বানরের আক্রমণ রান্নাঘরে | রূপান্তরের গল্প ১২৪ | Rupantorer Golpo 124 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১২৪ : ধর ধর ধর…!! ইঞ্জিন রুম থেকে চিৎকার করলো একজন। পাশেই রান্নাঘর। আর স্রোতের চাপে ট্রলার লেগে গেছে জঙ্গলের সাথে। ঘুম ভাঙ্গলো। লাফ দিয়ে উঠলাম। কী হলো? মামুন বলে ট্রলারে মেহমান আসছিলো ভাই। কারা তারা? বললো, বানর উঠলো ট্রলারে। রান্নাঘর থেকে হলুদের ডিব্বা নিয়ে গেছে। আর ধাওয়া খেয়ে সব উল্টে পাল্টে দিয়ে গেছে। আর কিছু নেয়নি তো? বললো, ভাতের হাঁড়ি উল্টেছে, কিছু তরি-তরকারি ছিলো সেসব নিতে গিয়ে পানিতে ফেলেছে। ট্রলারের রান্নাঘর মানে বড় কিছুই না। ছোট্ট একটা খুপড়ি পাল্লা দিয়ে ভিড়ানো থাকে।
মজা দেখতে উঠে বসলাম। এমনিতে হাড়বাড়িয়ায় প্রচুর বানর আছে। পর্যটকরা আসেন বলে এখানকার বানর, হরিণ আর বন্য শুকরগুলো আমাদের খুব একটা ভয় পায় না। ট্রলার একদম জঙ্গল ঘেঁষে বাঁধা ছিলো।
ভাটা হয়েছে প্রায় দুই ঘন্টা আগে। পানি নামছে পশুর নদীর দিকে, মানে পশ্চিমে। বড় নদীতে এখন তুমুল স্রোত। মাঝ খালে নোঙ্গর করা RAB এর ট্রলার ঘুরে গেছে। উল্টো দিকে ঘুরে গেছি আমরাও। ট্রলারের সবাই ক্লান্ত। এখানে ওখানে শুয়ে পড়েছে তারা। আমিও ট্রলারের ডেক-এ আধা শোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
রান্নাঘরে ওই বানরের আক্রমণে ঘুম ভাঙ্গলো। ছই-এর ভিতরে ঘুমিয়ে ছিলেন সরদার। হই হুল্লোড় শুনে বের হয়ে বললেন, ও ভাই, রান্নাঘরটা একটু পাহাড়া দিতে পারলেন না? হাসতে হাসতে আমরা শেষ। আমাদের আড্ডা আর মজা করা দেখে লঞ্চ থেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে RAB সদস্যরা। জানি না আমাদের নিয়ে কী ভাবছেন তাঁরা। নিশ্চয়ই ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছেন না। এমনিতে অপরাধীদের ধরতে স্যাররা সোর্স ব্যবহার করেন। কিন্তু এই সোর্সদের ব্যাপারটা বুঝতেই পারছেন না তাঁরা। লঞ্চ থেকেও তারা জঙ্গলের পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়ানো হরিণ, বানরের কাজ কারবার দেখছে।
বানরে কেন রান্নাঘর টার্গেট করে জানেন? বললাম, রান্নাঘরে খাবার থাকে তাই। সহজ উত্তর। সরদার বললেন, হয়নি ভাই। রান্নাঘর থেকে খাবার নিতে হলে তো কতো কিছু নিতে পারতো। হলুদের কৌটা নিলো কেন? বললাম, বিরাট কঠিন হয়ে গেলো প্রশ্নটা। সরদার বললেন, সুন্দরবনের বানরগুলোর মাথায় মেলা বুদ্ধি। তা না হলে তো এই লবণ পানির জঙ্গলে টিকে থাকতো না। সুযোগ পেলেই বাঘে ধরে নিবে। পানিতে নামলে কুমিরে নিবে। জঙ্গলে কতো রকমের বিষধর সাপ আছে, পোকা মাকড় আছে, কাঁটা আছে। শরীরে তাদের ক্ষত থাকবেই থাকবে। আবার ওদের লোমের ভিতরে ভিতরে থাকে উকুন। দেখবেন অবসর সময় বসে একজন আরেকজনের উকুন তুলে দেয়। বললাম, সব তো বুঝলাম। এখন বলেন, সব বাদ দিয়ে বানরে হলুদের কৌটা নিলো কেন?
বেলায়েত ভাই বললেন, হলুদ হলো জীবানু নাশক মানে অ্যান্টিসেপ্টিক। আমাদের গ্রামে দেখবেন কেটে গেলে হলুদ দেয়। ওদের গায়ে কাটা-ছেঁড়া থাকে। উকুন থাকে। হলুদ দিলে আরাম পায়। শুধু হলুদ না। গায়ে বেশি উকুন হলে নাকী মরিচও দেয় ওরা। জঙ্গলের মানুষদের এই কথাটি হয়তো বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করবেন না। বেলায়েত সরদারকে বললাম, আমাকে আপনি যা ইচ্ছা তাই বলেন। বানর কেন গায়ে হলুদ মাখবে? বলতে বলতে পাশ থেকে মামুন বললো, ও ভাই, দেখেন কী করছে ওরা! দেখি ভাটায় জেগে ওঠা চরে বসে গায়ে গলুদ গুঁড়া মাখছে বানর। কী বলবো? কী করে খন্ডাবো তাদের যুক্তি?
