হঠাৎ অন্ধকার RAB কর্মকর্তাদের মুখ | রূপান্তরের গল্প ১২০ | Rupantorer Golpo 120 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১২০ : অফিসে ডাকাত দল আসলে আমাদের জানে পানি থাকে না। রাতের বেলা ঘুমের মধ্যেও আতঙ্কে থাকি আমরা….!! বলছিলেন হাড়বাড়িয়া বন টহল ফাঁড়ির একজন বনকর্মী। লাইভ সম্প্রচার শেষ করার পর চা-এর নিমন্ত্রণ নিয়েছিলাম। পিছনের দিকে উনাদের রান্নাঘর। সেখানেই বসে পড়লাম। বনরক্ষীরা ওখান থেকে আমাদের সারেন্ডার ও সম্প্রচার দেখছিলেন। একজন বললেন, পূর্ব বাদায় জুলফু নামের এক ভয়ঙ্কর দস্যু ছিলো। অনেকগুলো অস্ত্র নিয়ে তারা রাত-বিরাতে উঠে পড়তো অফিসে। আমাদের ওসি সাহেবকেও বের করে দিলো একবার।
দস্যুনেতা জুলফু’র (জুলফিকার) এক মামা ছিলো। নাম বশির। দেলোয়ার নামে ওই দস্যুনেতার এক চাচাও ছিলো বাহিনীতে। বাড়ি জয়মনি। অফিসে উঠলে সবচেয়ে বেশি দুর্ব্যবহার করতো ওরা দুইজন। একবার এক ফরেস্টারকে মেরেছিলো সেই দস্যুরা। পূর্ব সুন্দরবনের ফরেস্ট অফিস মৃগামারী তো ওদের অত্যাচারে বন্ধই করে দেয় বন বিভাগ। অবশ্য কিছুদিন পর উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে তারা, বলছিলেন আরেকজন বনরক্ষী।
জুলফু বাহিনীর প্রধান জুলফিকার ও তার ছোট ভাই মর্তুজা RAB এর বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। দেলোয়ার মরেছে দলের ভিতরে গোলাগুলিতে। বশিরসহ অন্যরা পলাতক। পূর্ব সুন্দরবন অর্থাৎ পশুর নদীর পূর্ব দিকের অংশের কয়েকটি দসুদল অভিযান ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চাপে কোণঠাসা। ফরেস্ট অফিসের রান্নাঘরে বাবুর্চি বললেন, ও ভভাই, নাস্তা করে যান। নাস্তা মানে গরম ভাত, দাতিনা মাছ ভাজা আর কাউইন মাগুরের ঝোল। বসে পড়লাম।
খেতে খেতে জানতে চাইলাম, এই সারেন্ডার কী কার্যকর কিছু হবে? মানে সুন্দরবন থেকে দস্যু নির্মুলে আত্মসমর্পণটা কাজ করবে? উনারা বললেন, অবশ্যই কাজ করবে। অভিযানে তো শুধু লিডার বা দুই/চার জন দস্যু মরে। বাঁকীরা বেঁচে থাকে, তারা এই জঙ্গলেই থাকে। ওই বনরক্ষী ভাই বলছিলেন, দস্যুদের লিডার মারা পড়লেও অস্ত্রগুলো তো থেকেই যায়। সেখান থেকে আবার দস্যু বাহিনী গড়ে ওঠে। একটা বাহিনী ভেঙ্গে তিন/চারটা বাহিনী হয়। এরা জেলেদের অত্যাচার করে, আমাদেরও যন্ত্রণা দেয়। শীতের রাতে এসে যদি ঘর থেকে বের করে দেয়, কেমন লাগে বলেন? বাবুর্চি বললেন, সবগুলো দস্যুবাহিনী যদি সারেন্ডার করে তাহলে একটা কাজের কাজ হবে।
রান্নাটা দারুণ হয়েছে। বিশেষ করে কাউইন মাছের ঝোলটা তো অসাধারণ। বড়শিতে ধরা ওই মাছটা নাকী সাড়ে চার কেজি ছিলো। বনরক্ষীদের ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নদীতে তখন শেষ জোয়ার। চারপাশে পানি থৈথৈ করছে।
