আলোর ইশারা দিলো মজনু বাহিনী! | রূপান্তরের গল্প ১৪৩ | Rupantorer Golpo 143 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৪৩ : মালঞ্চে উঠে দক্ষিণের পথ ধরেছি আমরা। দমকা বাতাসে দুলছে নৌকা। মনে হচ্ছে কখন জানি ডুবে যাই। মাঝি ভাই এখন সামনে বসা। বললাম, ডুবে যাবো না তো? উনি বললেন, শক্ত করে ধরে বসেন। নৌকা ডুববে না। আপনাদের বসায় ঝামেলা আছে। নৌকায় ব্যালেন্স করে বসতে হয়। ওজন দুই পাশে সমান রাখতে হয়। কিন্তু আপনারা বেশি নড়াচড়া করছেন। বললাম, প্রায় তিন ঘন্টা ধরে এক ভাবে বসে থাকা যায়? ছোট্ট নৌকায় থাকার অভ্যাস আছে আমার। কিন্তু অন্যরা তো অভ্যস্ত না। কিছু না বললেও বুঝতে পারছি অনেক কষ্ট হচ্ছে তাদের।
হরিণ ডাকছে পাশের জঙ্গল থেকে। একটু পর পর ভিতর থেকে সরসর শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে আমাদের উপস্থিতি কাউকে বিরক্ত করছে। সামনে পিছনে বৈঠা চলছে সমানে সমান। আমরা মালঞ্চ নদী ধরে যাচ্ছি দক্ষিণে। লোকালয় থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। নদীর ডান পাশ ঘেঁষে যাচ্ছে নৌকা। স্রোত উল্টো হলে একদম তীর ঘেঁসে চলা জঙ্গলের নিয়ম। এসময় তীরে স্রোতের চাপ একটু কম থাকে। কোথাও কোথাও উল্টো স্রোত হয়। তখন নৌকা চালানো একটু সহজ। আমাদের দুই মাঝির অনেক কষ্ট হচ্ছে। আর নড়াচড়া না করে ওইটুকু জায়গার মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে কষ্টে মরে যাচ্ছি আমরা। ভাবছি এই জঙ্গলে দিনের পর দিন কেমন করে কাটে জেলেদের!
শুরুর দিকের কথা। মানে ২০০৯/২০১০ সাল। তখন ঘন ঘন পশুর নদীর বাওনে ঘুরে বেড়াতাম। ওদিকের বনদস্যুদের খুঁজছি। কিন্তু কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না কেউ। পশ্চিম সুন্দনবনের মোতালেব ডাকাতের সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু দেখা হওয়ার আগেই ক্রসফায়ারে মারা যায়। তারপর দীর্ঘ সময় কোনো দস্যুনেতার সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তখনও বেলায়েত সরদারের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। পশুর নদীর দুই পাশের খাল-নদীতে তখন চুরি করে ঢুকে পড়তাম জেলেদের সাথে।
একবার শ্রাবণ মাসে গেছিলাম সুন্দরবনের ঝাপসি খালে। টানা চৌদ্দ দিন ছিলাম। যদি চলতি পথে কোনো বনদস্যু দলের দেখা পাই! বর্ষার সময় সুন্দরবনটা সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে। কিন্তু এসময় জেলেদের নৌকায় জীবন যাপন সবচেয়ে কষ্টের। সেবার বাইড়ে পোকার কামড়ে আমার পুরো শরীর ফুলে যায়। পানিতে ভিজতে ভিজতে ত্বক সাদা হয়ে যায়। ফিরে আসবো আসবো করেও তখন ফিরতে পারিনি। ফেরির নৌকা মানে মাছ নিতে আসা মহাজনের নৌকা ছাড়া ফিরার রাস্তা ছিলো না। পরে জেলেদের নৌকাতে করে ফিরার চেষ্টা করেছিলাম। ওই আবহাওয়ায় ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে পশুর নদী পাড়ি দেওয়া আমার কাজ না। তবুও নৌকা বেয়ে পার হয়েছিলা।
