রূপান্তরের গল্প ১২৯ | Rupantorer Golpo 129

আত্মসমর্পণ করলো জলদস্যু দল- মাস্টার বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ১২৯

আত্মসমর্পণ করলো জলদস্যু দল- মাস্টার বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ১২৯ | Rupantorer Golpo 129 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১২৯ : ৩১ মে ২০১৬, সকাল ৮টা। পশুর নদীর সাথেই ফুয়েল জেটি। মংলা বন্দর সংলগ্ন এই জায়গায় হবে চুড়ান্ত আত্মসমর্পণ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন সকাল ১০টায়। আমরা সকাল সকাল পৌঁছে গেছি। সরাসরি সম্প্রচারের যন্ত্রপাতি বসানোর কাজ শেষ করলেন সহকর্মীরা।

নদীতে ভাসমান জেটিতেই হবে অনুষ্ঠান। বরিশাল থেকে RAB-এর কর্মকর্তারা এসেছেন। অধিনায়ক লে কর্নেল ফরিদ ছিলেন নেতৃত্বে। ওদিকে দস্যুদল মাস্টার বাহিনীসহ প্রস্তুত মেজর আদনান। সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া থেকে পশুর নদী ধরে রওনা হয়েছে তারা। বাগেরহাট, খুলনা থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসে পৌঁছেছেন নয়টার দিকে। এসেছেন স্থানীয় সাংবাদিকরাও। জলদস্যু-বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ, সুন্দরবনের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা। তাও আবার সবচেয়ে বড় দস্যুদল- মাস্টার বাহিনী সারেন্ডার করবে।

খুলনা, বাগেরহাটের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা হলো। ভাবলাম শুভেচ্ছা বিনিমিয় করি। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, কয়েকজন কর্মকর্তা আমাকে দেখেও দেখছেন না। করমর্দন করতেও অনীহা। মনে হলো ভিতরটা শূণ্য হয়ে যাচ্ছে। উৎসাহিত করার পরিবর্তে আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন আমাকে তাঁরা একদমই পছন্দ করছেন না। অথচ সকলের সাথে আগের পরিচয় ছিলো, একসাথে চা-ও খেয়েছি একাধিকবার। কয়েক জনের সঙ্গে রীতিমতো সখ্যতা ছিলো। আজ তাঁরা শীতল আচরণ করলেন।

হেলিকপ্টার রওনা দিয়েছে ঢাকা থেকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসছেন। সঙ্গে আসছেন RAB-এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক অপারেশনস কর্নেল আনোয়ার লতিফ, গোয়েন্দা প্রধান লে কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, পরিচালক মিডিয়া কমান্ডার মুফতিসহ কয়েক জন। মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ আগের দিন বিদেশ সফরে গেছেন বলে আসতে পারেননি। আসতে ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। আড্ডা দিলাম সাংবদিকদের সঙ্গে। ছোট একটা প্যান্ডেল, তার নিচে বসার ব্যবস্থা। বরিশাল RAB-এর অধিনায়ক লে কর্নেল ফরিদ ছিলেন ক্যাডেট কলেজ সূত্রে বড় ভাই। বললেন, তোমাদের নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমি বললাম, আপনারাও আমাকে দুশ্চিন্তায় রেখেছেন। ঠান্ডা মাথায় পুরো বিষয়টি জানালাম। বললাম, একটা কাজ করছি আমি মানুষের জন্য। সহযোগিতা না করলেও সমস্যা ছিলো না, অসহযোগিতা প্রত্যাশা করিনি।

হেলিকপ্টার আসতে আর কতোক্ষণ লাগবে? এদিক সেদিক থেকে খোঁজ নিচ্ছি। সময় কাটছেই না। গেলো দুই দিনে স্বনাষ্ট্রমন্ত্রীর আসা, না আসা নিয়ে ভয়ঙ্কর চাপ গেছে। এমন চাপ আপাতত আর নিতে পারবো না। সেদিন আমার ওই প্যান্ডেলে আমার জন্য কোনো আসন রাখা ছিলো না। ভাবছি কী হচ্ছে তাহলে? এটুকু সম্মান তো তাঁরা আমাকে দিতেই পারতেন।

