আমি ছাড়লেও সুন্দরবন ছাড়লো না | রূপান্তরের গল্প ১৩১ | Rupantorer Golpo 131 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৩১ : বাগেরহাট জেলখানার জেল গেইট। ওপাশে দাঁড়ানো মাস্টার আর সোহাগ। অন্যদের তখনও ঘুম ভাঙ্গেনি। ভেবেছিলাম আমাকে দেখা মাত্র অভিযোগ দিবে তারা। কিন্তু ঘটনা ঘটলো উল্টো দেখা মাত্র ভীষণ খুশি হলো তারা। বললো, কতো বছর পর যে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমালাম ভাই! একটু পর চোখ ডলতে ডলতে হাজির হলো সুলতান কাকা। সবাই মিলে বললো, কয়টা দিন জেলখানায় থাকি ভাই। জেলখানার সবাই খুব ভালো ব্যবহার করেছেন। বিচারকও সুন্দর ব্যবহার করেছেন। মনের ভিতরে একটু শক্তি আসলো।
সারেন্ডারের পর থানা হয়ে বাগেরহাট জেলখানায় গেছে মাস্টার বাহিনীর দস্যুরা। পরদিন ১ জুন সকালে পৌঁছালাম বাগেরহাটে। জেলখানার নিয়মন অনুযায়ী তাদের সাথে সাক্ষাতের আবেদন করলাম। জেল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় দেখা করলাম তাদের সাথে। সুন্দনরবনের ডাকসাইটে দস্যুদের চেহারা পাল্টে গেছে। বাঘগুলো যেন বিড়ালে পরিণত হলো। মনে মনে বললাম, এটাই তো চাই। এই অপরাধীদের মনে অনুশোচনা মানে সংশোধনের সম্ভাবনা। সম্ভাবনা খুঁজে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে সারেন্ডার করা এই দস্যুদের মনোজগতে ঢুকে পড়েছি আমি। তাদের পড়তে পারছি।
এই বনদস্যুদের সাথে কোনো চুক্তি ছিলো না আমার। শুধু একটা কথাই বলেছিলাম, নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন।
গত কয়েক বছরে দস্যুদের সাথে মিশে জেনেছি অনেক কিছু। জঙ্গলের ওই বিভিষীকাময় পরিবেশে না গেলে অনেক কিছুই অজানা থাকতো। দস্যুরা যে তাদের ওই জীবনটাকে উপভোগ করে না, তাদের জোর-জুলুমের উপার্জন নিজেরা ভোগ করতে পারে না, তিনবেলা ঠিকঠাক খাওয়া হয় না। শেষ কবে যে টানা কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়েছে সে কথা মনেও পড়ে না। সারাক্ষণ জীবন সংকটে থাকা, কখন কোথায় কে কাকে মেরে দেয়, কখন যে ধরা পড়ে ক্রসফায়ারে মরতে হয় তার কোনো হিসাবও নাই। এছাড়া উপার্জিত টাকা-পয়সাগুলো নিজের আয়ত্বে থাকে না। নিজের মা-বাবা, স্ত্রী কিংবা সন্তানেরাও ওই টাকা দিয়ে সম্পদ বানায় নিজেদের নামে। মোটকথা অপঘাতে মৃত্যু ছাড়া কোনো বিকল্প নাই।
সোহাগ বললো, ওই জীবন থেকে মুক্তি পাইছি ভাই। তাতেই খুশি হতে না পারলে বেঈমানী করা হবে। আমাদের কোনো চাহিদা নাই। শুধু জামিনের ব্যবস্থাটা করেন আপাতত। বললাম, অস্ত্র মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট জামিন দিতে পারবে না। যতোটুকু জানলাম, তিন দফা জামিনের আবেদন নাকচ হওয়ার পর জজ কোর্টে যাবে মামলা। জজ সাহেবের জামিন দেওয়ার এখতিয়ার আছে। ওরা বললো, তাদের পরিবারের খোঁজ খবর যেন রাখি। সেটা আমি সব সময় করতাম।
জেলখানা থেকে বের হয়ে আদালতে গেলাম। তাদের উকিল সাহেবের সাথে দেখা করে দ্রুত জামিন নেওয়ার বিষয়ে একটু জোরেসোরে কাজ করার অনুরোধ করলাম। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর রওনা দিবো ঢাকার উদ্দেশ্যে। পদ্মাসেতু পার হতে ফেরি ধরতে হবে। ঘাটে প্রচুর চাপ। সন্ধ্যার আগেই ঘাটে পৌঁছাতে হবে।
ঢাকা থেকে সুন্দরবন যেতে পদ্মা নদী পার হতেই হবে। গোপালগঞ্জে ছোট্ট বিরতি। সেখানকার সাংবাদিকদের সঙ্গে চা খেয়ে আবার ছুটলাম। মাওয়া ঘাটে পৌঁছে দেখি বিশাল বড় লাইন। পার হতে রাত পেরিয়ে যাবে। পদ্মাসেতুর কাজ হচ্ছে এদিকে। চারপাশে অনেক ব্যস্ততা। খোঁজ খবর নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ফরিদপুর গেলাম। প্রেস ক্লাবে বসে সাংবাদিক ভাইদের সাথে গল্প-গুজব করলাম। তারপর খোঁজ খবর নিয়ে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাট। ঘন্টা খানেকের মধ্যে ফেরি পেলাম। পার হয়ে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া হয়ে ঢাকা ফিরবো।
