রূপান্তরের গল্প ১১০ | Rupantorer Golpo 110

হারিয়ে ফেলললাম সরদারের ট্রলার | রূপান্তরের গল্প ১১০

পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম!| রূপান্তরের গল্প ১১০ | Rupantorer Golpo 110 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১১০ : একলাফে ওপাশে যেতে না পারলে পড়ে যাবো পানিতে। পানি মানে পশুর নদী। তাও আবার মধ্য সুন্দরবনে। সেখানে নদীটি প্রস্থে অন্তত চার কিলোমিটার। ভাটার দক্ষিণমুখী স্রোতের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে উত্তরমুখী বাতাসের। টগবগ করছে পানি। শুধু ওপাশে পৌঁছালেই হবে না। ট্রলারের ওই তক্তার উপর পা রেখে শরীরটাকেও সামলাতে হবে। এই নির্ঘুম শরীর নিয়ে সেই কাজটা পারবো তো?

লং জাম্প-এ ভালো ছিলাম না কখনও। তবুও লাফ দিয়ে ফেললাম। পশুর নদীর উথাল পাথাল রোলিং-এর মধ্যে এই দূরত্ব পার হতে পারবো ভাবিনি। কিন্তু কোত্থেকে যে শক্তি আসলো! দিলাম লাফ। ভাবছিলাম পড়ে গেলেও কিছুক্ষণ ভেসে থাকতে হবে। সাঁতারে ভালো না। কিন্তু কিছুক্ষণ হয়তো ভেসে থাকতে পারবো। আর আমি জানি সেই সময়ের মধ্যে মামুন ও বেলায়েত সরদার আমাকে ধরে ফেলবেন। লাইফ জ্যাকেট না থাকলেও ট্রলারে মাঝারি আকারের তেলের ড্রাম থাকে। সুন্দরবন ও সাগরে ডুবে যাওয়া ট্রলারের জেলেরা এই ড্রাম ধরে ভেসে থাকেন, জীবন বাঁচান। পড়ে গেলে আমারও হয়তো জীবন বাঁচবে ওই খালি ড্রাম ধরে।

পা পড়েছে পাটাতনে। ঠিক ঠাক শরীরটাকে সামলানোর সুযোগ নাই। শক্ত হাত দুটো দিয়ে মামুন জড়িয়ে ধরলো আমাকে। পড়িমরি করতে করতে পড়েই গেলাম। আমার পক্ষে এর বেশি সম্ভব না। ব্যাথা পেয়েছি ভালোই। কিন্তু হাত-পা ভাঙ্গেনি। একটি হাঁটুর এক পাশ কেটে গেছে। ডান হাত দিয়ে নিজেকে সামলাতে গিয়ে কনুই-এও ব্যাথা পেলাম। সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করেছি।

সুকানিতে দাঁড়িয়ে এসব দেখছেন সরদার। উঠে দাঁড়াতে দেখে বিরাট একটা হাসি দিলেন তিনি। সেই পরিচিত হাসি। বললেন, ও ভাই, কিরাম করে ঝাঁপ দিলেন? খুব ভালো, খুব ভালো! ওদিকে লঞ্চ-এর লোকজন তাকিয়ে দেখছেন। ঘুরে তাকিয়ে মোস্তাফিজ মামাকে হাত তুলে বিদায় জানালাম। বললাম, লঞ্চটা নিয়ে নদীর পশ্চিম দিকে এগিয়ে আসেন।

মুখ ঘুরিয়ে ছুটলো ট্রলার। তবে রওনা দেয়ার আগে RAB-এর লঞ্চ এর চারপাশে একটা চক্কর দিলাম। সরদারের পাশে গিয়ে দাঁড়লাম। নিজের হাত পা গুলো নেড়েচেড়ে দেখলাম। নাহ! শরীর একদম ঠিকঠাক। ব্যাথা পেলেও সহ্য করতে পারছি। সরদারের দিকে তাকাতেই বললেন, ট্রেনিং কিন্তু ভালো হইছে ভাই! লাফটাও ভালো হইছে। বললাম, যদি পানিতে পড়তাম? কী হতো তখন? বাঁচতাম কেমন করে? বললেন, পানিতে পড়লে আপনার কাজ শুধু কিছুক্ষণ ভেসে থাকা। দেখতেন তার পর কী করি! বললাম, কী করতেন? বললেন, সেরকম কিছু হলে সাথে সাথে আমিও ঝাঁপ দিতাম।

