গন্তব্য হাড়বাড়িয়া, ছুটলো লঞ্চ দস্যুদের নিয়ে | রূপান্তরের গল্প ১১৬ | Rupantorer Golpo 116 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১১৬ : বনদস্যুদের অস্ত্রগুলো একটু বুঝে নিবেন আপনারা? RAB কর্মকর্তাদের বললাম, ট্রলারে পড়ে আছে গুলি ভর্তি বন্দুকগুলো। পোসেস অর্থাৎ গুলির ব্যাগগুলোতে শত শত গুলি। ট্রলারের ভিতরেই পড়ে আছে আরও কয়েক হাজার গুলি। আমাদের ট্রলারের ভিতরে আছে বাঁকী বন্দুকগুলো। সব মিলিয়ে ৫১টি বন্দুক আছে। সেগুলো আপনারা বুঝে নিলে সুবিধা হয়। মেজর আদনান ইশারা করলেন মোস্তাফিজ মামাকে। সালাম দিয়ে বের হলেন তিনি।
পর্যটকবাহী একটি লঞ্চ ভাড়া করে এনেছিলো RAB। মংলা থেকে আসা ওই লঞ্চটির নাম মাছরাঙ্গা। ছোট্ট নৌযানটিতে কেবিন আছে সম্ভবত ১০টি। আমরা যেখানে বসা সেটি মূলত ডাইনিং রুম। সেখানেই বসানো হয়েছে বনদস্যুদের। পাশেই তাদের পরিবারের সদস্যরা। চা নাস্তার সম্ভার বসেছে সেখানে। কুখ্যাত জলদস্যুদের সাথে এক টেবিলে বসা RAB কর্মকর্তারা। খুব অস্বাভাবিক। এই দৃশ্য দেখবো ভাবিনি কখনও।
বনদস্যুদের বেশ সম্মান জানালো RAB। স্বেচ্ছায় অপরাধ ছেড়ে আসার সম্মান। দস্যুদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর প্রতিদান ছিলো সেই সম্মান। অথচ এর একদিন আগেও RAB এর টার্গেট ছিলো এই দস্যুরা। আমি তখন নিরব দর্শক। পাশে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে বসে দেখছিলাম ঘটনা প্রবাহ।
আদনানকে বললাম, আমরা কি এখানেই থাকবো? এগুতে হবে না? আকাশ পরিস্কার হয়ে যাবে ঘন্টা খানেকের মধ্যে। অন্যদিকে জোয়ার হয়ে গেছে। ভাটি থেকে ফিরবে জেলেদের নৌকা-ট্রলার, বাণিজ্যিক জাহাজ-কার্গোগুলো। আমাদের এভাবে দেখলে চারপাশে খবর রটে যাবে। বনদস্যুদের সারেন্ডারে কিন্তু সবাই খুশি না। দায়িত্বশীলদের অনেকেই চান না এটা হোক। জানাজানি হলে জটিলতা বাড়তে পারে। হঠাৎ অতি গুরুত্বপূর্ণ কাউকে বিভ্রান্ত করে ফেলতে পারে যে কেউ। সিদ্ধান্ত হলো লঞ্চ চালিয়ে এগিয়ে যাবো। প্রথম গন্তব্য চরাপুঁটিয়ার ভাড়ানী অথবা হাড়বাড়িয়া।
ঘন্টা বাজালেন সারেঙ। ব্যস্ত সবাই। লঞ্চ-এর ইঞ্জিন রুম তখন সরগরম। বাড়লো লঞ্চের গতি। পাশে বাঁধা ট্রলারগুলোকে নিয়ে ছুটছি উজানে, মানে উত্তর দিকে। জোয়ার ফিরেছে বলে দখিণা বাতাসেও নদী একদম ঠান্ডা। ব্রিজ-এ গিয়ে মাস্টার বা সারেঙ সাহেবকে বললাম আমরা নামবো। পুরো লটবহর নিয়ে জঙ্গলের কোথাও কাজ করবো। মানে আনুষ্ঠানিক ভাবে RAB হেফাজতে যাবে দস্যুরা। সেই দৃশ্য সরাসরি দেখাবো আমার টেলিভিশনে। আশেপাশে কোথায় নোঙ্গর করলে ভালো হবে? একটু আড়ালও খুঁজছি। আবার যেখানে নামবো সেই জায়গাটা শুকনা হলে ভালো হয়। সারেঙ বললেন হাড়বাড়িয়া সেদিক থেকে সবচেয়ে ভালো জায়গা। সেখানে বন বিভাগের অফিস আছে। ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র হাড়বাড়িয়া। বন বিভাগের স্থাপনা আছে, আবার তার পাশে শুকনো জায়গাও আছে।
