মাঝ নদীতে মুখোমুখি আমরা | রূপান্তরের গল্প ১১৩ | Rupantorer Golpo 113 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১১৩ : ডাকসাইটে সব বনদস্যু-জলদস্যুরা তখন একটু বেসামাল। যার যার অস্ত্র হাতে তুলে নিলো। চেম্বারে গুলি ভরা আছে কী না সেটা দেখে সেফটি লক টেনে দিলো। তারা জানে সামনে আর কোনো যুদ্ধ নাই। তবুও সংশয় কাটে না যেন। আমিও বাধা দেইনি। শুধু বললাম, সেফটি লক ঠিকঠাক আছে কী না দেখে নেন। এখন আপনাদের কাজ গুলি না চালানো। যেভাবে বলবো ঠিক সেভাবে চলবেন। কোনো রকম অস্বাভাবিক আচরণ করবেন না। শুধু মনে রাখবেন মাঝে আমি আছি। ওপাশে আছেন আপনাদের আদনান স্যার।
ততোক্ষণে সুলতান কাকাও এসে দাঁড়িয়েছেন আমার পাশে। অস্ত্রটি আমার হাতে দিয়ে গুলির পোসেসটি শক্ত করে বেঁধে নিচ্ছেন কোমড়ে। নতুন লুঙ্গি, নতুন পাঞ্জাবীতে সুলতান কাকার সেই সশস্ত্র চেহারা বেমানান লাগছে। উনারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে একই পোশাক পড়বেন। কিন্তু আমি বলেছি, আপনারা যে পোশাকে থাকেন, যা পড়ে আছেন এখন সেই পোশাকেই সারেন্ডার করবেন।
তখনও পশুর নদীর মাঝ বরাবর RAB-এর লঞ্চ। উত্তর মুখে এগুচ্ছে একটু একটু করে। বলেছিলাম আমাদের দিকে অর্থাৎ পশ্চিমে এগিয়ে আসতে। কিন্তু কোনো কারণে এদিকে আসছে না লঞ্চ। হতে পারে সারেঙ এই অঞ্চল সম্পর্কে জানেন না। চরে আটকে পড়ার ভয় থাকে। আর ভাটার সময় আটকা পড়লে পরের জোয়ার না আসা পর্যন্ত ছুটতে পারবে না। এছাড়া বড় নদীর সাথে যেখানে অন্য নদী বা খাল মিশেছে সেখানে চর থাকাও স্বাভাবিক। সুন্দরবন উপকূলে একটু এদিক সেদিক হলে বিপদ হতে সময় লাগে না। হয়তো একারণেই মাঝ নদী ছাড়ছে না RAB-এর লঞ্চ। নদীর অবস্থা যাই থাকুক আমরা লঞ্চটি দেখা গেলেই হলো।
আমাদের নৌ-বহরটি তখন দেখার মতো। অনেকগুলো নৌকা আর ট্রলার একসাথে বাঁধা। ভদ্রা মোহনার ঘুর্ণি স্রোতের সাথে সাথে আমরাও ঘুরছি, ভাসছি আর এগুচ্ছি দোয়া’র দিকে। দোয়া মানে মোহনা। দস্যুদের দ্বিতীয় ট্রলারে থাকা দস্যুরা সবাই তাকানো আমার দিকে। মনে হচ্ছিলো চরমতম উৎকণ্ঠার সময় পার করছে তারা। ওদের মনোভাব বুঝতেই পারছি।
ভয়ে পেয়ে কেউ আবার নদীতে লাফ দিয়েন না। সারেন্ডার না করলেও আপনাদের কেউ কিছু বলবে না। আমি বেঁচে থাকতে আপনাদের গায়ে কেউ আঁচড়ও দিবে না। প্রত্যককে নিরাপদে পৌঁছে দেয়া হবে। আপনারা কে কোথায় নামবেন সেটা ঠিক করেন। ওপাশ থেকে একসুরে সবাই বললো, আপনি থাকতে টেনশন করি না ভাই। বললাম, টেনশন এ দফায় নাই। কিন্তু আজকের পর থেকে নতুন করে টেনশন শুরু হবে।
