সারেন্ডারের জন্য তৈরি হন | রূপান্তরের গল্প ১১১ | Rupantorer Golpo 111 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১১১ : অস্ত্রগুলো লোড করেই যাবেন? ওদিকে সবকিছু কিন্তু ঠিকঠাক। কোনো ঝুঁকি নাই। দস্যুদের উদ্দেশ্যে বললাম কথাগুলো। বলছি, আমি নিজে সবকিছু দেখে আসলাম। বিস্তারিত কথা হয়েছে মেজর আদনান কবীরের সাথে। লঞ্চ-এ আমাদের লাইভ টিমও আছে। আর আপনাদের সাদরে গ্রহণ করার সব পরিবেশই করা আছে। নিজের চোখে সেটি দেখেও আসলাম। দস্যুদের ট্রলারের সঙ্গে আমাদের ট্রলার ভিড়াতে ভিড়াতে কথা হচ্ছিলো সোহাগ আকন-এর সাথে। মোস্তফা শেখ ওরফে মাস্টার দস্যুদলের নেতা হলেও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে সোহাগের ভূমিকা ছিলো বেশি।
ভদ্রার ঠোঁটায় পানি একদম শাস্ত। ট্রলার টবারে রেখে একটু একটু করে আগাচ্ছি। টবার মানে ইঞ্জিন নিউট্রালে রাখা। ওই ট্রলারের ছাদে দাঁড়ানো মাস্টার। কোমড়ে এক হাত। আরেক হাতে সিগারেট। আবছা অন্ধকারেও তার চোখের ভাষা মনে হয় পড়তে পারছিলাম।
ভদ্রা নদীতে তখন ভাটার স্রোত বইছে। পানি নামছে সরসর করে। মোহনার পানি ঘুর্ণি খেতে খেতে বড় নদীতে গিয়ে পড়ছে। উল্টোপাশে ভদ্রা ফরেস্ট অফিস। আগের মতোই আলোগুলো নিভানো। সৌর বিদ্যুতে চলা একটি মাত্র বাল্ব জ্বলছে জেটিতে। ফরেস্টের ট্রলারটিও একই জায়গায় রাখা। নতুন কোনো বিপদের গন্ধ নাই। কিন্তু বেশ কয়েকটা নতুন মুখ দেখছি এখানে। নৌকার সংখ্যা বেড়েছে। ঘটনা কী? এরা কারা?
ঘন্টা খানেকের জন্য আমি ছিলাম না এখানে। এর মধ্যে জোয়ার শেষে ভাটা শুরু হয়েছে। সেই ভাটায় ভদ্রা নদীর বিভিন্ন পাশ খাল থেকে জেলেরা বের হয়েছেন। ভাটার স্রোতে তারা নেমে যাবে আরও নিচে। পাশাখালী, ইলশেমারী, বেলমারী, নিশানখালীসহ বিভিন্ন খালে কাঁকড়া ধরবে তারা। কিন্তু ভদ্রার গোঁড়ায় আসতেই মাস্টার বাহিনীর মুখোমুখি। সেই জেলেদের তখন আটকে দেয় দস্যুরা। ভদ্রার ঠোঁটা জায়গাটি এমন যে নদীর ভিতর থেকে বের হওয়ার সময়ও তারা খেয়াল করতে পারেনি যে এতোগুলো ট্রলার-নৌকা এখানে আছে। বললাম, সুন্দনবন ভর্তি শুধু কাঁকড়ার নৌকা দেখি।
