শুরু হলো দূতিয়ালী | রূপান্তরের গল্প ১০৮ | Rupantorer Golpo 108 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১০৮ : ও বেলায়েত ভাই, ট্রলার নিয়ে বেশি দূরে যাবেন না। লঞ্চ-এর চারপাশ দিয়ে ঘুরতে থাকেন। পরে খুঁজে পাবো না! লঞ্চ-এ কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবো না আমি… বেলায়েত সরদার বললেন নদীর কূলে যেতে হবে। এখানে দাঁড়ানো যাবে না। আসলে ওই ট্রলার নিয়ে তখন মাঝ পশুরে দাঁড়ানোর অবস্থা নাই। আবারও বললাম, হাতে সময় নাই। সবচেয়ে কঠিন সময় এটাই। হাত উঁচিয়ে বিদায় নিলো ট্রলার।
আসেন মামা। মোস্তাফিজ মামা পথ দেখালেন। লঞ্চ-এর করডোর পেরিয়ে সিঁড়ি। দ্বিতীয় তলায় উঠেই দেখা আদনানের সঙ্গে। সালাম বিনিময় হলো। পরিচয় হলো বরিশাল RAB এর আরও তিন কর্মকর্তার সঙ্গে। আদনানকে দেখে মনে হলো টেনশনে শেষ! কী একটা অবস্থা! বসলাম পাশে রাখা চেয়ারে। বললাম, এক কাপ চা খাওয়াও। পরিচয় হলো বাঁকীদের সঙ্গে।
লঞ্চ এর সামনে ডেক এ বসা আমরা চারজন। ভাটার সময় বলে মুখটা উত্তর দিকে ঘুরে আছে। ওখান থেকে ভদ্রার ঠোঁটা দেখা যাচ্ছে আবছা। কিন্তু অন্ধকারের কারণে দস্যুদের ট্রলারগুলো ঠিক দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে সিগারেটের আলো দেখছি শুধু। কী খবর এদিকের? আসতে দেরি হলো কেন? আদনান বললেন, সবকিছু গুছিয়ে আসতে দেরি হলো। আর নদীর ব্যাপার স্যাপার তো বোঝেনই ভাই। আমাদের লাইভের যন্ত্রপাতি উঠাতে যে সময় নষ্ট হয়েছে, সে কথা বললেন না।
চা আসলো। লাল চা। সঙ্গে নোন্তা বিস্কিট। বললাম পানি খাবো। লাল চা ভালো লাগে না। তবুও চুমুক দিলাম। আমাদের ঘিরে একটু দূর দিয়ে দাঁড়ানো মোস্তাফিজ মামাসহ অন্যরা। সকলেই আমাকে দেখছেন চোখ বড় বড় করে। সম্ভবত কী হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে পরিস্কার জানতেন না সবাই।
আদনানের প্রশ্ন, ওদিকের কী অবস্থা ভাই? পশ্চিম দিকে তাকিয়ে বললাম, ওই যে ভদ্রার ঠোঁটায় অপেক্ষা করছে মাস্টার বাহিনী! চমকিত, উত্তেজিত আদনানের পরের প্রশ্ন, কয়জন? সারেন্ডারে আগ্রহীদের সংখ্যা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন মেজর সাহেব। বললেন মাত্র এই কয়জন?
সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুদল সারেন্ডার করবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন। মাত্র এই কয়জনকে নিয়ে সারেন্ডার? মুখে না বললেও বুঝতে পারছিলাম আশাহত তিনি। পাশের কর্মকর্তাদের একজন জিজ্ঞেস করলেন, কোন বাহিনী এটা? বললাম, মাস্টার বাহিনী, সুন্দরবনের দস্যু মাস্টার বাহিনী।
মেজর আদনান স্তম্ভিত। কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা নাই। মনে হচ্ছিলো আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে মাথায়। একটু মজা করবো ভাবছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি তখন তেমন না। বললাম অস্ত্র-গুলি সবগুলো নিয়ে আসছি! বললেন, কয়টা অস্ত্র ভাই? বললাম, ৫১টা বন্দুক। গুলি আছে অনেকগুলো। কতোগুলো? বললাম, গণে শেষ করতে পারিনি। জমা হললে তোমরা গণনা করে নিও।
সবগুলো অস্ত্র এখানেই আছে? গুলিগুলোও? বললাম, সব ওই ট্রলারে। বাঁকী দস্যুরা কোথায়? বললাম, সারেন্ডার যারা করবে না তারাও আছে ওখানে। বেশ কয়েকজন জেলেও আছে সাথে। বাঁকীদের মধ্যে আর কেউ সারেন্ডার করবে না? বললাম, জোর করে কাউকে আত্মসমর্পণ করানো উচিৎ হবে? আদনান বললেন, একদম না। অস্ত্র-শস্ত্র সব জমা দিচ্ছে তাতেই চলবে।
পাশ থেকে একজন বললেন, গোলাবারুদ সব জমা দিচ্ছে এই বাহিনী? বললাম, জঙ্গলের ভিতরে একসাথে ৫১টি বন্দুক ধরেছেন কখনও? সাথে সাথে কথা ঘুরিয়ে বললাম, তিন জায়গায় মাটির নিচ থেকে লুকিয়ে রাখা অস্ত্র বের করেছি। পুকুরের নিচ থেকে লুকানো অস্ত্রও বের করেছি। আমার জানা মতে সুন্দরবনের ভিতরে এই দস্যু দলের আর কোনো অস্ত্র নাই। আদনান বললেন, এবার তাহলে কী করবো আমরা? বললাম, বনদস্যুদের নিয়ে আসবো, তোমাদের হাতে তুলে দিবো। তারপর বাঁকী কাজ তোমাদের।
সুন্দরবনে দস্যুবিরোধী অভিযান তখন নিত্যদিনের ঘটনা ছিলো। RAB এর খুলনা ও বরিশাল ব্যাটেলিয়নের অন্যতম প্রধান কাজ ছিলো সুন্দরবনের দস্যু দমন। কোস্টগার্ডের সক্ষমতা বাড়ানো হয়ে হত কয়েক বছর ধরে। ২০০৯ থেকে শুরু করে তখন ২০১৬। কোস্টগার্ডের কাজের আওতা ও সক্ষমতা বাড়ছিলো প্রতিনিয়ত। এর বাইরে পুলিশও অভিযান চালাতো মাঝে মাঝে। ২০১০ এর দিকে সুন্দরবনের দস্যুদের দমনে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে বাংলাদেশ সরকার। সেই টাস্কফোর্স এর নেতৃত্বে ছিলো RAB। লিডিং প্রতিষ্ঠান হিসাবে RAB বেশ তৎপর ছিলো শুরু থেকে। এক রকম যুদ্ধ ঘোষণা করা হয় দস্যুদের বিরুদ্ধে। ব্যাপক অভিযানে কোণঠাসা দস্যু দলগুলো।
আমার কাজটা শুরু হয় ওই সময়ে। জঙ্গলের দস্যুরা আর বের হওয়ার পথ পাচ্ছিলো না। সাধারণ আত্মসমর্পণের রাস্তাও বন্ধ। আবার চলমান অভিযানে দস্যুতা নির্মূলের সম্ভাবনা খুব কম। সেই সুযোগটি কাজে লাগানোটা ছিলো উইন উইন সিচুয়েশন।
তাহলে তোমরা প্রস্তুত? নিয়ে আসবো ওদের? মেজর আদনান বললেন, যান। RAB এর সেই মোস্তাফিজ মামাকে নিয়ে হাঁটা দিলাম। লঞ্চ-এর দুই তলার ডেক থেকে নামলাম। নিচ তলায় যেখান থেকে উঠেছিলাম সেখানে এসে দাঁড়ালাম। নদী তখন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। জোয়ার সম্ভবত শেষের দিকে।
বিশাল নদী পশুর। কোথায় কে? সরদারেরর ট্রলার দেখি না। ভদ্রার ঠোঁটাও দৃষ্টি সীমানার বাইরে। তীব্র স্রোতে লঞ্চ-এর নোঙ্গর উঠে গেছে। আমরা চলে এসেছি আরও দক্ষিণে। আকাশে মেঘ জমেছে ততোক্ষণে। চারপাশ অন্ধকার!