রূপান্তরের গল্প ১৩৩ | Rupantorer Golpo 133

সুন্দরবনে চলছে এলাকা দখলের লড়াই | রূপান্তরের গল্প ১৩৩

সুন্দরবনে চলছে এলাকা দখলের লড়াই | রূপান্তরের গল্প ১৩৩ | Rupantorer Golpo 133 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৩৩ : ১০/২০ লাখ টাকা খরচ করা লাগলে করবো। আমাকে সারেন্ডার করায়ে দিয়েন ভাই। বিছানায় আমি, তখনও ঘুম ভাঙ্গেনি। সকাল সকাল ইলিয়াসের ফোন। বললাম, আমার সাথে টাকা পয়সার লাইনে কথা বললে কোনো কাজ হবে না ভাই। বরং ভালো করে খোঁজ নেন। ইলিয়াস বললো, না ভাই সেভাবে বলিনি। যদি কোথাও কোনো খরচ লাগে। বললাম, পুরো সারেন্ডার প্রক্রিয়ায় এক টাকাও খরচের কারবার নাই।

কথায় কথায় টাকার কথা আসে সুন্দরবনের ওই জগতে। টাকা না নিলেও মাছ নিতে হবে। উপহার হিসাবে মাছ বেশ চলে। কাউকে ফোন দিলেই বলে একটা নাম্বার দেন ভাই। বলি, এটাই তো আমার নাম্বার। বলে, কিছু টাকা পাঠাবো। একটা ফোন কিনে নিয়েন। বললাম, আমার ফোন আছে। বলে, কিছু একটা তো নিবেন ভাই। বলি এতো টাকা আপনাদের? দস্যু জগতে টাকার ছড়াছড়ি ছিলো।

সুন্দরবনের দস্যুদের নিয়ে খুব বেশি জানা নাই আমাদের। কী দস্যুতা করে? কী ভাবে করে? কারা তাদের টাকা দেয়? কী ভাবে চলে? বাজার দেয় কারা? কিছু জানি, বাঁকীটা জানার চেষ্টা করছি। ইলিয়াসের ওই কথাটি মনে পড়ছে বার বার- “বন্দুক হাতে জোন খাটি”।

দুর্ধর্ষ সব দস্যুদের মুখে মুখে সারেন্ডারের গল্প ঘুরছে। সমাজ থেকে বিচ্যুত, আইনের চোখে পলাতক মানুষগুলোর বয়স ১৭ থেকে ৫৫ বছর। এদের কেউ কৈশোরেই পা বাড়িয়েছে অপরাধের পথে। আবার কেউ ৪০ বছর পার করে ভাগ্যচক্রে নেমে পড়েছে জঙ্গলে। কেউ ফেরারি হয়ে আবার কেউ ঋণ শোধ করনে না পেরে দস্যু হয়েছে। কেউ ঋণ শোধ করবে বলে ডাকাতি করতে নেমেছে। আবার কেউ নেহায়েত সঙ্গদোষে। যে, যখন, যে কারণেই নামুক, নামার পর আর ফিরে যেতে পারেনি।

জঙ্গলের ওই বিভীষিকা থেকে বের হতে গিয়ে জীবন হারিয়েছে অনেকেই। যেন অপরাধ ম্বীকার করে সাজা খাটার পথও নাই। মনে অনুশোচনা আসলেও পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ নাই। মৃত্যুই যদি একমাত্র পথ হয় তাহলে ওই অপরাধে জড়িয়ে পড়া মানুষেরা সংশোধন করবে কী করে? আর সংশোধনের সুযোগ তো সবারই পাওয়ার অধিকার আছে, সে সুযোগ দেওয়াও উচিৎ।

ইলিয়াসের স্ত্রীর সাথে কথা বললাম। কণ্যা ফাতেমার সাথেও কথা হলো। তাদের কাছে জানতে চাইলাম সত্যি কি সারেন্ডার করবে ইলিয়াস? আগের বার যখন তাকে বলেছিলাম তখন কিন্তু প্রত্যাখ্যান করেছে সে। ইলিয়াসের স্ত্রী বললেন, আমাদের একটু সুযোগ করে দেন ভাই। বাড়ি ফিরে কামলা দিয়ে খাবো। কিন্তু এই জীবন আর না। বললাম, সময় হলে জানাবো। আর নির্দিষ্ট একটি নাম্বার থেকে যোগাযোগ করবেন। আমিও সেই নাম্বারে যোগাযোগে থাকবো। ইলিয়াসকে বললাম, শুধু সাতটা অস্ত্র আছে? না কি বনের ভিতরে আরও কিছু চাপানো আছে? বললেন, কয়েকশ’ গুলি রাখছিলাম এক জায়গায়। ভেঙ্গে না গেলে খুঁজে পাবো। কথা শেষে আমাদের কথোপকথন গোপন রাখতে বললাম।

সেদিন আমার অফিস ছুটি ছিলো। তবুও তৈরি হয়ে অফিসে গেলাম। সহকর্মীরাও উদগ্রীব। অফিসে পৌঁছাতেই তা টের পেলাম। নিউজরুমের সহকর্মীরা স্বাগত জানালো। আমার কাছে সহকর্মীদের হাত তালির চেয়ে বড় পুরস্কার আর হয় না। সবাই অভিনন্দন জানালো। এর কিছু দিন পর যমুনা টেলিভিশনের প্রয়াত চেয়ারম্যান আমাকে বর্ষ সেরা রিপোর্টারের স্বীকৃতি দেন। পুরস্কার হিসাবে পাই দুই লাখ টাকার চেক। চারপাশের অভিনন্দনে ভাসছিলাম। কাছের সাংবাদিকরাও বিষয়টি নিয়ে বেশ খুশি। তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রচারিত সংবাদে আমার নাম নেয়নি। সেটি উনাদের সম্পাদকীয়র সিদ্ধান্ত।

দুই দিন পর অনলাইন সংবাদ মাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনে একটি সাক্ষাৎকার আসলো। সাংবাদিক হারুন ভাই লিখলেন- দস্যুজয়ী সাংবাদিক মোহসীন উল হাকিম। সেই সাক্ষাৎকারে উঠে আসে খবরের পিছনের খবর।

সাংবাদিক আমি। ফুলটাইম চাকরি। দৈনন্দিন কাজে সময় দিচ্ছি এর পর থেকে। পাশাপাশি পুরনো কাজের জায়গা গুলোতে আবার কাজ শুরু করবো ভাবছি। পাহাড়ের সন্ত্রস্ত জনপদ, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত নিয়ে কাজে লম্বা বিরতি গেছে সুন্দরবনের কাজের কারণে। তখনও রোহিঙ্গা সংকট চলছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের অনুপ্রবেশ ঘটবে। সমুদ্র পথে মানব পাচার নিয়ে বেশ ঝামেলা চলছে। আবার পূর্ব উপকূলের ভয়ঙ্কর জলদস্যুদের নিয়েও কাজ করতে হবে। মহেশখালী, কুতুবদিয়া, বাঁশখালীর দস্যুদের নিয়ে কাজ শুরু করেছি বেশ আগে। কিন্তু এগিয়ে নিতে পারিনি।

বাঁশখালীর রহিমা ডাকাত পলাতক। সাগরে ৩২ জেলেকে একসাথে কেটে, সাগরে ফেলে দেয় তার বাহিনী। সোনাদিয়ার নাগু মেম্বারের লোকজনও ছিলো বেশ হিংশ্র। এদের সাথে নতুন করে যোগাযোগ শুরু করলাম। সামনের কয়েক মাস দেশের মধ্য ও পূর্ব উপকূলের পুরনো সোর্সদের সাথে নতুন যোগাযোগ শুরু করলাম। সুন্দরবনে দীর্ঘ সময় কাটানোর কারণে এদিকের সোর্সরা দূরে সরে গেছেন। কারও কাছে পুরনো নাম্বার নাই। ওদিকে পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করলাম।

সুন্দরবনের দস্যুদের নিয়ে কাজগুলো এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। চার/পাঁটটি দস্যু দলের সাথে কথাবার্তা চলছে সমান তালে। পূর্ব সুন্দরবনের শান্ত বাহিনীর সাথে কথা চলছে। পশ্চিমের আলম বাহিনীও না কী সারেন্ডার করতে চায়। আলিফ বাহিনীর প্রধান আলিফকে খুঁজছি। কারণ এই দস্যুদলটি জেলেদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে বেশি। পূর্ব আর পশ্চিম সুন্দরবন মিলিয়ে ১৮/২০ টি দস্যুদল দস্যুতা করছে। মাস্টার বাহিনী উঠে আসার পর তাদের এলাকা দখলের লড়াই চলছে জাহাঙ্গীর ও নোয়া বাহিনীর মধ্যে। মাঝে মাঝে তারা একে অপরকে সশস্ত্র আক্রমণ করছে। মধ্য সুন্দরবনে যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ রক্তপাত!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top