বললাম, আজকে যারা আপনাদের পৌঁছে দিবে, কাল থেকে তারাই আপনাদের পিছনে ছুটবে ধরার জন্য। তখন আমাকে কিছু বলতে পারবেন না। আমার কিছু করারও থাকবে না। যদি মনে করেন এখনও সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন, আমি আপত্তি করবো না। ওরা বললো, আজকে কোনো রকমে ডাঙ্গায় উঠতে পারলেই খুশি। বললাম, তাহলে চুপ চাপ যে যার জায়গায় বসে থাকেন। আমি যেভাবে বলবো ঠিক সেভাবে চলবেন।
কে কোন ট্রলারে থাকবে? কে কোন পজিশনে থাকবো আমরা? তরুণ বনদস্যু সোলামানের প্রশ্ন অবান্তর নয়। বললাম, কোনো পজিশন দরকার নাই। তোমরাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে। যে যার অস্ত্র হাতে নিয়ে রাখবে। কারও আঙ্গুল ট্রিগারে থাকবে না। আবারও বললাম, বন্দুকের সেফটি লক চেক করে নেন সবাই। মনে রাখবেন, একটা ছোট্ট ভুলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। ওদিকে RAB এর সদস্যরাও কিন্তু সশস্ত্র। এসএমজি হাতে না হলেও ত্রিশ জন আছে সেখানে। আপনারা সন্দেহজনক কিছু করলে আমরা কেউ বাঁচবো না। তবে একটা কথা বলি। যদি কোনো অঘটন ঘটে। যদি গোলাগুলি হয় তাহলে সবার আগে সেই গুলি আমার গায়ে লাগবে। তারপর আপনারা। বার বার মনে করিয়ে দিলাম বাচ্চাদের কথা, সাথে সাধারণ জেলেরাও আছে।
বনদস্যুরা যার যার অবস্থানে চলে গেলো। সুকানিতে সোহাগ আকন। সামনে দাঁড়ানো দস্যুনেতা মাস্টার। আমি থাকবো বেলায়েত সরদারের ট্রলারে। আমার সহকর্মীরাও থাকবে ওই ট্রলারেই। প্রতিটি কেবিনে আলো জ্বালাতে বললাম। সরদারের ট্রলারের বাতিগুলোও জ্বালিয়ে দিলাম। সাথে পলিনকে বলেছিলাম ক্যামেরার লাইটটিও প্রয়োজনে জ্বলবে। বিশেষ করে দস্যুদের দ্বিতীয় ট্রলারটি যেন আলোকিত রাখতে হবে। সাথে থাকা ডিঙ্গি নৌকাগুলোও যাতে পরিস্কার দেখা যায়। মোট কথা আমাদের এই দিকের সবকিছু যেন লঞ্চ থেকে দেখা যায়।
আকাশের অবস্থা কিন্তু ভালো না ভাই। মেঘ করছে আবার। পাশ থেকে বলছিলেন বেলায়েত সরদার। বললাম, বড় ঝড়-বৃষ্টি হবে মনে হয়? বললেন, হতেও পারে। তাহলে তো বৃষ্টি নামার আগেই সব কাজ সেরে ফেলতে হবে। ইঞ্জিন চালু করেন। সোহাগ আকনকেও বললাম, চালু করেন আপনাদের ট্রলার। আপাতত টবারে রাখেন।
ভাবছিলাম জেলেদের নৌকাগুলো নিয়ে কী করবো? ট্রলারের সাথে বেঁধে মাঝ নদীতে নেয়ার অবস্থা তো নাই। এই রোলিং-এর মধ্যে একটা নৌকাও টিকবে না। তাদের ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঝুঁকি ছিলো না তখন। কিন্তু এখনই যদি ওই জেলেদের কেউ বিষয়টি জানাজানি করে ফেলে তাহলে ঝামেলা বাড়বে। বললাম, নৌকাগুলো খুলে দেন। হঠাৎ এ সিদ্ধান্তে সবাই বেশ অপ্রস্তুত। জেলে ভাইদের বললাম, আপনারা এখানেই থাকবেন। আমরা ফিরে বাঁকী সিদ্ধান্ত নিবো। একজনও নৌকা ছাড়বেন না। একটু ভয় দেখালাম যাতে কিছুক্ষণ তারা এখানেই থাকে।জেলেদের একজন বললো, পশুরের যা অবস্থা আমাদের নৌকা একটাও টিকবে না, সব ডুবে যাবে। সেকথা ভেবেই হুট করেই নৌকা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত।
