নৌকায় চলছে রান্না-বান্না, ছাগল নিয়ে বনে ঢুকলো ওরা | রূপান্তরের গল্প ১৪৮ | Rupantorer Golpo 148 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৪৮ : ও ভাই, সকালের নাস্তায় খাবেন কী ভাই? বললাম ভাত রান্না করো। একটু শুকনা মরিচ পোড়াবে। পেঁয়াজ আর সরিষার তেল দিয়ে মরিচ ভর্তা করবে। দস্যুদলের বাবুর্চি আর আমি সামনাসামনি বসা। নৌকার বড় চুলাটি জ্বালানোর চেষ্টা করছে সে। লাকড়িগুলো ভিজে আছে। চুলা জ্বলতে তাই সময় লাগছে। তরকারি যাই হোক। তাড়াতাড়ি ভাতটা তুলে দিতে হবে। মোট ২২জন মানুষ আমরা।
নৌকার আরেক পাশে দা নিয়ে বসেছে দুইজন। আলু আর সবজি কাটাকুটি করছে তারা। পাশে আরেকজন মসলা নিয়ে বসেছে। রান্নার আয়োজনটা সকাল সকাল সারতে হবে। বৃষ্টি আসতে পারে। অন্য কোনো ঝামেলাও এসে হাজির হতে পারে সামনে। তার আগেই খাওয়া দাওয়া সেরে নিতে চাই। বেলায়েত সরদার থাকলে সুবিধা হতো। অন্তত খাবার দাবার নিয়ে চিন্তা করতে হতো না। মজনু বাহিনীর সাথে হুট করেই দেখা হলো। আগে জানা থাকলে বেলায়েত সরদারকে সঙ্গে নিয়ে আসতাম। তার বাড়ি বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার চিলা গ্রামে, সাতক্ষীরা থেকে অনেক দূরের পথ।
সকালটা বেশ সুন্দর। সূর্যোদয়ের সময়টা অসাধারণ। নৌকায় বসে মজনু একটু বিশ্রাম নিচ্ছোন। পাশে বসা এনামুল। দস্যুনেতার দূর সম্পর্কের ভাগ্নে এনামুল সম্ভবত মজনুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত। মূল নৌকায় আমার জন্যও বিছানা তৈরি বরে রাখা। কিন্তু আমার ঘুম আসবে না। ঘুমাতেও চাই না। কারণ এই পরিবেশে কোনো বিপদ সামনে এসে পড়লে সামাল দিতে পারবো না। গত রাত থেকেই মনটা খচখচ করছে। শুধু মনে হচ্ছে, বিপদ আসতে পারে যেকোনো সময়।
দুইজন সশস্ত্র যুবককে ধমক দিচ্ছে রহমত। কী বিষয়? রহমত বললো, খালের গোঁড়ায় পাহাড়ায় যেতে হবে তাদের। বললাম, সারা রাত নৌকা বেয়ে এখন আবার ডিউটি? শরীরে কুলাবে? ওরা তো দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে ঘুমাবে। কতোক্ষণ ডিউটি করবে তারা? বললো, চার ঘন্টা করে ডিউটি করতে হবে। তারপর ওরা চলে আসবে। নতুন দুইজন যাবে। এভাবে চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি চলে আমাদের। এমনিতে মজনু সাহেবের বাহিনী এদিকে আছে জানলে ছোট খাটো ডাকাত পার্টি আসবে না। তবে জোনাবের বিশ্বাস নাই। ও একটা পাগল। নৌকায় হেলান দিয়ে বসে থাকা দুইজন উঠে দাঁড়ালো। বন্দুক-গুলি চেক করে তারা হাঁটা দিলো জঙ্গল ধরে। এদিকের বনদস্যু জোনাবের কথা শুনি অনেক। আমার সাথেও একবার ফোনে কথা হয়েছে। কিন্তু দেখা হয়নি। শুনেছি এই দস্যুনেতার বয়স ষাটেরও বেশি।
