রূপান্তরের গল্প ৯৭ | Rupantorer Golpo 97

সন্দেহজনক ট্রলার! অস্ত্র উঁচিয়ে প্রস্তুত দস্যুরা! | রূপান্তরের গল্প ৯৭

সন্দেহজনক ট্রলার! অস্ত্র উঁচিয়ে প্রস্তুত দস্যুরা! | রূপান্তরের গল্প ৯৭ | Rupantorer Golpo 97 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৯৭ : ঝুপ করে ওখানে সন্ধ্যা নামে না। সুন্দরবনে সন্ধ্যা নামে অনেক সময় নিয়ে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পরেও আলোর রেশ থাকে অনেক ক্ষণ। তারপর যখন চাঁদ ওঠে, তখন বড় নদীর ওপাশটাও দেখা যায়। অবশ্য দেখা বলতে পরিস্কার দেখা নয়। সেজন্য চোখ ভালো থাকতে হবে থাকতে হবে আর বন উপকূলের অভিজ্ঞতা। সুন্দনবনের মানুষ অন্ধকার রাতেও অনেক দূরের জিনিষ দেখতে পায়। শুরুতে আমি কিছুই দেখতে পেতাম না, বুঝতে পারতাম না। কিন্তু বনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে নিতে এখন দূরের জিনিষ দেখতে শিখেছি।

সন্ধ্যা নামার পর পশুর নদীর ওপাশ দিয়ে কিছু ডিঙ্গি নৌকা নামতে দেখছি। জেলেরা তখন বড় নদীতে আলো জ্বালতো না। জঙ্গল ঘেঁষে স্রোতে ভেসে চলছে তারা, একটার পিছনে আরেকটা। কীসের নৌকা ওগুলো? পাশ থেকে মাস্টার বললো কাঁকড়ার নৌকা। এতো দূরের নৌকা দেখে কী করছে বুঝছেন যে ওগুলো কাঁকড়া শিকারীদের নৌকা? বললে, আমরা বুঝতে পারি। না বুঝলে জঙ্গলে টিকে থাকতে পারতাম না।

কাঁকড়ার নৌকা থেকে কতো করে চাঁদা নিতেন আপনারা? বললেন, গোন-এ নৌকা প্রতি এক হাজার টাকা। না দিলে কী করেন? বললেন, নৌকা আটকাই। কার নৌকা জিজ্ঞেস করি। মানে কোন মহাজনের নৌকা সেটা জানতে পারলেই হলো। আমাদের চুক্তি হতো মহাজনদের সাথে। নৌকা নামানোর আগে কয়টা নৌকা নামবে সেই হিসাবে হতো চুক্তি। ব্যবসায়ী আর কিছু দালাল আছে তারা আমাদের টাকা তোলে। তারপর সেই টাকা আমাদের প্রতিনিধির কাছে পৌঁছে দিতো তারা। একই ভাবে মাছ ধরার নৌকাগুলোরও হিসাব হয়। মহাজনদের সাথে চুক্তি হয়। মাছ ধরার খাল আর জাল-নৌকার হিসাব অনুযায়ী চাঁদা দেয় তারা। বড়শির নৌকাগুলো থেকে টাকা নেই না।

এটা হলো মাস্টার বাহিনীর হিসাব। এক এক দস্যু দলের চাঁদার পরিমান এক এক রকম। পাশ থেকে আরেক জলদস্যু বললো, ব্যবসায়ীরা আমাদের ঠকায়। কী ভাবে? বলবে ৫০টা কাঁকড়ার নৌকা নামবে। কিন্তু নামাবে দেড়শ’ নৌকা। প্রত্যেকের কাছ থেকে আমাদের নামে নিবে তিন হাজার করে। আর দিবে এক হাজার করে। মানে দেড়শ’ নৌকায় গোন প্রতি সে জেলেদের কাছে থেকে নিবে তিন হাজার করে সাড়ে চার লাখ। আর আমাদের দিবে পঞ্চাশ নৌকায় এক হাজার করে পঞ্চাশ হাজার। সেটাও দিবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে।

একজন বললো, কিছু ব্যবসায়ী আমাদের বাজার সাপ্লাই দেয়। তারাও আমাদের সাথে ডাকাতি করে। সব জিনিষের দাম নেয় তিন/চার গুন। বলে ডাকাতের বাজারের রেট নাকী এমনই। আমাদের তো বড় খরচ চলে যায় বাজারেই। এতোগুলো মানুষ আমরা। খাবার পানিটাও তো কিনে আনতে হয়। অস্ত্র-গুলির হিসাব তো বলে শেষ করা যাবে না। ব্ল্যাক মার্কেটে বন্দুকের গুলির দাম ৫০০ টাকা। আমাদের কাছে থেকে নেয় ১২০০ টাকা। ডিজেল লাগে হাজার হাজার লিটার। তার দামও নেয় দ্বিগুন। আমাদের ভাই। সব কিছুতেই ম্যালা খরচ। বললাম ইনকামও তো ম্যালা। মানুষের টাকা মানুষেই নিবে। জঙ্গলে থেকে লাভ নাই। ওরা বললো, লাভ সব মাঝের লোকজনের। আমরা মারি, জেলেরা মার খায়, আর যখন তখন আমরা মরে যাই।

সাগরের দস্যুতাকে ওরা বলে কোপ দেয়া। ইলিশের মৌসুমে এই কোপ দেয়ার কারবার চলে। দূর সাগরে গিয়ে জেলে অপহরণ, মাছ ধরার ট্রলার ধরে আনতে পারলে কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। সোহাগ বললো, ইলিশের মৌসুমটা তো ডাকাতি করতে দিলেন না। বললাম, ততোদিন কী বাঁচবে নিশ্চিত? বললো, মজা করলাম ভাই। অতো ডাকাতির ইচ্ছা থাকলে কি সারেন্ডার করি?

