ডিঙ্গি নৌকায় উঠে বসলাম, যাচ্ছি মজনু ডাকাতের ডেরায় | রূপান্তরের গল্প ১৪০ | Rupantorer Golpo 140 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৪০ : বড়শিতে একের পর এক মাছ উঠছে। বড় বড় রুই আর কাতলা মাছ। বড় মাছ বড়শি খাচ্ছে মানে মরা গোন চলে। বন উপকূ্লে জালে মাছ হয় গোন-এর সময়। আর বড়শিতে বড় মাছ ওঠে মরা গোন-এ। তার মানে আমরা সুন্দরবনে ঢুকছি মরা কাটালে। এসময় বনের খাল নদীতে জেলেরা থাকে না। কিছু কাঁকড়া আর বড়শির নৌকা থাকে। নিরিবিলি ঘুরে আসতে পারবো।
মজনুর লোকটির সাথে কথা বলে ফোন রাখতেই ইলিয়াসের ফোন আসলো। কী ব্যাপার ভাই? অসময়ে ফোন? বললো, ও ভাই আমাকে বাদ দিয়েন না। সারেন্ডার করবো বলে ফাইনাল করছি। বিদেশের মাটিতে থাকবো না। বললাম, সারেন্ডার করবেন সময় আসলে। ইলিয়াস বললো, আপনি মজনুকে নিতে যাচ্ছেন। তাহলে আমি কি বাদ পড়বো। আজ কালকের মধ্যে তো আপনার কাছে পৌঁছাতে পারবো না। আমার তো মাথা পুরোই গরম! মজনুর সাথে দেখা করতে সুন্দরবন যাবো! সে কথা ইলিয়াস জানলো কী করে? বললাম, ও ভাই, এতো খবর রাখেন কী করে? মজনুর কাছে যাওয়ার খবর কোত্থেকে পেলেন বলেন তো?
ইলিয়াস বললো, সুন্দরবনের এক মহাজনের ট্রলারের মিস্ত্রি থেকে ডাকাত দলের সরদার হইছি ভাই। আমি অনেক খবর পাই। খুলনা থেকে একজন জানিয়েছে। খুব গোপন বিষয়। কে বলেছে জিজ্ঞেস করবেন না। আমি বলতে পারবো না।
খুলনা থেকে কেউ জানিয়েছে। মনে মনে হিসাব কষতে থাকলাম। খুলনায় কাকে কাকে জানিয়েছি আমি। হিসাবে গোলমাল লেগে যাচ্ছে। যাই হোক। ইলিয়াসকে বললাম, যেই জানাক, একটু বাড়তি কথা বলেছে। আপনাকে ভুল তথ্য দিয়েছে। আমি যাচ্ছি দেখা করতে। সারেন্ডার কবে হবে জানি না। তবে দিন তারিখ ঠিক হলে জানবেন আপনি। সময় মিলিয়ে চলে আসবেন আমার কাছে।
জঙ্গলে লুকানো অস্ত্রগুলো নিয়ে হাজির হবেন। গুলিগুলোও খুঁজে বের করবেন। তারপর সারেন্ডার করবেন। আপাতত ফোনে এসব কথা বলা ঠিক না ভাই। কে কোথায় থেকে আমাদের কথা শুনছে জানি না। আমার ফোন ট্র্যাক করতে পারে কেউ। আমরা পরে কথা বলবো। তখনও হোয়াটসঅ্যাপ বা ভাইবারে সবাই কথা বলে না। ইমো নামের একটি অ্যাপ চলে খুব। আমি আবার সেটা ব্যবহার করি না। বেশির ভাগ কথাবার্তা সরাসরি ফোন কলেই হতো। সুন্দরবনের দস্যুদের সাথেও সরাসরি কথা হতো।