রান্নার মূল দায়িত্ব যার ঘাড়ে সে চেষ্টা করছে। কিন্তু তার কাজ কারবার দেখে অভিজ্ঞ রাধুনী মনে হচ্ছে না। গল্পে বসলাম সেখানে। জানলাম, সে আসলে সহকারী বাবুর্চি। মজনু বাহিনীর রান্নার মূল দায়িত্বে থাকেন দস্যুনেতা নিজেই। উনি বিশ্রাম নিচ্ছেন বলে কাজগুলো এগিয়ে রাখা হচ্ছে।
একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে বেশ কিছুদিন ধরে। মজনুর সাথে প্রথম যখন ফোনে কথা হয় তখন থেকেই সেই হিসাবটা মিলাতে পারছি না। এর মধ্যে বুঝে গেছি, পশ্চিম সুন্দরবনের দস্যুরা মূলত ডিঙ্গি নৌকা নিয়েই চলাফেরা করে। দস্যুনেতা মজনুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পরও বেশ একটা ধাক্কা খেলাম তাদের নৌকায় চলাফেরা করতে দেখে। এছাড়া স্পষ্ট এবং শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা লোকটিকে সুন্দরবনের ডাকাত মনে হচ্ছিলো না কিছুতেই। আমার চোখে ডাকাত মনে না হলেও আইন শৃংখলা বাহিনীর তালিকা আর বনদস্যুদের জগতে মজনু তখন মোস্ট ওয়ান্টেড।
কুকু পাখির ডাক শুনছি। চারপাশ থেকে ডাকাডাকি চলছে। রাতের বেলা এই পাখির শব্দ ভৌতিক মনে হয়। নতুন কেউ সেই শব্দ শুনলে ভড়কে যাবে। তবে আমাদের কাছে এই শব্দ পরিচিত। কুকু পাখির ডাক শুনে বুঝলাম অর্ধের ভাটা হয়ে গেছে। যে খালে আছি, সেই খালের পানিও নেমে গেছে তলানীতে। ভাটার সময় একটা বিষয় নিশ্চিত যে নৌকা, ট্রলার বা স্পিডবোট নিয়ে কেউ এ পর্যন্ত আসতে পারবে না। সুন্দরবনে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে হলে এরকম জায়গা বেশ উপযুক্ত। শুধু একটা জিনিষ মাথায় রাখতে হয়। উচ্চ স্বরে কথাবার্তা বলা যাবে না।
আমাদের চারটি নৌকার মধ্যে শুধু তিন নম্বর নৌকায় লোকজন জেগে আছে। অন্যরা বিশ্রামে। এই নৌকায় রান্নার প্রস্তুতি চলছে। এরই মধ্যে বড় চুলাটি জ্বলেছে। ভাত রান্না শুরু হয়ে গেছে। পাশের ছোট চুলাটিও জ্বালানো হলো। চা হবে। ডিউটিতে থাকা দুই দস্যুদের চা আর বিস্কিট পাঠানো হবে।
পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন কাটা-বাটার কাজ কাজ শুরু হয়েছে। আমিও হাত লাগালাম সেই কাজে। ওদের সাথে মিশে যাওয়ার এই কৌশলটি বেশ কার্যকর। আমি বোঝার চেষ্টা করছি সত্যি সত্যি মজনু সারেন্ডার করবে? না কী সময় কাটানোর জন্য আমাকে ডেকেছে? সদস্যদের মনোভাব কী? কারা তারা? কী কারণে দস্যুতায় এসেছে? সবাই সারেন্ডার করতে চায় কী না এসব বুঝতে হবে আমাকে। কারণ দলের মধ্যে ঝামেলা করার মতো একজন থাকলেও তার বিষয়ে মজনুকে সতর্ক করতে হবে। এবিষয়ে মাস্টার বাহিনীর অভিজ্ঞতার কথাগুলো মাথায় রাখতে হবে। গল্পে গল্পে একটা বিষয় বুