রওনা হলাম সাঁজোয়া বহর নিয়ে | রূপান্তরের গল্প ১০৪ | Rupantorer Golpo 104 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১০৪ : সবার আগে বের হলো আমাদের ট্রলার। সুকানিতে বেলায়েত সরদার। বললাম মাঝ নদী থেকে একটা চক্কর দিয়ে আসেন। গিয়ার বদলানো হলো। বিকট শব্দে ছুটলো আমাদের ট্রলার। মাঝ নদীতে গিয়ে সামনে পিছনে সন্দেহজনক কিছু আছে কী না দেখবো। অথবা এমনও হতে পারে যে আমাদের ট্রলার দেখে ঘাপটি মেরে থাকা কোনো ট্রলার বা স্পিডবোট বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু পেলাম না। বিরাট এক চক্কর দিয়ে ফিরলাম আমরা।
পাশাখালীর খুব কাছে দুটি জাহাজ নোঙ্গর করা ছিলো। রাতের জোয়ারে সেগুলো রওনা দিয়েছে উত্তরে, বন্দরের দিকে। অনেক সময় পণ্য ভর্তি বাণিজ্যিক জাহাজ কিছু মাল খালাস করে নেয়। অগভীর নৌপথে চলার জন্য সম্ভবত এটি করা হয়। কিন্তু ওই জাহাজগুলোর সাথে থাকা লাইটারেজ জাহাজগুলো ফিরলো না। এসে নোঙ্গর করেছে আমাদের থেকে একটু উত্তরে চাইলেবগী খালের মুখে। সেখানে যে বয়া আছে তার সামনে পিছনে মিলিয়ে অন্তত পাঁচটি কার্গো নোঙ্গর করা। একদম আমাদের কাছাকাছি, জঙ্গলের গা ঘেঁষে। সম্ভবত যান্ত্রিক ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণে তারা নদীতে থেকে গেছে। থাকুক ওরা ওদের মতো। হয়তো চলেও যাবে আমরা রওনা দেয়ার আগে।
পশুর নদীর এপাশ ওপাশের অবস্থা দেখেছি। ট্রলার ভিড়ালাম পাশাখালীর মুখে জেটির সাথে। সরদারকে বললাম, ট্রলারে থাকেন। পাশাখালী ফরেস্ট অফিস প্রাঙ্গণে তখন না হলেও পঞ্চাশ জন মানুষ। বনদস্যু, তাদের পরিবার, বনরক্ষী, জেলে আর আমার সহযাত্রীরা।
দস্যুনেতা মাস্টারসহ সশস্ত্র দস্যুরা উঠলো মূল ট্রলারে। সাথে তাদের স্ত্রী সন্তান। বুলেটপ্রুফ বলে বলে সেই ট্রলারের সবচেয়ে সুরক্ষিত কেবিনে রাখা হলো নারী ও শিশুদের। মাস্টার বাহিনীর দ্বিতীয় অর্থাৎ ছোট ট্রলারটিতে উঠলো নিরস্ত্র দস্যুরা। মানে যারা সারেন্ডার করবে না তারা। নৌকাগুলো ভাসানো হলো। জেলেরা যার যার নৌকায় উঠে পড়লো। যার যার ফোন ফেরত দিলাম। শুধু অনুরোধ করলাম যেন কেউ ফোন অন না করে। দস্যু জাহাঙ্গীরের ওই আত্মীয়কেও তার ফোনটা ফেরত দিলাম। সবাই যার যার জিনিষপত্র বুঝে পেয়েছেন। নৌকাগুলো পানিতে ভাসালেন সবাই। আমি উঠলাম মাস্টার বাহিনীর মূল ট্রলারে। রাত তখন সোয়া ১২টা, ২৮ মে ২০১৬।
শুরুতে বেলায়েত সরদারের ট্রলার। তারপর বনদস্যু মাস্টার বাহিনীর প্রধান ট্রলার। তার পিছনে তাদের আরেকটি ট্রলার বাঁধা। যেটাতে নিরস্ত্র দস্যুরা আছে। পিছনের ট্রলারের সাথে বাঁধা ডিঙ্গি নৌকাগুলো। নৌকার জেলেরা যার যার নৌকায়। সবাইকে টেনে নিবো আমরা। পাশাখালী ফরেস্ট অফিসের ওসি সাহেব ও বাঁকী বনরক্ষীদের বিদায় জানালাম। গলদা চিংড়ি ধরতে আসা রায়েন্দার জেলে সাদ্দামকে রেখে গেলাম পাশাখালীতে। চিৎকার করে সে বললো, এই কাজটা করতে পারলে আমাদের খুব উপকার হবে। আপনার জন্য দোয়া করবো আমরা। কথাটি অনেকেই অনেককে বলে। কিন্তু ওই সময় সাদ্দামের সেই দোয়া করার কথাটা মনে হলো একদম স্বতস্ফূর্ত, ভিতর থেকে বলা। কেমন জানি শান্তি শান্তি লাগলো।
ইঞ্জিন চালু হলো। এগিয়ে চললো আমাদের নৌকা বহর। জোয়ারের স্রোত আর বাতাসের দিক ছিলো দক্ষিণ থেকে উত্তরে। তাই পশুর নদী তখন একদম পুকুরের মতো ঠান্ডা। ঢেউ নাই একদম। নদী সাগরে চলতে গেলে জোয়ার ভাটা আর বাতাসের দিক ও গতি বিবেচনা করে চলতে হয়। সেই হিসাব না বুঝলে বিপদ হবে পদে পদে। বিপদ এড়াতে আমরা ওই পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলি।
সামনে চাইলেবগীর বয়া দেখা যাচ্ছে। তার আগে পরে কয়েকটা কার্গো। ঘন্টা খানেক আগে তারা জঙ্গল ঘেঁষে নোঙ্গর করেছিলো। শুধু সিগন্যাল বাতি জ্বালানো। সবাই মনে হয় ঘুম। আমরা কোনো ঝুঁকি নিবো না। একটু দূর দিয়েই যাবো। কারণ কোনো ভাবে যদি জাহাঙ্গীর বাহিনী ওই জঙ্গলে অ্যামবুশ করে থাকে? তাহলে গুলির রেঞ্জ এ থাকা যাবে না। পশুর নদীর প্রায় মাঝামাঝি চলে গেলাম। গন্তব্য ভদ্রার ঠোঁটা।
মেজর আদনানের সঙ্গে আর কথা হয়নি। নেটওয়ার্ক-এ পাইনি। অবশ্য তার প্রয়োজনও নাই। সব ঠিক থাকলে আমি খুঁজে নিবো ওদের। যদিও বিশাল ওই পশুর নদীতে তাদের লঞ্চটি অতি ক্ষুদ্র, তবুও জঙ্গল নদীতে তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে। আকাশ পরিস্কার থাকলে রাতের বেলা ওদিকে নৌকা-ট্রলার বা লঞ্চ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন কিছু না।