আলমগীর ভাইয়ের সাথে বিস্তারিত কথা বলে ফোন রাখলাম। উঠে দাঁড়ালাম। রওনা হবো মুন্সিগঞ্জের দিকে। মাছগুলো সাংবাদিক বাপ্পী ভাই ও পুকুর মালিককে বুঝিয়ে দিয়ে সবাই মিলে চলে গেলাম শ্যামনগর। সেখানে ঘন্টা খানেক সময় কাটিয়ে ছুটলাম মুন্সিগঞ্জের দিকে। ইফতার আর মাগরিবের নামাজ নিয়ে এখন ব্যস্ত থাকবে সবাই। এর মধ্যেই নেমে পড়বো আমরা।
মুন্সিগঞ্জে পৌঁছালাম ঠিক ইফতারের আগে আগে। পথে একটি ছোট রেস্তোঁরা থেকে কিছু খাবার কিনেছিলাম। মুন্সিগঞ্জ পৌঁছাতে আযান হলো। ইফতার সারলাম গাড়িতে বসে। চোখ কান খোলা রাখলাম। যেকোনো সময় আসবেন মজনু ডাকাতের প্রতিনিধি আলমগীর।
প্রথম দেখাতেই লোকটিকে মনে ধরে গেলো। বেশ পছন্দ হলো। সুন্দরবনের দস্যুনেতা মজনুর সঙ্গে উনার সম্পর্ক কোন পর্যায়ের জানি না। তবে এই লোকালয় থেকে আমাদের নিয়ে যাবেন যিনি তাঁর সঙ্গে দস্যুনেতার সম্পর্ক নিবিড় ও বিশ্বাসের হবে কোনো সন্দেহ নাই। বললাম, আমরা প্রস্তুত। উনি বললেন, একটু চা খান। নৌকায় বাজার উঠছে। আর একটা জিনিষ পথে আছে। সেটা উঠিয়ে নিয়ে রওনা দিবো। জিজ্ঞেস করলাম না কী জিনিষ পথে আছে। একটু শংকা হচ্ছিলো, অবৈধ কিছু না তো? জিজ্ঞেস করিনি। বললাম, কাজগুলো দ্রুত গুছিয়ে নেন। বাজারে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। এখানে RAB-পুলিশের সোর্স ভরা। আমার উপস্থিতি জানাজানি হলে ঝামেলা হয়ে যাবে।
মুহুর্তেই কোথায় জানি হারিয়ে গেলেন আলমগীর। বাজারের মধ্যে তখন লোকজন কম। কিন্তু মাগরিবের নামাজ শেষ হলেই বাজার ভরে যাবে। ছোট্ট একটি বাজার। চায়ের দোকান দুই/তিনটি। চা খেয়ে দ্রুত সরে পড়তে হকে। গাড়ি সরিয়ে দিলাম প্রধান সড়কে। বাজারের পাশে একটি এনজিও’র গেস্ট হাউজ। তার সামনে গিয়ে এমন ভাবে ঘুরছি যেন লোকজন মনে করে যে আমরা ওই গেস্ট হাউজে উঠেছি। সুশীলন নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার গেস্ট হাউজ সেটি। বাইরে থেকে এসে মানসম্মত থাকার জায়গা তখন ওই একটিই। সেখানে দাঁড়িয়ে আলমগীরের ফিরে আসার অপেক্ষা করছি। একটু টেনশন হচ্ছে। জানি, পানিতে নামার আগে টেনশন যাবে না।
সময় গড়াচ্ছে। নামাজ শেষে ফিরছে লোকজন। আলমগীর ভাইকে ফোন দিলাম। এবার ফোন ঢুকলো। ধরেই বললেন, আপনারা এক মিনিট দাঁড়ান। আমি চলে আসছি। এর মধ্যে সহকর্মী বাঁধনকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিষ কিনে নিতে বললাম। রেজওয়ান বাঁধন আমার যমুনা টেলিভিশনের সহকর্মী। সুন্দরবন সফরে আগে আসেনি কখনও। বললাম ভয় লাগছে না তো? বাঁধন বলে, কী যে বলেন ভাই? আপনার পিছে পিছে হাঁটবো। তারপর যা হয় হবে। বললাম, সুন্দরবন তো হাঁটার জায়গা না। নৌকা-ট্রলারে ভাসার জায়গা। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। সাঁতার জানো তো? বাঁধন বললো, না ভাই, সাঁতার জানি না। তবে নৌকা ডুবলে কিছু একটা ধরে ভেসে থাকতে পারবো।