বের হয়ে মেজর আদনানকে জানালাম বিস্তারিত। সিদ্ধান্ত দিলেন তিনি। আমাদের টিম লিডার তখন এই কর্মকর্তা। তাই সব সিদ্ধান্ত তাঁর মাধ্যমেই আসছে। বললাম, সদর দপ্তরে জানিয়েছো সব? বললেন, রাতেই জানানো হয়েছে। তার মানে দস্যুরা যে তাঁদের হেফাজতে আছে সেই খবর পৌঁছে গেছে। এদিকে আমারও অফিসে কথা বলা প্রয়োজন। সারেন্ডারের সময় লাইভ করবো, সেই প্রস্তুতি নেয়া আছে কী না খবর নিতে হবে। আরেকটু এগুলেই মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক পাবো।
ভোরবেলা সুন্দরবনটাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। পূর্ব আকাশে মনে হয় আগুন জ্বালিয়ে সূর্য ওঠে। আলোর খেলা শুরু হয় চারপাশে। বড় নদীর উপর দিয়ে এসময় লঞ্চ-এ বসে থাকাটাও চরম আনন্দের। দুই তিনদিনের নির্ঘুম যাত্রায় শরীর সায় না দিলেও মনটা তখন বেশ চনমনে। শুধু নেটওয়ার্কটা পেলেই সামনের কাজগুলো সাজিয়ে নিতে পারি। ঘুম আসছে দুই চোখ ভরে। কিন্তু পাত্তা দিবো না। কারণ আরও একবেলা আমাকে জেগে থাকতে হবে, প্রচুর কাজ এখনও। উঠে হাঁটা দিলাম।
লঞ্চ এর পিছন দিকের ফাঁকা জায়গায় রাখা বিরাট বিরাট বাক্স। লাইভ করার স্যাটেলাইট যন্ত্রপাতি, ডিএসএনজি। ভোর বেলায় লাইভ করবো। কিন্তু যমুনা টিভি’র ব্রডকাস্ট টেকনিশিয়ান আতিক ভাইসহ অন্যদের কাউকেই দেখছি না। কোথায় তারা? মোস্তাফিজ মামা বললেন, কেবিনের ভিতরে বিশ্রাম নিচ্ছেন তাঁরা। আমি ভাবছি এই হট্টগোলের মধ্যে উনারা ঘুমাচ্ছেন কী করে? এছাড়া সুন্দরবনের সশস্ত্র দস্যুরা এসেছে। তাদের দেখারও তো আগ্রহ থাকে। ডেকে তুললাম তাঁদের। বললাম, কিছুক্ষণের মধ্যে নামবো আমরা। যন্ত্রপাতি নামাতে হবে, সেট করতে হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে। পুরো আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সরাসরি দেখাবো আমরা। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে কাজে নেমে পড়েন।
ফোন বেজে উঠলো পকেটে। তার মানে নেটওয়ার্ক-এ চলে এসেছি। ফোন বের করে দেখি RAB-এর গোয়েন্দা প্রধান। বললেন, মোহসীন ভাই, বিরাট একটা কাজ করেছেন আপনি। আমার সম্মানটাও বাঁচলো। অসংখ্য ধন্যবাদ। বললেন, সকালে দেখা হচ্ছে মংলায়…!!