সাংবাদিক সাহেব ধরা! দুই কোটি টাকার ডিল ভেস্তে গেছে! | রূপান্তরের গল্প ১২৩ | Rupantorer Golpo 123 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১২৩ : মোহসীন উল হাকিমকে দুই কোটি টাকা দিয়েছে মাস্টার বাহিনী। চুক্তি ছিলো তাদের সারেন্ডার করানো হবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আনা হবে… ইত্যাদি। কিন্তু এই কাহিনী নাকী ফাঁস হয়ে গেছে। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন না। সাংবাদিক সাহেব এবার ধরা খেয়েছেন। খুলনা-বাগেরহাট-ঢাকা মিলিয়ে কিছু মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে এই কথা। আমরা হাড়বাড়িয়ায় অবস্থান করছি। মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকে, থাকে না। ডেটা সার্ভিসও নাই। তাই শহরের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যাওয়া এই রূপকথার গল্প কখন জমাট বেঁধেছে বলতেও পারি না। অচেনা অনেক নাম্বার থেকে ফোন আসছে একের পর এক।
নোয়া মিয়া নামের এক দস্যুনেতার ফোন দিলো সকাল সাড়ে নয়টার দিকে। বললো, ও ভাই, সারেন্ডার কি হয়ে গেছে? মাস্টাররা বেঁচে আছে? বললাম, কেন ভাই? ওদের কি মরে যাওয়ার কথা? বললো, খবর তো সেরকমই চারপাশে। বললাম, তাতে আপনাদের কী? সারেন্ডার তো করেননি। নতুন করে আবার বাহিনী গড়লেন। আবার ডাকাতি শুরু করলেন জঙ্গলে।
নোয়া মিয়া বললো, ডাঙ্গায় তো থাকতে পারলাম না ভাই। আর আমার অস্ত্রগুলো তো সব মাস্টারে কেড়ে নিছে। জিজ্ঞেস করলো, এই পার্টি কয়টা অস্ত্র জমা দিলো ভাই? বললাম, ৫১টা। আপনাদের কতোগুলো অস্ত্র কেড়ে নিছে মাস্টার? সবগুলো অস্ত্র জমা হলো তো? নোয়া মিয়া বললো, তার চেয়ে বেশি মেশিন জমা দিছে তারা। পরে কিছু অস্ত্র কিনেছে। কয়েকটা অস্ত্র জাহাঙ্গীর ও ছোট একটা দস্যুদলের কাছে থেকে কেড়ে নেওয়া। নোয়া মিয়া বললো, আমার অস্ত্রগুলো সব জমা দিয়ে সারেন্ডার করলো ওরা। বললাম, আপনিও সারেন্ডার করেন। উত্তর নাই। বললাম, বাঁচতে চাইলে, বাড়ি ফিরতে চাইলে যোগাযোগ করবেন।
বনদস্যু নোয়া মিয়া রাজু বাহিনীর প্রধানের আত্মীয়। রাজু পালিয়ে যাওয়ার পর প্রথমে শহীদুল, তারপর ইলিয়াস পেয়েছিলো সেই বাহিনীর দায়িত্ব। তারপর নোয়া মিয়া অস্ত্রগুলো নিয়ে দস্যুতা শুরু করে। মাস্টার ছিলো দলের সদস্য। ২০১৫ সালের জুন-জুলাই মাসে বিদ্রোহ করে নোয়া বাহিনীকে পরাস্ত করে মাস্টারসহ তার সহযোগীরা। সেই সূত্রে রাজু বাহিনীর অস্ত্র-গুলির মালিক হয় মাস্টার। সাথে সাথে আমাকে ফোন দেয় তারা। আত্মসমর্পণের আগ্রহ জানায় মাস্টার বাহিনী। তারপর শুরু মধ্যস্ততা। এক বছরের মাথায় সারেন্ডারের জন্য RAB হেফাজতে আসলো তারা।
এমনিতে মন-মেজাজ আর শরীর কোনোটাই ঠিক নাই। তার ওপর একের পর এক ফোন বেশ কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। ফোন বন্ধ করবো। কিন্তু তার আগে আরেকটা ফোন ঢুকলো।
ও ভাই, আপনি কী করতে চান? মাস্টারকে তুলে নিয়ে কি ক্রসফায়ার দিলেন? ওদের তো আরেকটু হলে আমিই ক্রস-এ দিতাম। আপনার কারণে পারলাম না। ওপাশ থেকে একটানা কথাগুলো বলে যাচ্ছে একজন। জানতে চাইলাম, কে আপনি? বললো, আমি জাহাঙ্গীর ডাকাত। হাসতে হাতে কাহিল আমি। বললাম, আমাকে কি ভয় দেখাচ্ছেন ভাই? উনি বললেন, ভয় তো মাস্টার বাহিনীর ডাকাতেরা পাইছে। ওরা জানে যে আমি তাদের খুঁজছি। বললাম, আর খোঁজার দরকার নাই ভাই। ওরা নিরাপদে আছে। RAB তাদের হেফাজতে নিয়েছে। ওরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র জমা দিবে। জাহাঙ্গীর বললো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকী আসবে না? বললাম, আপনিও জেনে গেছেন সে খবর? বললো, সব জায়গায় আমাদের সোর্স থাকে ভাই। ফোন রাখার আগে বললাম, আপনারাও সারেন্ডার করেন।