এতো কাঁকড়া ধরেন উনারা? শুনলাম টনকে টন কাঁকড়া ওঠে প্রতিদিন। কোটি টাকার ব্যবসা। সুন্দরবনের অর্থনীতি নাকী এই কাঁকড়াই নিয়ন্ত্রণ করে। আবার জলদস্যুতাসহ বন উপকূলের নানা অপরাধেও এদের ব্যবহার করা হয়। শিকারীরা এদের সাথে ভাব করে জঙ্গলে নামে। বনদস্যুদের অস্ত্রশস্ত্র পৌঁছে দেওয়া, দূতিয়ালী করার কাজটাও এদের মধ্যে কিছু জেলে করতো। বললাম, কোটি কোটি টাকার কারবার হলে এই জেলেদের চেহারা এমন কেন? ভাঙ্গা নৌকায় ছেঁড়া কাপড় তো পড়ে থাকার কথা না। একজন বললো, বড় বড় কাঁকড়ার ব্যবসায়ীরা সী-প্লেন এ চড়ে এদিকে আসেন। বললাম, বুঝেছি এবার।
জলদস্যুরা প্রতি মুহুর্তে সতর্ক ছিলো। কারণ এই অঞ্চলেই কোথাও আছে জাহাঙ্গীর বাহিনী। আবার বন বিভাগের টহল দল কিংবা কোস্টগার্ডের স্পিডবোট চলাফেরা করে এদিক দিয়ে। ভাটায় ছেড়ে আসা নৌকাগুলো আটকে রাখা হলো। কারণ শেষ মুহুর্তে কোনো ঝুঁকিতে যাবো না। জেলেরা বলছিলো, আমাদের একটু ছেড়ে দেন। অনেক দূর যেতে হবে। দেনা দায়ে জীবনটা শেষ। পরের জোয়ারে দাওন ফেলতে হবে। দাও মানে বড়শির মতো কাঁকড়া ধরার ব্যবস্থা। কয়েকটি নৌকা আবার চারো বোঝাই করা। চারো মানে চাঁই। বাঁশ দিয়ে তৈরি খাঁচার মতো। বললাম, এই চারো দিয়ে তো কাঁকড়া ধরা সুন্দরবনে নিষেধ। যেখানে যাচ্ছেন সেটাও অভয়াশ্রম। বন বিভাগ ধরতে পারলে তো জেল-জরিমানা হয়ে যাবে।
তরুণ এক কাঁকড়া শিকারী বললো, সবকিছু ম্যানেজ করেই তো যাওয়া লাগে। ঘাটে ঘাটে টাকা না দিয়ে তো আর এই কাজ করি না। এছাড়া ডাকাদ দলকে টাকা দেই গোন-এ নৌকা প্রতি তিন হাজার। বললাম, মাস্টার বাহিনীকে টাকা দিয়েছেন? বললো, হাঁ দিছি তো। না দিলে জঙ্গলে আসতে পারতাম? বললো, নৌকা প্রতি মাস্টারের জন্য তিন হাজার করে দিয়ে নামছি। মাস্টার বললেন, কার কাছে দিছো? ছেলেটি বললো, ওমুক কোম্পানীর কাছে। কোম্পানী মানে হলো মহাজন। ছেলেটি বললো, আমরা একসাথে ৭০ নৌকা নামছি এই গোন-এ।
দুই লাখ দশ হাজার টাকা শুধু ওই কোম্পানীকে দেয়া লাগছে মাস্টার বাহিনীর জন্য। আরও খরচ তো আছেই। এছাড়া জাহাঙ্গীর বাহিনী আর নোয়া বাহিনীর জন্যও দুই হাজার দেয়া লাগছে। মাস্টার বললেন, তোমাদের ওই কোম্পানী তো বললো নৌকা নামবে ৩০টা। টাকা দিবে বললো সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকা। তার মানে মাঝখানের লোকজন বাঁকী টাকা খেয়ে ফেলছে। বলেই মাস্টার বললেন, আমরা হলাম চোর। আর আমাদের সাথে বাটপারী করে কোম্পানীগুলো!