টিমের অন্য দু’জন সাঁতার জানেন। তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা নাই। আবার আমার সাথে সুন্দরবনে যেতে যেতে তাঁরা অভ্যস্ত। বললাম, দুই/তিন দিন এই লবণ পানির মধ্যে, জঙ্গলের ভিতরে থাকতে হবে। বর্ষাকাল এখন। বৃষ্টিও হবে। এর মধ্যে ক্যামেরাসহ যন্ত্রপাতি নিরাপদ রাখতে হবে, নিজেকেও নিরাপদ রাখতে হবে। পারবে তো? বাঁধন বলে, কোনো সমস্যা নাই ভাই। সুন্দরবনের দস্যুদের দেখার ভাগ্য হবে ভাবিনি কখনও। বাঁধন বেশ উত্তেজিত বিষয়টি নিয়ে। মজনু ডাকাতের ডেরায় যাবে, কাজ করবে, ছবি তুলবে, এসব নিয়েই খুশি সে।
সুন্দরবনের ভিতরে কয়েকদিনের সফর মানে শরীরের ওপর বিশাল চাপ। আর মানষিক ভাবে টিমের কেউ একজন ভেঙ্গে পড়লে পুরো সফরটাই নষ্ট হয়ে যায়। সফরের মাঝখানে হুট করে কাউকে লোকালয়ে পাঠানো যায় না। আমার সফরে তো সেটা অসম্ভব। দস্যুদের কাছে পৌঁছানোর পর চলাফেরা আরও সীমিত হয়ে যায়। চাইলেই নিজেদের মতো চলাফেরা করা যায় না। এছাড়া কেউ গুরুতর অসুস্থ্য হলে পুরো টিম নিয়ে চলে আসা ছাড়া উপায় থাকে না। এজন্য সুন্দরবনে প্রবেশের আগে টিমের পরীক্ষিত সদস্যদের ছাড়া কাউকে সঙ্গে নিতে চাই না।
মুন্সিগঞ্জের বাজারটি একটি ছোট্ট গ্রাম্য বাজার। প্রয়োজন মতো সবকিছু পাওয়া যায় না। বাঁধন ফিরে এসে বললো, ব্যাটারি পাচ্ছি না, ওরা বললো শ্যামনগর বাজারে যেতে হবে। বললাম, আপাতত সম্ভব না। যা কিছু আছে, যে ভাবে আছে গুছিয়ে নাও। আলমগীর ভাই আসলেই রওনা দিবো। বলতে বলতে হাজির আলমগীর। বললেন, আপনারা এখনও রেডি হননি? সব রেডি, নামবো এখন। বলেই আমার ব্যাগটি হাতে নিয়ে রওনা দিলেন। পিছনে পিছনে হাঁটলাম আমরা।
মুন্সিগঞ্জ বাজারের পিছনেই ছোট একটা নদী। নাম- চুনা। ভাটা হয়ে গেছে বলে নদীটিকে আরও ছোট লাগছে। হাঁটা পথ শেষ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম সবাই। পথ শেষ। সামনে কাঁদা। আমরা যাবো কোন ট্রলারে? ট্রলার কোথায়? আলমগীর ভাই বললেন, নৌকায় যাবো আমরা। ওই যে নৌকা। বলেই নৌকায় থাকা মাঝিকে নৌকা ঠেলে আনতে বললেন। কিন্তু ওই জায়গা থেকে নৌকা ঠেলে আনা সম্ভব? তবুও কাঁদায় নেমে চেষ্টা করছেন তিনি। বললাম, নৌকায় যাবো আমরা? ওইটুকু নৌকায় এতো মানুষ উঠবো? ডুবে যাবো না?
