সরদারকে বললাম- “নোঙ্গর তোলেন” | রূপান্তরের গল্প ১২৬ | Rupantorer Golpo 126 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১২৬ : ২৯ মে ২০১৬। সকালে এক পশলা বৃষ্টি হলো। কিন্তু তার পর থেকে আর বৃষ্টির দেখা নাই। আকাশে মেঘ আছে। সূর্যের দেখা নাই। কিন্তু গরমটা বেড়েছে চরম মাত্রায়। বাতাস নাই বলে দম বন্ধ করা পরিবেশ। গরমে ঘামছি বসে বসে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুষ্ঠান স্থগিত হয়েছে সেই সকালে। এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। সারেন্ডার অনুষ্ঠানের পরবর্তী দিন ক্ষণ ঠিক হয়নি, হবে বলেও মনে হচ্ছে না। কারণ সংশ্লিষ্টরা কেউ কিছু বলতে পারছেন না। আমার ওপর চাপ আসছে বলে ফোন বন্ধ রেখেছিলাম।
কুকু পাখি ডাকছে মুহুর্মুহু। তার মানে অর্ধেক ভাটা হয়ে গেছে। লঞ্চ-এ ওঠার পর ফোনে নেটওয়ার্ক একটু ভালো। বন্ধ ফোনটি খোলার পর দেখি শ’খানেক মিসড কল অ্যালার্ট। ফোন আসছে একটার পর একটা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এক উর্ধতন কর্মকর্তা ফোন করে বললেন, যমুনা টিভির নিউজটা বন্ধ করতে বলেছি আপনাকে। সকালে সরাসরি সম্প্রচার করেছেন অনুমতি ছাড়া। বললাম, আমি আপনার অধীনস্ত কেউ? আমাকে কেন এভাবে সংবাদ বন্ধ করতে বলছেন? আমি কী আপনার এই কথোপকথন নিয়েও সংবাদ করে দিবো? আমাকে ভয় দেখান কোন হিসাবে? আমি সংবাদ করবো না লাইভ করবো সেটা আমার সিদ্ধান্ত, আমার নিউজ রুমের সিদ্ধান্ত। আপনি কেন আমাকে থ্রেট করছেন?
উনি বললেন, এখন যে সংবাদ যমুনা টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে সেটা বন্ধ না করলে আপনার চাকরি যাবে, যমুনা টিভিও বিপদে পড়বে। বললাম, আপনি আমার চাকরির কী করবেন করেন, পারলে যমুনা টিভি বন্ধ করে দিন। অনুমতি নিয়ে কিছু করার বিষয় থাকলে সেটা আপনাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে বিষয়ে আপনি মেজর আদনানের সাথে কথা বলুন।
বললাম, সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুদলটি এখন আপনাদের হেফাজতে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সময় দিলেই সারেন্ডার করবে তারা। আমি গত ছয় বছর কাজ করছি। নিজে তাদের বুঝিয়ে এনে আপনাদের হাতে তুলে দিলাম। বিনা রক্তপাতে সুন্দরবনের একটি বড় দস্যুদল বিলুপ্ত হচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়া আমার হাতেই। আর আপনি আমাকে থ্রেট করছেন? হাসতে হাসতে বললাম, তিন রাত ঘুমাইনি ভাই। জীবনের ঝুঁকি গেছে আমার ও আমার সহকর্মীদের। বছর শেষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে থেকে পদক নিবেন আপনারা। এবার একটু নরম হলেন তিনি। বললেন, সংবাদটি প্রচার হলে তাদের একটু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ঊর্ধতনতের কাছে জবাব দিতে হচ্ছে। বললাম, আপনার জবাব আপনি দিন। আমাকে আমার কাজ করতে দিন। বলে ফোন রাখলাম।
সাত সকালে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণ নিয়ে সরাসরি সম্প্রচারের পর ভেবেছিলাম আমি এবার হিরো হয়ে যাচ্ছি। অন্যরা যে যাই বলুক, ভেবেছিলাম সাংবাদিক সমাজ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আমাকে স্বীকৃতি দিবে, বাহবা দিবে। কিন্তু ঘটনা ঘটছে ঠিক উল্টো। সেদিন বিবিসি বাংলা ও যমুনা টেলিভিশন ছাড়া আর একটি গণমাধ্যমও তাদের সংবাদে আমার নামটি পর্যন্ত আনেননি। এখানে একজন সাংবাদিকের ছয়/সাত বছরের পরিশ্রম আছে সে প্রসঙ্গ আসেনি বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যমেও।
