মৃত্যু আতঙ্ক দস্যুদের চোখে-মুখে | রূপান্তরের গল্প ১১২ | Rupantorer Golpo 112 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১১২ : অস্ত্রগুলো আপনাদের হাতে নাই কেন? যার যার অস্ত্র আর গুলিগুলো নিজের হেফাজতে রাখবেন। মনে রাখবেন, এই সময়ে কোনো ভুল করা যাবে না। আপনাদের অসাবধানতায় আমাদের যে কারও মৃত্যু হতে পারে। বন্দুকের গুলি কিন্তু আমাকে চিনবে না! দস্যুদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলছিলাম কারণ মাস্টারসহ দুই/তিন জনের গুলি ভর্তি অস্ত্র পড়ে ছিলো এখানে সেখানে। সোলাইমান বললো, এই অস্ত্র ছাড়া আমাদের এক মুহুর্তও চলতো না। শরীরের অংশ হয়ে গেছিলো বন্দুকগুলো। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে এর ওজন অনেক বেড়ে গেছে। বইতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে কখন জমা দিবো এগুলো।
ভদ্রার ঠোঁটায় একটার সাথে একটা বাঁধা ট্রলার আর নৌকাগুলো। পুরো বহরটি বেশ বড় হয়ে গেলো। তিনটি ট্রলার আর সাথে ২৫/৩০ টি কাঁকড়ার নৌকা। সারেন্ডার করবে যারা তারা আমার চারপাশে দাঁড়ানো। মাস্টার বাহিনীর মূল ট্রলারে এভাবে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিলো। পা ব্যাথা করছে। সবাই নিয়ে আসলাম আমাদের ট্রলারে। তখনও সুলতান কাকার খবর নাই।
সুলতান কাকাকে পাওয়া গেলো? চিৎকার করে জানতে চাইলাম। ফজলু বললো, কাকা নামাজ পড়ে। দেখি সুন্দরবনের পুরনো জলদস্যু সুলতান সাদা পঞ্জাবী আর নতুন লুঙ্গি পড়েছেন। মাথায় সাদা নামাজের টুপি।
ট্রলারের গলুই-এ নামাজ পড়ছেন কাকা। ভাবছি, দুই যুগ অপরাধে জড়ানো। ফেরারি জীবনে বৈধ পথে রোজগার করেনি কখনও। নিরীহ জেলেদের ওপর নির্যাতন করেছে, তাদের ভয় দেখিয়েছে, মারপিট করেছে, সম্পদ কেড়ে নিয়েছে, অপহরণ করে জিম্মি করেছে, মুক্তিপণ নিয়েছে। এক কথায় বছরের পর বছর সন্ত্রাশের রাজত্ব চালিয়েছে তারা। ভয়ঙ্কর হিংশ্র সেই চেহারাগুলো আজ বদলে গেলো হঠাৎ করেই।
অন্যদের ভয় দেখানো জলদস্যুদের চোখে এখন ভর করেছে ভয়। মৃত্যু আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। সাথে অনুশোচনাো অপরাধবোধ ফুটে উঠছে চেহারায়, কথা-বার্তায়। এই রূপান্তরটি দেখতে চেয়েছিলাম। সামনে অনেক পথ। কেবল তো শুরু। এতো বছরের চেষ্টায় অনেক ঝুঁকি গেছে, দায়িত্বশীলদের কাছে অসম্মানীত হয়েছি বার বার। তবুও চেষ্টা ছাড়িনি। কারণ এই প্রচেষ্টা সফল হলে জেলেদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হবে, শ্বাস নিবে সুন্দরবন। এছাড়া হাল ছেড়ে দেয়ার অভ্যাসও নাই আমার।
মামুনকে আরেক কাপ চা বানাতে বললাম। তারপর নেমে গেলাম দস্যুদের ট্রলারে। চলতি পথে কথা বললাম বাচ্চাগুলোর সাথে। অভয় দিয়ে চলে গেলাম গলুই-এ। সুলতান কাকার নামাজ প্রায় শেষের দিকে। পশ্চিম মুখ করে নামাজ শুরু করলেও নৌকা ঘুরে গেছে পূর্ব দিকে। কাছে গিয়ে দেখি বন্দুকটি পাশে রাখা। তুলে নিলাম। বন্দুক হাতে রাখাটা ভীষণ অস্বস্তির। অবৈধ অস্ত্র হাতে নেয়া আইনসিদ্ধ না। কিন্তু ওদের সাথে মিশতে গিয়ে অনেক বারই হাতে নিয়েছি নানা রকমের অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। নামাজ শেষে উঠে দাঁড়াতেই মজা করে বন্দুক তাক করলাম।