অনুষ্ঠান স্থলে ব্যস্ততা বাড়লো। সময় ঘনিয়ে এসেছে। দূর থেকে হেলিকপ্টারের শব্দ পাচ্ছি। সাংবাদিকরা প্রস্তুত হলেন। পাশেই নামলো হেলিকপ্টার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবেন। এদিকে পশুর নদীর মাঝখান দিয়ে এগিয়ে আসছে মাস্টার বাহিনীকে নিয়ে RAB এর লঞ্চ। দুই দিকে স্পিডবোটে সশস্ত্র পাহাড়া। একদিকে মন্ত্রীসহ অন্যরা হেঁটে আসছেন। অন্যদিকে লঞ্চ এসে ভিড়লো জেটিতে। জলদস্যু বাহিনীর সমর্পণ করা অস্ত্রগুলো সাজানো হলো। একে একে নামানো হলো দশজন জলদস্যুকে।

মাস্টার বাহিনীর প্রধান মোস্তফা শেখ ওরফে মাস্টার এবং তাঁর বাহিনীর সদস্য সোহাগ আকন, সোলায়মান শেখ, সুলতান খাঁ, ফজলু শেখ, শাহীন শেখ, সুমন সরদার, আসাদুল ইসলাম, হারুন ও আরিফ সরদার। অনুষ্ঠান শুরু হলো। একে একে সবাই অস্ত্র তুলে দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে। সমর্পণ শেষে দস্যুদের অস্ত্রের বহর দেখলেন। পাশে দাঁড়ানো কর্মকর্তাদের বললেন, নতুন নতুন সব অস্ত্র, এগুলো আসলো কোত্থেকে? কারা দিচ্ছে এসব অস্ত্র? প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কর্মকর্তারা বললেন, খোঁজ নিয়ে অস্ত্রের যোগান দাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে অন্য দস্যুদলগুলোকেই আত্মসমর্পণ করানোর নির্দেশ দেন তিনি। বলেন, যেকোনো মূল্যে দস্যুতা নির্মূল করতেই হবে। সেদিন অস্ত্র জমা হয়েছিলো ৫২টি, গুলি ছিলো সাড়ে চার হাজার। আমরা বন থেকে আসার পর দস্যুদের বহরে যোগ দিয়েছিলো আসাদুল নামের আরেক দস্যু।

আমি পুরোটা সময় যমুনা টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারে ছিলাম। মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা থেকে বেরিয়ে একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করলাম। আমার টেলিভিশনের নিউজরুম সেদিন এই ঘটনাটি নিয়ে সরগরম। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হলো খবর- মোহসীন উল হাকিমের মধ্যস্ততায় আত্মসমর্পণ করলো সুন্দরবনের ত্রাশ মাস্টার বাহিনী।

অনুষ্ঠান শেষ করে যাওয়ার সময় পিঠে হাত রাখলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ধন্যবাদ জানালেন। বাহবা দিলেন। বললেন, আমি তো জানতাম সুন্দরবনের দস্যুরা তেমন শক্তিশালী না। অস্ত্র আর গোলাবারুদের দিক থেকেও তাদের সামর্থ নিয়ে সংশয় ছিলো। কিন্তু এখন দেখছি ওরা বেশ শক্তিশালী ছিলো। এতোগুলো অস্ত্র! বললেন, বাঁকী সদস্যরা কই গেলো? বললাম, ভয় পেয়েছে। জানালাম, ২৬ জনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে RAB। যার উদ্দেশ্য অন্যদের সারেন্ডারে প্রলুব্ধ করা। দস্যু জগতের মানুষদের ভয় কাটানোর জন্য আরও কিছু কাজ করেছি আমরা। আশা করি বাঁকীরাও একদিন সারেন্ডার করবে। পিঠে হাত বুলিয়ে আবারও বললেন, সাবাশ! গত কয়েকদিনের কষ্ট, বঞ্চনা, হাতাশা এক নিমিষে উড়ে গেলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বললেন, অন্য দলগুলো নিয়ে কাজ করবে না? বললাম, আপনি বললে চেষ্টা করবো। বিদায় নিলেন মন্ত্রী।

বিরাট বড় বোঝা নামলো কাঁধ থেকে। ভেবেছিলাম সবাই বাহবা দিবেন। অথচ সেদিন হাতে গণা দুই একজন ছাড়া আর কোনো কর্মকর্তা ধন্যবাদ জানাননি। মনে মনে নিজেকে নিজে শান্তনা দিলাম। ভাবলাম উনারা স্বীকৃতি না দিক, সাংবাদিকরা নিশ্চয়ই সারেন্ডারে আমার ভূমিকা নিয়ে সংবাদ করবেন।

ভাগ্যিস সেদিন বৃষ্টি ছিলো না। আকাশ পরিস্কার ছিলো। আবার যদি কোনো কারণে সারেন্ডার অনুষ্ঠান বাতিল বা স্থগিত হতো তাহলে সুন্দরবনের দস্যুমুক্তির ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top