ফিরতে ফিরতে দেখা করলাম সবুজের সাথে। সবুজ ওই ২৬ জন সারেন্ডার না করা দস্যুদের একজন। গ্রামের বাড়িতে ফিরেছে সে। আর দস্যুতায় যাবে না। আমি বললাম, আপনি আবার যাবেন নিশ্চিত। এবারে সরকার কিছু বলেনি। কিন্তু সামনে ধরা পড়লে বাঁচতে পারবেন না। জানি না আপনাদের কে উস্কানি দিয়ে সারেন্ডার করতে দিলো না। তারাও কিন্তু বাঁচবে না ভাই। সেদিন পুরো পথ ফোনে কথা বলেছি। সারেন্ডার না করা দস্যুদের যাদের নাম্বার ছিলো সবাইকে ফোন দিলাম। কাউকে পেলাম না।
নতুন এবটা নাম্বার থেকে ফোন এলো। ওপাশ থেকে সালাম দিয়ে আবার ফোন রেখে দিলো বা কেটে গেলো। রাত আটটা বাজে। এতো রাতে সুন্দরবনের দস্যুদের ফোন দেওয়ার কথা না। তবুও অপেক্ষা করলাম। মনে হচ্ছিলো সুন্দরবনের ফোন। ওদিকে নেটওয়ার্ক কম থাকায় কল কেটে যায়। মিনিট দুই পর আবার ফোন আসলো। পরিচয় দিলেন। বললেন মজনু বাহিনীর প্রধান মজনু। পশ্চিম সুন্দরবনের বড় দস্যুদল।
মজনু ভাই কেমন আছেন? আপনি তো ডাকাতি ছেড়ে দিয়েছিলেন। আবার নেমেছেন ডাকাতি করতে? মজনু ভাই বেশ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, পালিয়ে থাকা জীবন কোনো জীবন হলো ভাই? কখন ধরা পড়ে যাই! লোকালয়ে ধরা পড়ে ক্রসফায়ারে মরার চেয়ে জঙ্গলে বসে মরা ভালো। আর যদি আত্মসমর্পণের সুযোগ পাই, সরকার যদি সাধারণ ক্ষমা দেয়, তাহলে সেই সুযোগটি নিতে চাই। বললাম, সাধারণ ক্ষমা কিন্তু না। আর মাস্টারদের নামে সারেন্ডারের সময় একটা অস্ত্র মামলাও হয়েছে। সাধারণ ক্ষমা মাথায় নিয়ে সারেন্ডার করাতে পারবো না।
মজনুকে বললাম, কেবল একটা সারেন্ডার হলো। আমি একটু বুঝে নেই। মাস্টার বাহিনীর সাথে কী হয় সেটাও দেখেন। মজনু বললেন, ওদের তো আর ক্রসফায়ার দেয়নি ভাই। জেলখানায় আছে, তাও তো বেঁচে আছে। নিজেরা ঘুমাতে পারবে, পরিবারের লোকজনও ঘুমাতে পারবে। বললাম, এখন পর্যন্ত সব ভালো। আমি একটু সময় নিবো। উনি বললেন, আলম বাহিনীও সারেন্ডার করবে। বললাম, আমাকে ফোন দিতে বলবেন।
আপনার দলের সদস্য সংখ্যা কতো? অস্ত্র আছে কয়টা? মজনু বললেন, অল্প কয়টা। সব মিলিয়ে ১০/১২ টা। বললাম, আপনাকে আমি সারেন্ডার করাতে পারবো না ভাই। আপনি অস্ত্রের সঠিক হিসাব বলেননি।
পশ্চিম সুন্দরবনের পুরনো দস্যুদল মজনু বাহিনী। আপনি তো সেই জলদস্যু! মোতালেব বাহিনীর মোতালেবের মৃত্যুর পর লিডার হয়েছেন। তখন তো আপনাদের কাছে ৬০/৭০টি অস্ত্র। আর এখন বলছেন ১০/১২টা। মিথ্যা বললে চলবে না ভাই। মজনু বললেন, অস্ত্র ছিলো। কিন্তু দল তো ভাগ হয়ে গেছে। আল আমিন কিছু অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। দুই বার আমরা অন্য দস্যুবাহিনীর হামলার শিকার হয়েছি। তখন কয়টা অস্ত্র গেছে। তবুও অন্তত ৩০টি অস্ত্র থাকার কথা আপনার কাছে। মজনু বললেন, আপনি একবার আসেন। নিজের চোখে দেখে যান আমাদের কী আছে, কী নাই! আমার এতো আগ্রহ নাই, এমন ভাব নিয়ে ফোন রাখলাম।
আগ্রহ নাই কথাটি ঠিক না। ভিতরে ভিতরে আমি ভীষণ উত্তেজিত। কারণ সারেন্ডার নিয়ে যে মহাপরিকল্পনা করছি মনে মনে সেই কাজটি মনে হয় শুরু হচ্ছে। তার মানে মাস্টার বাহিনীর সারেন্ডার শেষে সুন্দরবন ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও সুন্দরবন বোধ হয় আমাকে ছাড়ছে না।
(নোট: আপনারাও ছাড়বেন না। আমিও আপনাদের ছাড়বো না। রূপান্তরের গল্প চলবে)