জঙ্গলের ভিতরে থাকা দস্যুদলও জেনে গেছে সারেন্ডার হচ্ছে না! পাশ থেকে বাগেরহাটের সহকর্মী ইয়ামীন ভাই বললেন, তাঁর ফোনেও একের পর এক কল আসছে। বেশির ভাগই সাংবাদিক। তাঁদের কাছে তথ্য, মাস্টার বাহিনীর সারেন্ডার ব্যর্থ হয়ে গেছে। মানে ভোরবেলা থেকে সারেন্ডার নিয়ে যে সংবাদ ছিলো সেটি আর হচ্ছে না। মন্ত্রী নাকী বলে দিয়েছেন যে আসবেন না তিনি। তাহলে তাদের এখন ক্রসফায়ার দিবে নাকী গ্রেফতার দেখাবে। ইয়ামীন ভাই-এর কাছে সেবিষয়ে নিশ্চিত হতে চাইছিলেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। আর কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন, মোহসীন উল হাকিমের দুই কোটি টাকার ডিল ভেস্তে গেছে।
আমার তখন আর কিছু করার নাই। স্ক্রল সংবাদ যাচ্ছে, “২৯ মে নির্ধারিত মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান স্থগিত”। তার সাথে জুড়ে দিলাম আরেকটি লাইন, “শিগগিরি নতুন সময় নির্ধারণ করা হবে। মাস্টার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গহীন সুন্দরবনে অভিযানে RAB”।
তখন সকাল ১০টা। ২৯ মে ২০১৬। সারেন্ডার হলো না। সেই সঙ্গে যা হলো তা বলার মতো পরিস্থিতি নাই। বিবিসি বাংলা থেকে ফোন আসলো। বিস্তারিত জানালাম। অফিসে জানালাম আমরা সুন্দরবনেই আছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান হয়তো নতুন করে সময় দিবেন। এর মধ্যে যদি দস্যুদের নিয়ে লোকালয়ে আসি তবে আইনী বাধ্যবাধকতায় বনদস্যুদের থানায় সোপর্দ করতে বাধ্য RAB। ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাদের নামে অস্ত্র মামলা দিয়ে থানায় পৌঁছে দিতে হবে। একদম নতুন সংকট। মোকাবেলায় কী করা যায় তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
এদিকে বিভিন্ন সংস্থা থেকে ফোন আসছে, মেসেজ আসছে। কানাঘুঁষা চলছে সব মহলে। সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে সুন্দরবনের দস্যু জগতে। আলোচনা ছিলো সবচেয়ে বেশি। আমার সোর্সরা তখন আমার কাছে থেকে তথ্য নেওয়ার জন্য ব্যাকুল। কোথায় আছি? কী ভাবে কী হলো? এখন কী করছি আমরা? পরবর্তী পরিকল্পনা কী? বনদস্যুদের পৃষ্ঠপোষকরা বেশ আনন্দিত তখন। একজন বলছেন, এই সারেন্ডার যে একটা নাটক তা আগেই বলেছিলাম। সাজানো নাটক।
ওই সাংবাদিক সুন্দরবনের দস্যুদের কাছে থেকে কোটি কোটি টাকা নেয়। মোহসীন উল হাকিমের এবার সুন্দরবন আসা বন্ধ। মনে পড়ছে, কয়েক মাস আগে দুবলার চর থেকে একটি সিরিজ সংবাদ প্রচার করেছিলাম। মহাজনদের কাছে জিম্মি দুবলার চরের জেলেরা- শিরোনামের সংবাদটি তাঁদের গাত্রদাহের কারণ। তাই সারেন্ডার হচ্ছে না শুনে বেশ খুশি তাঁরা। খুলনার একটি ছোট্ট ঘরে সেই পৃষ্ঠপোষকদের আড্ডা বসে। সেদিন সকাল সকাল সেখানে হাজির তারা।
RAB এর গোয়েন্দা প্রধান লে কর্নেল আজাদকে ফোন দিলাম। জানতে চাইলাম কী হবে এখন? উনি জানালেন, পটুয়াখালীর অনুষ্ঠান চলছে। এটা শেষ করে হেলিকপ্টার ফিরবে ঢাকা। কারণ দুপুরের দিকে আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ থাকবে। সেই পথে হেলিকপ্টারে ঢাকা ফিরা যাবে না। বললাম, অনুষ্ঠান স্থগিতের আর কোনো কারণ নাই তো? কর্নেল আজাদ বললেন, আপনি বিশ্রাম নিন ভাই। তিন দিন ঘুমান না। এদিকটা আমরা দেখছি। আমি ফোন বন্ধ করে বিশ্রামে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো সুন্দরবনে। পশুর নদীর পূর্ব দিকের খাল- হাড়বাড়িয়ার ভিতরে আমরা। বৃষ্টি নামতেই গলদা চিংড়ি ধরতে আসা বইশেলদের নৌকা দুটি এসে ভিড়লো আমাদের ট্রলারের পাশে।