জোংড়া খাল দিয়ে বের হলে পথ অনেক সহজ হতো। কিন্তু বনরক্ষীরা দেখলে কী বলবে কে জানে? আমাকে নিয়ে জেলেরা সেই ঝুঁকি নিবেও না। পরে আন্ধারিয়ার বিলের ভিতর দিয়ে নৌকা বেয়ে পশুরে উঠলাম। রাতের অন্ধকারে বড় নদী পাড়ি দিয়ে ফিরলাম ডাঙ্গায়। মংলার জয়মনিরঘোলে যে বড় সাইলোটি আছে, তার জেটির পাশ দিয়ে উঠে মংলা ফিরেছিলাম। সেবার যে কষ্ট করেছি তার তুলনায় আজকের এই কষ্ট তুচ্ছ। সেবার বনদস্যুদের দেখা পাইনি, ব্যর্থ হয়েছি। আর আজ পশ্চিমের ত্রাস দস্যু মজনুর সাথে দেখা হবে। আগের তুলনায় এই সফর একদম সাদামাটা। তখন বনদস্যুদের খঁজে খুঁজে হয়রান হতাম। পেতাম না তাদের। আর এখন নিজেরা ফোন দেয়, দেখা করতে চায়, সারেন্ডার করতে চায়।
রাত ১২টার মতো বাজে। বনের ভিতর থেকে ডেকে উঠলো কুকু পাখি। মানে আধা জোয়ার হলো। নদীতে পানি বেড়েছে। মরা গোন বা ঢালার সময় বলে পানিতে চাপ বেশি নাই।
নৌকা নিয়ে টাট-এর মুখ পার হচ্ছি। এখানে স্রোত খুবই উল্টা পাল্টা। নদীও বেশ চওড়া এখানে। তার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে টাট-এর খাল। আরও সতর্ক হয়ে বসলাম। জানি না কতোক্ষণ এভাবে চলতে হবে। আর বসতে পারছি না আমরা। সঙ্গীরা বললো একটু বিশ্রাম নিতে হবে। বললাম, বসেই তো আছি সবাই। ওরা বললো, কোথাও একটু বিরতি নেওয়া যায় না? নেমে একটু হাঁটাহাঁটি না করলে হচ্ছে না। এক ভাবে বসে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হয়ে গেছে ভাই। বললাম, এখানে দাঁড়ানো যাবে না ভাই। আর এই রাতে জঙ্গলের কোথায় নামবেন? বাঘের পেটে যাবেন?
ঘাঁই-গুতো খেতে খেতে পার হলাম টাট-এর মুখ। তারপর আবার পশ্চিমে চেপে জঙ্গল ঘেঁষে আগাচ্ছে নৌকা। এই ডানে চাপো, ডানে চাপো। পিছন থেকে আলমগীর ভাই এবার একটু সরব হলেন। কমে আসলো নৌকার গতি।
সেই সন্ধ্যায় নৌকা ছেড়েছি মুন্সিগঞ্জ থেকে। তখন থেকে লোকটি নিজেও কথা বলছেন না। আমাদেরও কথা বলা নিষেধ ছিলো। কিন্তু টাট পার হতেই আচরণ পাল্টে গেলো আলমগীর ভাইয়ের। বৈঠা তুলে রাখলেন। মাঝি ভাইকে বললেন, একটা পান দাও তো! আমি বললাম, নৌকায় চা জ্বালানোর ব্যবস্থা নাই? মেলাক্ষণ চা খাই না। ও ভাই, বাজার করার সময় চা পাতা, চিনি, দুধ নিছেন? বললেন, দুধ কেন ভাই? জঙ্গলে কেউ তো দুধ চা খায় না! বললাম, অসুবিধা নাই। লাল চা বানানো যাবে? চুলা আছে নৌকায়?
আপনাকে হরিণের দুধ দিয়ে চা খাওয়াবানে ভাই। বললাম, হরিণের দুধ তো খাই না আমি। এতোক্ষণে গুমোট পরিবেশটা কাটছে। একটু হাল্কা হচ্ছে চারপাশ। নদী এখানে বেশ চওড়া। জোয়ার আর দখিণা বাতাস একসাথে বইছে। মাঝি ভাই বললেন, খোলের ভিতরে চুলা আছে। কিন্তু চা জ্বালানোর কোনো পাত্র নাই। আগে বললে আনতে পারতাম! আলমগীর ভাই বললেন, তোমাকে এতো কিছু বলার সময় পাইছি? হঠাৎ করে সবকিছু হলো। আর ছাগলটা কিনতে সময় চলে গেছে। মজনু সাহেব বললো, ঢাকার বড় মেহমান আসবে। ছাগলটাও বড় হতে হবে। আরে ভাই এক ঘন্টার মধ্যে পছন্দ মতো ছাগল পাওয়া সোজা কথা? পান মুখে দিয়ে গলা ছেড়ে গান ধরলেন আলমগীর।