এখন ভাটা। আপনি ভাসবেন উজানের দিকে। আপনি ডুব দিয়ে ওঠার আগেই ধরে ফেলতাম। মামুন লাফ দিতো ওই তেলের টব নিয়ে। টব মানে ত্রিশ লিটার তেল নেয়ার প্লাস্টিকের ড্রাম। আসলে এমন পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি তাদের সব সময় থাকে। কখন কী করা লাগবে তা বলে দেয়াও লাগে না।

RAB-এর লঞ্চ-এর দিকে তাকিয়ে দেখি সবগুলো আলো জ্বালানো হয়েছে। নড়াচড়া করছেন তাঁরা। সামনের দিকে নোঙ্গর তোলা নিয়ে এখনও ব্যস্ত কর্মীরা। কালো পোশাকের এলিট ফোর্স সদস্যরা প্রস্তুত হচ্ছেন। বনদস্যুদের গ্রহণ করার সময় এসে গেছে।

ভাবছিলাম এই মোস্তাফিজ মামাটা কে? RAB এর বহরের সবকিছু তাঁর নির্দেশে চলছিলো। সদস্যরাও উনার কথায় উঠছেন বসছেন। লাফ দেয়ার আগে তাই উনাকে বলে আসলাম, এদিক থেকে কোনো ভুল যেন না হয়। ওদিকে আট জনের হাতে অস্ত্র আছে। সেগুলো ভর্তি গুলি। বাঁকীদের হাত খালি। ওখানে আছেন আমার সহকর্মীরা। আছে দস্যুনেতা মাস্টার ও সোহাগ আকনের স্ত্রী-সন্তানেরা। বললাম, এদিক থেকে কোনো ভুল হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ওদিকটা আমি দেখবো। মোস্তাফিজ মামা হলেন, বরিশাল RAB এর মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দাদের প্রধান।

নানা ঝামেলায় আমার সহকর্মীদের খোঁজ নিতে পারিনি। মোস্তাফিজ মামা জানালেন, স্যাটেলাইট ডিভাইস নিয়ে আসা ব্রডকাস্ট টেকনিসিয়ানরা কেবিনের ভিতরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এদিকে আমার সঙ্গে আসা সহকর্মীরা আছেন ওই ভদ্রার মুখে, বনদস্যুদের ট্রলারে।

বিকট শব্দে ছুটছে ট্রলার। উথাল পাথাল নদী পথে চলছি আমরা। আমার দৃষ্টি সুন্দরবনের পশ্চিম তীরে। এর মধ্যে ভুতের মতো চা-এর মগ নিয়ে দাঁড়ালো মামুন। এর মধ্যে চা? কেমন করে পারো তোমরা? বললো, এক কাপ চা বানানো কোনো ব্যাপার হলো ভাই?

দখিণা বাতাস, পানির ঝাপটার মধ্যে আড়াআড়ি চালানো কঠিন। তাই একটু আঁকা বাঁকা পথে চলছে ট্রলার। ক্যাপ্টেন বেলায়েত সরদার এই কাজে ওস্তাদ। ঢেউ, স্রোত, বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়া সহজ না। বিশেষ করে রাতের বেলা সেই কাজ অনেক কঠিন। কিন্তু সরদার যখন হাল ধরেন তখন সেই ঝক্কির পথ পাড়ি দেয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করি না। জানি, সময় মতো পৌঁছে যাবো গন্তব্যে।

এবার জায়গায় পৌঁছাতে আধা ঘন্টা লেগে গেলো। দস্যুনেতা মাস্টার দাঁড়ানো ট্রলারের উপরে। হাতে বন্দুক নাই। কাছে আসতেই বললেন, মেজর স্যার কি আসছেন? মানে আদনান স্যার আছেন ওখানে? বললাম, সবাই আছে। এখন আমাদের কাজ। ওরা প্রস্তুত। আপনাদের নিয়ে রওনা হবো এখনই। সবাই তৈরি হন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top