সারেন্ডার করলো না ২৬ জন, পৌঁছে দিলাম লোকালয়ে | রূপান্তরের গল্প ১১৭ | Rupantorer Golpo 117 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১১৭ : গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আজাদ ফোন রাখলেন। ধন্যবাদ জানালেন। ভালো লাগলো। তবে মাথায় তখন ওই সব নাই। ফোন দিলাম অফিসে। তখন সম্ভবত ভোর ৫টা পার হয়েছে। বললাম, নিউজ রুমের কী খবর? ও পাশ থেকে জানানো হলো যে সকাল ৬টায় নিউজ করার প্রস্তুতি নেওয়া আছে। প্রেজেন্টার হলেন রুবায়েত হাসান। সরাসরি সম্প্রচার করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি ছিলো নিউজ রুমে। রাতে কিংবা ভোরবেলা যেকোনো সময় বিশেষ সংবাদ প্রচার হবে। সরাসরি সুন্দরবন থেকে যুক্ত হবো আমি।
ভদ্রা নদীর মোহনায় তখনও জেলে নৌকাগুলো নোঙ্গর করা। ওই এলাকা ছাড়ার সময় টর্চ ইশারায় তাদের বিদায় জানালাম। সাথে সাথে নৌকা বেয়ে রওনা দিলো তারা। কিন্তু ততোক্ষণে জোয়ার হয়েছে। ভাটার টানে নিচের দিকে মানে দক্ষিণে যাওয়ার কথা ছিলো। জোয়ারে সেটা সম্ভব না। জোয়ারের স্রোতের বিপরীতে নৌকা বেয়ে চলা কঠিন কাজ, পরিশ্রমের কাজ এবং বড় নদীতে সেটা প্রায় অসম্ভম। সময় মতো জায়গায় পৌঁছাতে পারবে না তারা। তার মানে এক ভাটি সময় নষ্ট হলো তাদের। আপাত দৃষ্টিতে কিছু মনে হয় না। কিন্তু জঙ্গলে বা সাগরে জেলেদের এক ভাটি সময় নষ্ট হওয়া মানে বিরাট লোকসান। আমাদের কারণে সেই লোকসানে পড়লো জেলেরা। মনে হলো আমার নামে কটু কথা বলতে বলতে নৌকা বাইছে ওই জেলেরা।
মনটা খচখচ করছে। আবার মনে হচ্ছে তাদের জন্যই তো এতো কিছু। এখন না বুঝলেও একদিন নিশ্চয়ই বুঝবে তারা।
RAB-এর লঞ্চ এর সঙ্গে বাঁধা আমাদের ট্রলারগুলো। সেই বহরে বনদস্যুদের আরেকটি ট্রলারও আছে। সেখানে সারেন্ডার করবে না যারা তারা আছে। ২৬ জন দস্যু। শেষ পর্যন্ত সারেন্ডারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি তারা। ওদের বাড়ি বাগেরহাটের রামপাল, মংলা, খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা, কয়রা, ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরার শামনগর ও আশাশুনি। বলেছিলাম নিরাপদে সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে পৌঁছে দিবো। সেই কাজটাও সেরে ফেলতে হবে সকাল হওয়ার আগে।
মেজর আদনানকে বললাম, বাঁকী দস্যুদের কী হবে? বললেন, নামিয়ে দিবো আমরা। বললাম, সকাল সকাল পাঠিয়ে দিলে হতো না? কী ভাবে পাঠাবো? বললাম, দস্যুদের দ্বিতীয় ট্রলারটি ফ্রি আছে। আমাদের সামনে অনেক কাজ। RAB-এর প্রতিনিধিসহ তাদের পাঠাতে হবে। চলতি পথেই সিদ্ধান্তটি নিতে হবে। দস্যুরা ততোক্ষণে চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। অনিশ্চয়তা থেকে নদীতে ঝাঁপ দিতে পারে যে কেউ।
লঞ্চ চলছে। তার মধ্যেই নেমে পড়লাম। সরদারের ট্রলার হয়ে দস্যুদের ওই ট্রলারে গেলাম। বললাম কে কোথায় যাবেন? সবাই বললো, কাছাকাছি কোনো লোকালয়ে পৌঁছে দিলেই হবে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পথে পড়বে নন্দবালা। সেখানে কোস্টগার্ড এর পোস্ট আছে। ফিরে এলাম লঞ্চ-এ। RAB এর সাদা পোশাকের দুইজন উঠলেন ট্রলারে। কিন্তু তাতেও ভয় কাটে না। পরে আমার সহকর্মী ইয়ামীন ভাইকে বললাম সঙ্গে যেতে। এবার আশ্বস্ত হলো তারা।
মাস্টার বাহিনীর ২৬ জন দস্যুকে নিয়ে রওনা হলো সে ট্রলার। জয়মনির ঘোল সবচেয়ে কাছের লোকালয়। সেখান থেকে যে যার মতো করে চলে যাবে। হাড়বাড়িয়ায় ফিরে আসবে ট্রলার। ভাবছি এই ২৬ জনের মধ্যে অন্তত ২০ জন পুরনো জলদস্যু। সবাই দাগী আসামী, চিহ্নিত এবং ফেরারি। বাড়িতে ফিরে যাওয়া, সেখানে বসবাস করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। তারা করবে কী এখন? নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরবে না! আদনানকে বললাম, কী করবে পরে দেখা যাবে। আমরা আমাদের কাজগুলো এগিয়ে নেই চলো।
পশুর নদীতে তখন জাহাজ-কার্গোর চলাচল বেড়েছে। লঞ্চ নিয়ে তাই পূর্ব পাশে চলে গেলাম। জঙ্গল ঘেঁষে যাচ্ছি। আধা ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো হাড়বাড়িয়া। ডাইনিং রুমে গিয়ে মাস্টার বাহিনীর দস্যুদের সঙ্গে বসলাম। পরবর্তী পরিকল্পনার কথা জানালাম। নিচে নেমে দেখি চারপাশে আগের মতো কঠোর পাহাড়া নাই। রান্নাঘর ব্যস্ত সকালের রান্না নিয়ে। সবার জন্য খিচুরি তৈরি হচ্ছে।
আমার পরনে তখনও একটি টি-শার্ট আর শর্টস। ভিডিওগ্রাফার পলিন বললেন, লাইভের সময়ও কি এই পোশাকে থাকবেন? সত্যিই তো। এই পোশাকে সরাসরি সম্প্রচারে আসা উচিৎ হবে না। ট্রলারে ফিরে গেলাম। ট্রলার সহযোগী মামুন আমার কাপড়ের বাক্স বের করে দিলো। কাপড় বদলে ফুল শার্ট, ফুল প্যান্ট পড়ে নিলাম। পলিন তাঁর ক্যামেরা বের করেছেন। যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করে নিলেন। অফিসে ফোন করে বললাম আমরা ভোর ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে সরাসরি সম্প্রচারে আসবো। লাইভে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ আসবে- মোহসীন-উল হাকিমের মধ্যস্ততায় আত্মসমর্পণ করছে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুদল- মাস্টার বাহিনী।
ছবি: মেজর আদনান কবীর ও আমার সহকর্মী বাগেরহাটের ইয়ামীন আলী।