আলমগীর ভাই বললেন, কোনো সমস্যা হবে না ভাই। এই নৌকা নিয়েই যাবো। বললাম, তাহলে এখানে আনার দরকার নাই। বলতে বলতে জুতা খুলে ফেললাম, প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়লাম কাঁদায়। বুঝতে পারিনি যে সেখানে কাঁদা অনেক। হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেলাম। পড়তে পড়তে কোনো রকমে দাঁড়ালাম। সহযাত্রীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে। মৃদু বকা দিয়ে বললাম, জুতা খোলেন সবাই। নেমে পড়েন। ব্যাগ-বোচকা নিয়ে যাবেন উনারা।
আলমগীর ভাই একে একে অন্যদের নিয়ে নৌকায় তুললেন। তারপর ব্যাগগুলো উঠানো হলো নৌকায়। শেষে কাঁদা ভেঙ্গে হাঁটা দিলাম। নৌকায় উঠলাম। আমরা চার জন, আলমগীর ভাই ও একজন মাঝি মিলিয়ে ছয়জন। ঠোট্ট ওই ডিঙ্গি নৌকার ফাঁকা জায়গাটুকু বাজার সদা, আমাদের ব্যাগ ও ক্যামেরার ব্যাগে ঠাসা। চার/পাঁচটি পাঁচ লিটারের খাবার পানির বোতল রাখা ছিলো নৌকায়। সেগুলো কোলে না নিলে নিজেদের বসার জায়গা হতো না। নৌকার খোল ভর্তি করে বাজারের ব্যাগ রাখা ছিলো আগে থেকেই।
এই কষ্টটা করার দরকার ছিলো না ভাই। আমরা ওই ফরেস্ট অফিসের জেটি থেকে উঠতে পারতাম! বিকালে কথাটি বলেছিলেন তিনি। কিন্তু আমি নাকচ করেছি। বনদস্যুদের সাথে দেখা করতে যাবো। খুব গোপন বিষয়। এমনিতেই বাজারের লোকজন দেখছে। তার উপর আবার ফরেস্টের ঘাট দিয়ে নামবো? পাশেই RAB-এর ক্যাম্প। নৌ পুলিশও আছে। সবাই দেখে ফেলবে ভেবে ফরেস্টের জেটি দিয়ে নামবো না বলেছিলাম। উনি বললেন, আরে ভাই এটা কোনো ব্যাপার না। এখানে সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। আর আপনাকে এদিকের মানুষ সেভাবে চিনেও না।
নৌকা ভাসলো চুনা নদীতে। ভাটার স্রোতের বিপরীতে যাচ্ছি। পিছনে মাঝি, সামনে আলমগীর ভাই। দু’জনে মিলে বৈঠা বাইছেন। নদীর ওপাশ দিয়ে জঙ্গল ঘেঁষে এগুবো আমরা। চুনা নদীর এক পাশে সুন্দরবন, অন্য পাশে লোকালয়। ডিঙ্গি নৌকায় করে একটি বনদস্যু দলের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। তাও আবার সন্ধ্যা বেলা, লোকালয় ধরে। একদম নতুন অভিজ্ঞতা। আলমগীর ভাইকে বললাম, কতোক্ষণের পথ ভাই? এভাবে কতোদূর যাবো আমরা? কোথায় যাচ্ছি? বললেন, চুপচাপ বসে থাকেন ভাই। এখন এতো কথা বলা যাবে না।
(ছবি: সুন্দরবনে মজনু বাহিনীর ডেরা, জুলাই ২০১৬)