গল্প করতে করতে দেখি পাশে বাঁধা নৌকায় চুলা জ্বলছে। সেই প্রবীন বইশেল ওমর কাকা চুলা জ্বালিয়েছেন। চা হচ্ছে সেখানে। টিন দিয়ে বানানো ছোট্ট চুলা। ভাতের হাঁড়িটাও ছোট। খালের পানিতে সেই পাতিল ধুলেন। তারপর সেই খালের পানি দিয়ে গরম পানি বসালেন। বললাম, কী করবেন কাকা? বললেন, চা বানাচ্ছি আপনার জন্য। বললাম ট্রলারে আসেন। আমরা চা খাওয়াই। উনি বললেন, মাছ তো নিলেন না। এক কাপ চা অন্তত বানায়ে খাওয়াই?
কেমন মানুষ এরা? সুন্দরবনের ভিতরে ভেসে বেড়ানো মানুষগুলোকে আমরা বন্য বলি, জঙলী বলি, কখনও অসভ্যও বলি কেউ কেউ। অথচ ওমর কাকাকে দেখেন। একা একা নৌকা বেয়ে মাছ ধরে বেড়ান গভীর বনে। কিছুক্ষণ আগেই মেজাজ খারাপ করলেন। আবার মাছ দিতে চাইলেন, গল্প করলেন। মাছ ধরা শেষে এখন আবার এসে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছেন। এক মুহুর্তে মনের ভিতরের সব টেনশন দূর হয়ে গেলো। ভাবলাম, এই মানুষগুলোর চাহিদা এতো কম! এতো কষ্টের মধ্যেও সারাক্ষণ মুখে হাসি। ডাকাতে মারে, ফরেস্টারে দৌড়ায়, পথের কতো ঝক্কি, এলাকায় সূদে মহাজন তাড়া করে, মহাজনের মাইর তো আছেই। প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জগুলোর কথা না বললাম। তবুও কাজের ফাঁকে একটু চা, একটু গল্প… জঙ্গলের এই জীবনটা তাদের টানে, আমাকেও টানে তীব্র ভাবে।
মাস্টার বাহিনীর সারেন্ডার নিয়ে জটিলতা মাথা থেকে সরে গেলো। ওমর কাকাকে বললাম, খালের পানি দিয়ে চা বানাচ্ছেন? বললেন, বর্ষা আসলে এই বাদার খাল-নদীর পানিতে আর লবণ থাকে না। ভাঙ্গা একটা প্লাস্টিকের কাপে কড়া লিকারের এর র’ চা হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, সুন্দরবনের ডাকাত জীবনেও শেষ হবে না কাকা। আপনি যে চেষ্টা করছেন, সেটা করেন। অসুবিধা নাই। আমার জঙ্গল করার বয়স ৪০ বছরের বেশি। আমার বাপ দাদারাও জঙ্গল করে গেছেন। মুরুব্বিরা বলেন, সুন্দরবনে যতোদিন গাছে পাতা থাকবে, ততোদিন ডাকাত থাকবে। এই যে প্রশাসনের এতো অভিযান হয়, ক্রসফায়ার হয়, ডাকাত কি কমছে?
বললাম, ডাকাত শেষ হওয়া লাগবে না কাকা। আপনার ওই পাঁচ কেজি গলদা চিংড়ির দামটা তুলতে হবে। ওই ডাকাতের কাছ থেকে জরিমানাসহ আপনার পাওনা টাকা তুলে দিবো দেখবেন। ভীষণ খুশি কাকা। বললেন, আপনি বলছেন, আমার পাওয়া হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চা শেষ করেন। ভাটি দিবো এখন।
নৌকা বেয়ে কাকা যাবেন চরাপুঁটিয়ায়। এই গোন সেদিকেই ধরবেন মাছ। বললাম, সুমন বাহিনী তো ওদিকেই আছে। আবার ধরলে? বললেন, মরাকে আর কতোবার মারবে কাকা? বললাম, তাও ঠিক। গল্প করতে করতে চা-এ চুমুক দিলাম! কোথায় কী? পুরো লবণ পানি। চিন্তা করুন, চায়ের মধ্যে লবণ। বললাম, পানি তো মিষ্টি না কাকা। বললেন, এটাই আমাদের কাছে মিষ্টি পানি। খেয়ে ফেললাম নোন্তা মিষ্টি চা।
দূরে লঞ্চ-এর রেলিং ধরে দাঁড়ানো মাস্টার বাহিনীর দস্যুরা। হাত তুলে বললাম, আপনারা সারেন্ডার নিয়ে টেনশনে আছেন ভাই? মাস্টার আবারও বললেন, আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবে চলবো। জেলখানায় দিলে দিবেন। কিন্তু এই যে জঙ্গল ছেড়ে উঠছি, আর ডাকাতি করতে নামবো না। দেখলাম বেশ ফুরফুরে মেজাজে দস্যুরা। RAB সদস্যদের সাথে খোশগল্প করছে। অথচ কয়েক ঘণ্টা আগেও এরা কেউ কাউকে চিনতো। সামনে পেলেই গুলি- সম্পর্কটি ছিলো এমন। অথচ এখন হাড়বাড়িয়ার দোয়ায় লঞ্চ-এ একসাথে দাঁড়িয়ে আছে মোস্ট ওয়ান্টেড জলদস্যু মাস্টার ও RAB। সময় তখন বেলা ১১টা। ২৯ মে ২০১৬। হাড়বাড়িয়া সুন্দরবন।