে করে এক রকম বন্দীই করে রাখলাম। কাজটি অনুচিৎ। কিন্তু উপায়ও ছিলো না। বললাম, সারেন্ডারের পর আপনাদের সুবিধা মতো জায়গায় পৌঁছে দিবো। প্রত্যককে ক্ষতিপূরণ দেয়ার সিদ্ধান্ত মনের মধ্যে রাখলাম।

নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও চিন্তা হচ্ছিলো। ট্রলারে রাখা দস্যুদের অস্ত্র আর গুলিগুলো সুরক্ষিত রাখাও ছিলো বিশাল চ্যালেঞ্জ। বার বার সবাইকে সতর্ক করেছি। কেউ ঘুমাতে পারবেন না। ট্রলারের সহযোগী মামুনকে বলেছি সবাইকে জাগিয়ে রাখতে। প্রতি ঘন্টায় চা দিতে হবে। বেলায়েত সরদার থাকবেন আমার পাশে।

যারা সারেন্ডার করবে না তারা আবারও দস্যুতায় ফিরবে। দুই একজন বাদে সকলকেই ফিরতে হবে। এটা তারা যেমন জানতো, আমিও জানতাম। তাই অস্ত্র-গুলি নিয়ে কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলা অসম্ভব ছিলো না। পরে জেনেছি, এই সারেন্ডার ভন্ডুল করে দেয়ার নির্দেশ ছিলো। শহরের বড় ভাইদের কেউ একজন বিষয়টি নিয়ে খুব সক্রিয় ছিলেন। বার বার তিনি দস্যুনেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন সেদিন। এদিক থেকে বলা হয়েছে, সারেন্ডার হচ্ছে না। যা শুনছেন সব গুজব। বনদস্যু সোহাগ এমন ভাবে কথা বললো যে শেষ পর্যন্ত সেই বড় ভাই বিশ্বাস করলেন যে আসলেই সারেন্ডার হচ্ছে না।

ওদিকে মংলায় একটা ছোট লঞ্চ ভাড়া করেছে RAB। মাছরাঙ্গা নামের সেই লঞ্চটির মালিক মংলার, নাম মিজান। পর্যটন ব্যবসায় বেশ সুনাম তাঁর। এক দুইবার চড়েছিও সেই লঞ্চ-এ। মংলা খালে নোঙ্গর করা। ঢাকা থেকে আসার যমুনা টিভির ব্রডকাস্ট টেকনিশিয়ানরা ডিএসএনজি নিয়ে উঠে পড়েছেন। বরিশাল থেকে RAB এর সদস্যরা আসলেই রওনা হবে। সময় মতো তারা পৌঁছালেই হয়। কারণ ভাটা শুরু হয়ে গেছে। বেশি দেরি করলে উজান ঠেলতে হবে। আসতে দেরি হয়ে যাবে।

সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সঙ্গে পুরো কাজটি করার চেষ্টা করেছি আমি। সেই ঢাকা থেকে রওনা হয়ে সড়ক পথ শেষ করেছি মংলায়। গোপনে গভীর রাতে ট্রলার ছেড়েছি। ঝুঁকিপূর্ণ লম্বা নদী পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছি পাশাখালী। দস্যুদের লুকিয়ে রাখা অস্ত্র বের করেছি। দলের ভিতরে যাতে কোনো ঝামেলা না হয় নিশ্চিত করেছি। পুরো দিন পার করে সারেন্ডারের জন্য প্রস্তুত করেছি সুন্দরবনের তখনকার সবচেয়ে বড় দল- মাস্টার বাহিনীকে। প্রতি মুহুর্তের ঝুঁকি সামাল দিয়েছি। সেটা সম্ভব হয়েছে গোপনীয়তার কারণে।

ওদিকে RAB বরিশালের উপ অধিনায়ক টিম নিয়ে রওনা দিয়েছেন। শুধু অফিসাররা ছাড়া কেউ জানতেন না কী হতে যাচ্ছে। বাহিনীটির গোয়েন্দা প্রধানসহ নির্দিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা জানতেন বিষয়টি। গোপনীয়তার সঙ্গে তাঁরা পুরো বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন। তাই ওদিক থেকেও কেউ কোনো তথ্য পায়নি। খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরার দায়িত্বশীল কোনো সংস্থাও টের পায়নি আমাদের কর্মযজ্ঞ।

বিকাল থেকে ফোনে কিছু বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিলাম ইচ্ছা করে। মূলত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স, দস্যুদের সহযোগী কয়েকজনকে ফোনে বিভ্রান্ত করেছিলাম যাতে আমাদের বিষয়ে কেউ কোনো ধারণা না পায়।

ফরেস্ট অফিসের ভিতরে থাকা জেলে ভাইরা খুব ভয় পেয়েছিলো। সারেন্ডার করবে না যারা তারাও ছিলো আতঙ্কিত। তাদের আতঙ্ক কমাতে হবে। বাইরের সবকিছু ঠিকঠাক করতে বলে সেখানে গেলাম। দস্যুদের বাবুর্চিকে বললাম, সবাইকে চা দেন। তরুণ এক জেলে পাশে বসে ভয়ে কাঁপছে। জড়িয়ে ধরলাম তাকে। বললাম, ভয়ের কিছু নাই। বাড়িতে পৌঁছে দিবো যাওয়ার সময়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top