চললাম আমরা। প্রথমে আমার ট্রলার। তার পাশেই বাঁধা মাস্টার বাহিনীর সেই যুদ্ধংদেহী ট্রলার। পিছনে দস্যুদের দ্বিতীয় ট্রলার। ওদিকে RAB-এর লঞ্চটি চলছে ধীরে ধীরে। এদিকে না আসলেও মাঝ নদীতে বরাবর তারা। বড় নদীতে পড়তেই একটু ঢেউ খেলাম। তারপর সবকিছু ঠান্ডা। ভয় পাচ্ছিলাম আবহাওয়া নিয়ে। কিন্তু মেঘ করার সাথে সাথে বাতাস কমে এসেছে। পুরো পশুর নদীটিকে মনে হচ্ছিলো পুকুরের মতো।
সুন্দরবন আর বঙ্গোপসাগরের ত্রাশ জলদস্যু দল মাস্টার বাহিনীর সবগুলো অস্ত্র জমা হতে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে। বিনা অভিযাকে, বিনা যুদ্ধে, কোনো রকম রক্তপাত ছাড়া একটি দস্যু দলের বিলুপ্তি ঘটতে যাচ্ছে হয়তো। আর মাতো কয়েক মিনিটের অপেক্ষা।
দূর থেকে লক্ষ্য করছিলাম RAB সদস্যদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। এটা জরুরি ছিলো কারণ নড়াচড়ার মধ্য দিয়েই তাদের মনোভাব বুঝতে হবে আমাকে। লঞ্চ-এর এক পাশে জ্বলছে আলো। আমরা ভিড়বো সেখানেই। এদিকে আমরাও আলোকিত করে রেখেছি। যাতে আমাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজও তারা দেখতে পায়।
বাতাস থেমেছে। তার সাথে থেমে গেছে উথাল পাথাল অবস্থা। নদীর ঢেউ নিয়ে যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কথা ছিলো তাও কেটে গেছে। সামনের কাজগুলো এখন অনেক সহজ। সোজা গিয়ে ভিড়বো লঞ্চ এর সাথে। একবার ওদিকে তাকাই, একবার তাকাই দস্যুদের দিকে। মাস্টারের মেয়েকে নিয়ে পলিন বসা ছাদের উপর। অন্য সহকর্মীরা যে যার মতো নজরদারিতে ব্যস্ত। নিজেও টান টান উত্তেজনার মধ্যে। সাত বছরের কাজের মধ্যে সবচেয়ে স্পর্শকাতর সময় পার করছি। ব্যাপক অর্থে বন উপকূলের ত্রিশ লাখ মানুষ ও সুন্দরবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। হয়তো এর মধ্য দিয়ে শুরু হবে দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের যাত্রা।
কাছাকাছি আসতেই দেখি লঞ্চ-এর রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে মেজর আদনান কবীর। হাত নাড়িয়ে ইশারা করলাম। সেখানে শক্ত হাতে এসএমজি তাক করে দাঁড়ানো RAB সদস্যরা। মনে হলো দস্যুরা বিশ্বাস করলেও এলিট ফোর্স তখনও শতভাগ বিশ্বাস করেনি আমাদের। পিছনে দাঁড়ানো দস্যুনেতা মাস্টার বললো, জীবনটা আপনার হাতে তুলে দিলাম ভাই। সময় তখন আনুমানিক রাত সাড়ে তিনটা, ২৯ মে ২০১৬।