গল্প করতে করতে দূর থেকে একটা আলো দেখা গেলো। ট্রলার আসছে উত্তর থেকে। পশুরের পশ্চিম পাড় ধরে আসছে তারা। আবার টেনশন শুরু হলো! ফিসিং ট্রলার হলে বিপদের কথা। RAB বা কোস্টগার্ড এমন ট্রলার নিয়ে অভিযান করে। ওই ট্রলার আসতে আসতে প্রায় ৪৫ মিনিট লাগবে। যদি দ্রুতগামী ফিসিং ট্রলার হয় তবে আধা ঘন্টা। সচরাচর দুশ্চিন্তা কম করি আমি। কিন্তু সেদিন একটুতেই টেনশন হচ্ছিলো।

এক দস্যু বললো, প্রশাসনের লোকজনের অভিযানে নামার কোনো খবর নাই আমাদের কাছে। টাওয়ারে ফুল টাইম লোক আছে। কোনো অভিযান নামলেই খবর পাবো। ওটা সাগরে মাছ ধরার ফিসিং ট্রলার। এছাড়া অভিযানে আসলে এভাবে আলো জ্বালিয়ে আসবে না। তবুও সবাইকে সতর্ক করে দিলাম। আমাদের ট্রলার আর দস্যুদের ট্রলারগুলো বড় নদী থেকে দেখা যায়। আলো নিভাতে বললাম। ফরেস্ট অফিসের চারপাশে লোকজন ঘোরাঘুরি করতেও না করলাম।

ফরেস্ট অফিসে আলো জ্বলে সৌরবিদ্যুতে। ট্রলারগুলোর লাইটও জ্বলে সৌর বিদ্যুতে। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকাতেও ছোট্ট সোলার প্লেট থাকে। ছোট ছোট ব্যাটেরি চার্য হয়, তাদের নৌকাতেও আলো জ্বলে সোলার পাওয়ারে। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই তারা বাতি জ্বালায় না। ছোট খালের মাথায় গিয়ে থাকতে পারলে তবেই জ্বলে আলো, চারপাশ দিয়ে ঢেকে। দূর থেকে যাতে কিছুতেই দেখা না যায়। দস্যুরাও সন্ধ্যার পর আলো জ্বালতো না। রাতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সময় একদম অন্ধকার করে চলতো তারা। সিগারেটের আগুনও দেখা যাবে না বাইরে থেকে।

সাগরেও দস্যুরা একই ভাবে চলতো। বঙ্গোপসাগরের জেলেরাও জলদস্যুদের ভয়ে অন্ধকার করেই রাখতো। সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতো যাতে রাতের বেলা দূর থেকে তাদের দেখা না যায়। সাগরে সাধারণত দস্যুরা কোপ দিতো রাতের বেলাতেই। সাগরে কিন্তু দস্যুদের ওই ট্রলারগুলো নিয়ে দস্যুতা করতে যেতো না তারা। সেজন্য সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া দ্রতগামী কোনো ফিসিং ট্রলার আসতো খুলনা বা পটুয়াখালী থেকে। আষাঢ় শ্রাবণ মাসের উত্তাল সাগরে হুট করে নামাও যায় না।

মাঝারি একটা বাইন গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমরা। অপেক্ষা করছি। ট্রলারটি পার না হওয়া পর্যন্ত অস্বস্তি কাটবে না। ওখানে মাস্টার ছিলো, সোলাইমান ছিলো। বললো, ওরা গুলির রেঞ্জ এর মধ্যে দিয়েই যাবে। ঝামেলা মনে হলে নদীতেই ডুবায়ে দিবো ওদের। বললাম, পাগলামি করো না। বাড়তি কোনো ঝামেলায় যাবে না। কোনো ভুলও করা যাবে না। মাস্টার একজনকে ইশারা করলো, কিছু একটা আনতে বললো।

ভাবলাম চা বা পান আনতে বলছে। কিন্তু ভুল ভাঙ্গলো যখন হাতে থ্রি নট থ্রি নিয়ে আসলো একজন। গুলি লোড করে সেই বন্দুক রেডি করলো মাস্টার। ততোক্ষণে পুরো অন্ধকার। দূরে জাহাজের আলো, চাইলেবগী আর ঘসিয়াঙ্গাড়ির বয়ার আলো দেখা যাচ্ছে। তখনও চাঁদ ওঠেনি বলে উত্তর থেকে আসা ট্রলারের আলো দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। অন্ধকারের জন্য শুধু লাইট দেখা যাচ্ছে, কীসের ট্রলার বুঝতে পারছিলাম না। দস্যুরা আমাকে ফরেস্ট অফিসের ভিতরে যেতে বললো। একদম নদীর পাড়ে থাকা নিরাপদ না। তবে আমি অফিসের ভিতরেও যাবো না। পাড় থেকে একটু দূরে আরেকটি বাইন গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। অন্ধকারে আমাকে সঙ্গ দিচ্ছিলো দুজন জেলে আর একজন অস্ত্রধারী দস্যু। আর মিনিট দশ এর মধ্যে আমাদের সামনে চলে আসবে সন্দেহজনক ওই ট্রলার!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top