আমি ভাবছি অন্য কথা। এতোক্ষণ আমাদের কখা বলতে দেননি যে মানুষ। তিনি এখন এসে গান ধরলেন কেন? প্রয়োজনের চেয়ে জোর গলায় কথা বলছেন কেন? ঘটনা হলো, নির্দিষ্ট জায়গা পাও হওয়ার পর যে অঞ্চলে দস্যুদের থাকার কথা আমরা সেই এলাকায় চলে এসেছি। গলা ছেড়ে গান ও গল্প করার উদ্দেশ্য আমাদের উপস্থিতি জানান দেওয়া। মানে আমরা চলে আসছি। বনদস্যুরা হয়তো এখানকার কোনো খালের ভিতরে আছে। অপেক্ষা করছি। ভাবছি, পূর্ব সুন্দরবন আর পশ্চিম সুন্দরবনের মধ্যে অনেক পার্থক্য। এদিকের জঙ্গলের চেহারাও ওদিকের থেকে আলাদা। দুশ্চিস্তা কেটে গেছে আমার। বুঝতে পারছি, এখন শুধু একটা আলোর ইশারার অপেক্ষা। আপাতত ভেসে ভেসে আগানো ছাড়া করার কিছু নাই।
ডান পাশের জঙ্গলের দিকে একটানা তাকিয়ে আছি। কখন আসবে আলোর ইশারা! এদিকে বড় টর্চ লাইট জ্বালানোর রীতি নাই। সিগন্যাল দেওয়া হয় গ্যাস লাইটারের পিছনে থাকা ছোট এলইডি বাতি দিয়ে। বড় করে আলো জ্বালানোর কোনো কারবার এদিকে নাই। কিছুক্ষণের মধ্যে জঙ্গলের ভিতর থেকে আলো জ্বললো। টিপ টিপ করে দুই/তিনবার জ্বলার সাথে সাথে আলমগীর ভাই বললেন, এই নৌকা থামাও। জঙ্গলের ভিতর থেকে কেউ বলছে, কারা? এদিক থেকে বললাম, আমরা। আমি মোহসীন। বললো, ভালো আছেন মামা? বললাম, তুমি কে? বললো, আমি এনামুল। এর মধ্যে আলমগীর জিজ্ঞেস করলেন, কোন খালে ঢুকবো? বলতে বলতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসলো দুইজন। হাত দোনলা বন্দুক। একটু আগে রেখে আসা ছোট খালে ঢুকতে বললো আমাদের।
নৌকা ঘুরে গেলো। জঙ্গলের পাশ ধরে এবার উল্টো দিকে যাচ্ছি। পাশে কাঁদা ভেঙ্গে হাঁটছে দু’জন সশস্ত্র বনদস্যু। জঙ্গলের ভিতরে আরও একজন ছিলো। সে ভিতর দিয়ে হাঁটা দিলো। সম্ভবত মজনুর কাছে গিয়ে আমাদের আসার খবর দিতে গেছে।
হাতিভাঙ্গা খাল কোনটা? এনামুল বললো, এই তো সামনে মামা। দেখি ছোট্ট একটা খাল ঢুকে গেছে বামে। জোলা খাল। মানে কোনো রকমে একটা নৌকা ঢুকবে সেখানে। ভাটায় সেখানে ঢুকতেও কসরৎ করতে হয়। তখন আধা জোয়ার। নির্বিঘ্নে ঢুকে পড়লো আমাদের নৌকা। ওই খালের মুখে একজন সশস্ত্র দস্যু পাহাড়ায় দাঁড়ানো। ডাকাত দলটি চুড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে।
মুখের দিকে সরু। কিন্তু ভিতরে ঢুকতেই বেশ চওড়া। বাম পাশ দিয়ে হাঁটছে দুইজন বনদস্যু। আর কতোদূর যেতে হবে এনামুল? দোনলা বন্দুক হাতে এনামুল দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো, আরও মিনিট পাঁচেকের পথ। স্থুলকায় হলেও বেশ সুঠামদেহী সেই বনদস্যুকে কোথাও দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে। এনামুল বললো, আমাকে চিনতে পারেননি মামা? বললাম, চিনবো না কেন মামা? বললাম ঠিকই। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না তাকে কোথায় দেখেছি! বললাম, তোমরা জঙ্গল দিয়ে হাঁটো। কাঁদায় কষ্ট হচ্ছে না? বললো, অসুবিধা নাই মামা। এখানে জঙ্গল ভর্তি হরগজা আর হেঁতাল কাঁটা। হাঁটতে গেলে পা শেষ।
সশস্ত্র দুই দস্যু হাঁচড়ে পাঁচড়ে হাঁটছে পাশ দিয়ে। ভাবছি কী জীবন এদের। টাকা কামায় ঠিকই। কিন্তু এই কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পায় না। জেলেদের ওপর নির্যাতন করা টাকা পয়সা খেয়ে ফেলে লোকালয়ের কিছু মানুষ! ওই সুবিধাভোগীরা লাখ লাখ টাকা রোজগার করে। দস্যুদের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি করে। বন্দুক যুদ্ধ হলে মরতে হয় জলদস্যুদের। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় তাদের নাম খুঁজি আমি, পাই না!