সুলতান কাকা একটা হাসি দিয়ে বললেন, এতো বছরে মরিনি কাকা। আজকে আপনি মারলে মারেন। আর ভালো লাগে না! বললাম, আমি মারতে যাবো কেন? পাশের ট্রলারে সারেন্ডার করবে না যারা তারা। একটা অঘটন ঘটালে? তখন শুধু আপনি মরবেন কে বললো? ওই অস্ত্র ধরে আমাকে বা ওই বাচ্চাদের যদি জিম্মি করতো কেউ? যদি জিম্মি করে সবগুলো অস্ত্র নিয়ে চলে যেতো ভদ্রা ধরে ভিতরে? বেঁচে থাকলেও অস্ত্র ছাড়া আত্মসমর্পণ করবেন কী নিয়ে? চেহারাটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো কাকার।
মৃত্যু আতঙ্ক দেখতে কেমন? তখন মানুষের চেহারাটা কেমন হয়? সেটা দেখেছি দস্যু জগতে এসে। যখন কাজ শুরু করি তখন দিশেহারা ছিলাম। ফোনে যোগাযোগ হয় দস্যুনেতা মোতালেব-এর সঙ্গে। দেখা হবে হবে এমন সময়ে ক্রসফায়ারে মারা যায় মোতালেব।
কথা হতো পশ্চিম সুন্দরবনের আরেক দস্যু মান্নানের সাথে। অত্যাচারী বনদস্যু তার হিসাবে পরিচিতি ছিলো। বলেছিলাম সারেন্ডার করতে। কিন্তু তার মৃত্যুও হয় RAB-এর ক্রসফায়ারে। অভ্যন্তরীন গোলাগুলিতে সুন্দরবনে কতোজন দস্যুর মৃত্যু হয়েছে সেই হিসাব করার উপায় নাই। পশ্চিম সুন্দরবনের ফজলে থেকে শুরু করে মোশাররফ কিংবা জিল্লুরের মুত্যু হয় অভ্যন্তরীন কোন্দলে। ঝাপসীর খালে আকাশ বাবু বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে মারা যায় মুকুল। গোলাগুলিতে মৃত্যু ছাড়াও ঠান্ডা মাথায় খুণ এর ঘটনা ঘটেছে অনেকগুলো। সুন্দরবনের দস্যুদের তাই মৃত্যু আতঙ্ক তাড়া করতো দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা। যখনই গেছি তাদের কাছে, বলতো, এই জীবনে চলে আসছি কিন্তু ফিরে যাওয়ার পথ নাই। অপমৃত্যুই আমাদের শেষ পরিণতি।
সুন্দরবনের দস্যুদের মধ্যে প্রথম দেখা হয় রাজু বাহিনীর সাথে। সেখানে যাদের দেখেছিলাম, তাদের অনেকেই মারা গেছে ক্রসফায়ার অথবা নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে। সেবার সাক্ষাৎকার দিয়েছিলো সাতক্ষীরার হাসান। কয়েক মাসের মধ্যে সে ঢাকা এসে দেখা করে। একটা শার্ট কিনে দিলাম। সাথে সাথে সেই শার্ট পড়ে বিদায় নেয় সে। তার চোখে-মুখেও মৃত্যু আতঙ্ক দেখেছি। ঢাকা থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার পথেই ধরা পড়েছিলো হাসান। তার মৃত্যুও হয় ক্রসফায়ারে। হাসানের সাথে সুলতান কাকার সম্পর্ক ছিলো নিবিড়। তারা দুজনে একসাথে হয়ে মাঝে মাঝে ফোনও দিতো। পরে শুনেছি হাসানকে ধরিয়ে দেয়ার পিছনে নাকী সুলতান কাকার হাত ছিলো। সেই সুলতান ডাকাত আত্মসমর্পণ করবে মাস্টার বাহিনীর সঙ্গে।
সবগুলো ট্রলার আর নৌকা বাঁধা একসাথে। গেওয়া গাছেে সাথে বাঁধা দড়ি খুলে দিলাম। ভাসলো আমাদের বহর। এর মধ্যে মামুন আসলো চা নিয়ে। ওদিকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে RAB-এর লঞ্চ। কিছুক্ষণের মধ্যে মুখোমুখি হবে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যু দল মাস্টার বাহিনী ও দস্যু দমন টাস্কফোর্স এর নেতৃত্ব দেয়া বাহিনী RAB। মাঝখানে থাকবো আমি মোহসীন-উল হাকিম।