সাংবাদিক মোহসীন উল হাকিমের মধ্যস্ততায় বনদস্যু দল আত্মসমর্পণ করেছে- সেকথা নাই কেন আপনার পাঠানো সংবাদে? নিউজ রুম থেকে জেলা ও বিভাগীয় সংবাদ প্রতিনিধিকে জিজ্ঞেস করেছেন কেউ কেউ। সাংবাদিক সাহেবদের কেউ চালিয়েছেন দুই কোটি টাকার ডিল এর প্রোপাগান্ডা, কেউ পাঠিয়েছেন শুধু RAB এর প্রেস রিলিজ ও তাদের বক্তব্য। তথন বুঝলাম RAB-এর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও আমার নাম নাই।।
মেজর আদনান কবীরকে বললাম, তোমাদের স্যারেরা আমাকে ফোন করছেন কেন? সারেন্ডার নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে আবহাওয়ার কারণে। অন্য কোনো সমস্যা তো হয়নি। মন্ত্রী সময় জানিয়ে দিবেন আগামী কয়েক ঘন্টার মধ্যে। এদিকে নির্ধারিত সময়ের বাইরে মাস্টার বাহিনীকে রাখা নিয়ে আইনগত জটিলতা কী ভাবে কাটাবে সেটা তোমাদের ব্যাপার। ফোন বন্ধ করলাম। বললাম, এতো পরিশ্রম, ঝুঁকির পর তোমাদের স্যাররা কটু কথা বলছেন? আমি কী করছি, কী করেছি উনারা জানেন না?
সোজা হেঁটে লঞ্চ-এর সামনের দিকে গেলাম। আমার মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে, রাখতেই হবে। তেমন কিছু করার নাই জেনেও আমাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তীরে এসে তরী ডুবানো যাবে না কিছুতেই। ফোন দিলাম RAB-এর গোয়েন্দা প্রধানকে। উনি বললেন, সারেন্ডারে আপনার ভূমিকার কথা সবাই জানেন না। এছাড়া পুরো বিষয়টি গোপন রেখেছিলাম বলে কেউ কেউ ভুল বুঝছেন। আমাকে মাথা ঠান্ডা রাখার অনুরোধ করলেন তিনি। কিন্তু সারেন্ডার অনুষ্ঠানের সময় সূচি নিয়ে কিছু বলতে পারলেন না।
ফোন দিলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। ততোক্ষণে তিনি ঢাকা ফিরেছেন। ফোন ধরে বললেন, অন্য কোনো সমস্যা নাই। আবহাওয়ার কারণে হেলিকপ্টারে মংলা যাওয়া সম্ভব হয়নি। জানালেন, বিষয়টি তিনি প্রধানমন্ত্রীকেও জানিয়েছেন। দুই এক দিনের মধ্যে তিনি আসবেন বলে নিশ্চিত করলেন আমাকে। বললাম, দিন ক্ষণ নিশ্চিত না করলে বিভিন্ন মহলে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আপনি সময়টি নিশ্চিত করেন।
মস্ত্রীর সাথে কথোপকথনের সময় সামনে দাঁড়ানো মাস্টারসহ কয়েকজন দস্যু। আমার অসহায়ত্ব দেখে তারা বললো, আপনি মংলা চলে যান। আজ তো আর কিছু হচ্ছে না। তিনদিন ঘুমান না। মংলায় কোনো হোটেলে গিয়ে একটা ঘুম দেন। বললাম, আপনাদের রেখে কী করে যাই? ওরা বললো, মেজর স্যারের কাছে আমরা নিরাপদ। সারেন্ডার করেছি স্বেচ্ছায়। সেজন্য তিনি আমাদের এতো সম্মান দিচ্ছেন যেটা আমরা চিন্তাও করিনি। আদনান স্যার আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।
এসময় ফোন আসলো একটি অচেনা নাম্বার থেকে। ওপাশ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস পরিচয় দিয়ে জানালেন, ৩১ মে সকাল ১০টায় সারেন্ডারের নতুন সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রী আপনাকে এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে বলেছেন। ফোন রাখতেই ফোন দিলেন লে কর্নেল আজাদ। জানালেন একই তথ্য। ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রাখলাম। মেজর আদনানকে বললাম, মাঝে একটা দিন আছে। আমি মংলা গেলাম বিশ্রাম নিতে। অস্ত্র-গুলিসহ সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুদল মাস্টার বাহিনীকে নিয়ে বনেই থেকে গেলো RAB। বেলায়েত সরদারকে ডাক দিয়ে বললাম, নোঙ্গর তোলেন।