ক্লান্তি ঠেকানো যাচ্ছে না। শরীর বলছে, আর সম্ভব না। কিন্তু মনটা তো আর শরীরের নিয়ন্ত্রণে না। মন বলছে, এই বেলাটাও জেগে থাকতে হবে। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। বিদ্রোহী শরীরটাকে ধরে রাখতে তাই আধা ঘন্টা পর পর চা খাচ্ছি। আমাদের ক্যাপ্টেন বেলায়েত সরদার তখন গভীর ঘুমে।
সকাল আটটার দিকে রওনা দিবো আমরা। যাবো হাড়বাড়িয়া থেকে সোজা মংলার ফুয়েল জেটিতে। পশুর নদীর পাশে মংলা সমুদ্র বন্দর কর্তৃপক্ষের জাহাজগুলো জ্বালানী নিতে এখানে ভিড়ে। সেই জেটিতেই ছোট পরিসরে আয়োজন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করবে মাস্টার বাহিনী। বরিশাল থেকে RAB এর বহর এসেছে সেখানে। ঢাকা থেকে বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারা আসবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে হেলিকপ্টারে।
ট্রলারে গিয়ে একটা ঘুম দিবো। অন্তত একটা ঘন্টা। কিন্তু ঘুমাবো কী করে? সাত সকালেই রোদ পড়েছে। ভ্যাপসা গরমে টিকতে পারছি না। বন উপকূলে মে মাসের আবহাওয়া খুব কর্কষ থাকে যদি বৃষ্টি না হয়। কিন্তু কোথায় বৃষ্টি? পূর্ব আকাশে মেঘ দেখছি। অনেক দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে।
ওদিকে ঢাকা থেকে ছেড়েছে হেলিকপ্টার। সকালে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাবেন মন্ত্রী। কুয়াকাটা থেকে মংলা আসবেন তিনি। সেই পর্যন্ত আমার কোনো কাজ নাই।
হাড়বাড়িয়া খালটি দারুণ সুন্দর, প্রাণবৈচিত্রে ভরা। বন বিভাগের টহল ফাঁড়ি এটি। আবার ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রও। পর্যটকরা আসেন প্রতিদিন। মংলা ও খুলনা থেকে লঞ্চ বা কাঠের ট্রলারে করে এক দিনের সফর। পথে করমজল বন্যপ্রাণি অভয়াশ্রমও দেখতে পারেন এ পর্যটকরা। আবার তিন/চার দিনের সফরে আসা পর্যটকবাহী লঞ্চগুলোও ভিড়ে হাড়বাড়িয়ায়। নামলেই হরিণ, বানর, বন্য শুকর দেখা যায়। সরাসরি বাঘ দেখা না গেলেও উনাদের আসা যাওয়ার আলামত দেখা যায় সেখানে। খুব সুন্দর একটি পুকুর আছে। ছোট খালে উদবিড়াল দেখেছি অনেক। বড় খালে কুমির আর ডলফিনের আনাগোনা সারা বছর থাকে। সব মিলিয়ে হাড়বাড়িয়া সত্যিই খুব সুন্দর।
ভাবতে ভাবতে পর্যটকদের একটি লঞ্চ দেখলাম। এ পর্যন্ত আসতে তাদের আধা ঘন্টা লাগবে। তার আগেই সরে যেতে হবে। জেটিতে বনদস্যু আর RAB এর এই মহাযজ্ঞ দেখলে তাঁরা ভয় পেয়ে যেতে পারেন। ওরা আসার আগেই বের হতে হবে। এর মধ্যে হুট করে একটি পর্টকবাহী ট্রলার এসে হাজির। বিব্রতকর পরিস্থিতি। দ্রুত ইঞ্জিন চালু করা হলো। লঞ্চসহ আমরা ঢুকে পড়লাম হাড়বাড়িয়া খালের ভিতরে প্রথম বাঁকটি পেরিয়ে। লঞ্চ থামলো তিন খালের মুখে। দস্যুদের জমা দেওয়া গুলিগুলো গণনার কাজ শেষ হয়নি এখনও। ছাদের উপর চেয়ারে বসা মেজর আদনান কবীরসহ অন্য কর্মকর্তারা। পূর্ব আকাশ তখন পুরো অন্ধকার। মেজর আদনানের মুখটাও অন্ধকার!
ছবি: হাড়বাড়িয়া