তখন রাত সাড়ে ৩টা। আধা ঘন্টার কথা বলে গেছিলাম RAB এর লঞ্চ-এ। কিন্তু দেড় ঘন্টা পর ফিরেছি। রোলিং আর জোয়ার ভাটার প্যাঁচে পড়ে দেরি হচ্ছে সেটা তো তারা জানে না। তাই একটু টেনশনে পড়েছিলো সবাই। ওই ট্র্রলারে আমার সব সহকর্মীরা। পলিনকে জিজ্ঞেস করলাম, এদিকে সব ঠিক তো? বললেন, জ্বি ভাই। সব ঠিকঠাক। ওদিকে দস্যুদের ট্রলারের ছাদে দাঁড়ানো মাস্টার। ছোটখাটো মানুষটিকে তখন আরও ছোট মনে হচ্ছে।
আমাদের ট্রলার ভিড়লো। বেঁধে ফেলা হলো দস্যুদের মূল ট্রলারের সাথে। নামবো এক লাফ দিয়ে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে টের পেলাম যে আমার পা-এর অবস্থা ভালো না। ততোক্ষণে ব্যাথাটা টের পেলাম। মামুন এসে হাতে ধরে পার করে দিলো।
পা-এ কী হলো ভাই? ভালো মানুষটা গেলেন। বললাম পুরো ঘটনা। হাসাহাসি হলো। ততোক্ষণে উৎকষ্ঠার পরিবেশ কেটে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলো।
শেষ পর্যন্ত আপনাদের বনদস্যু জীবনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে ভাই। ওই ট্রলারে উঠে মাস্টারের কাঁধে হাত রাখলাম। উনি জড়িয়ে ধরলেন। দস্যুরা সবাই ঘিরে ধরলো আমাকে। মেজর আদনানের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত জানালাম। বললাম, সবকিছু আমি যে ভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম সেভাবেই হচ্ছে। আপনাদের তুলে দিবো আদনানের হাতে। তুলে দিবো অস্ত্র-গুলি আর আপনাদের এই ট্রলার। ভোরবেলা আনুষ্ঠানিক ভাবে আপনারা RAB-এর হেফাজতে যাবেন। হস্তান্তরের পডরো সময়টা আমরা সরাসরি দেখাবো যমুনা টিভিতে।
পিছন থেকে একজন বললো, ও ভাই, ওখানে খুলনার RAB নাই তো? নাই। কিন্তু থাকলেই সমস্যা কী? এতো ভয় পান কেন? সকালে স্বরাষ্ট্রমস্ত্রীর কাছে অস্ত্র জমা দিবেন। জেলখানায় যাবেন সোজা। এর মাঝখানে কেউ আপনাদের গায়ে হাত দিবে না। তাকে থামিয়ে দিয়ে সোহাগ বললো, আমাদের ট্রলারটাও কি জমা নিবে RAB? বললাম, অবশ্যই। দস্যুতায় ব্যবহার করা প্রতিটি জিনিষ সমর্পণ করবেন আপনারা। সবকিছু গুছিয়ে নেন। নদীতে কিন্তু অনেক বেশি রোলিং। কেমন করে পার করবো জানি না। মাঝ নদীতে এটা সম্ভব না। ওদের এই পাশে কাছাকাছি আসতে বলেছি। কিন্তু বাতাস না কমলে ট্রলার থেকে লঞ্চ-এ ওঠা কঠিন হয়ে যাবে।
দস্যুরা তাদের জিনিষ পত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। ছোট ছোট ব্যাগ। তাতে দু’টি লুঙ্গি, জামা, গেঞ্জি, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ ইত্যাদি। মানে জেলখানায় যাওয়ার সময় যা যা নিতে হয় সেটুকু। অস্ত্রশস্ত্রগুলো এখানে সেখানে ফেলানো। সোলাইমানকে বললাম, সবচেয়ে জটিল সময় পার করছো তোমরা। সারেন্ডার না করা দস্যুরাও আছে। তাদের মধ্যে কোনো কু-মতলব থাকতে পারে। RAB এর কাছে না যাওয়া পর্যন্ত তোমরা নিরাপদ না। অস্ত্রগুলো হাতে রাখো। সতর্ক থাকো।
সবগুলো বন্দুকে গুলি ভরা। মানে যে কেউ হাতে নিয়ে বিরাট একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। এখন যদি কিছু হয় তাহলে আমি নিজেও মারা যেতে পারি, যে কেউ মারা যেতে পারে। এখানে ভাবীরা আছে, বাচ্চারা আছে। সতর্ক হও সবাই। যারা আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে তাদের সবাইকে ডাকলাম। শেষ মুহুর্তে কী ভাবে কী হবে তা বুঝিয়ে দিবো। আটজন এসে দাঁড়ালো সামনে। একজনকে দেখছি না। সুলতান কাকা কই?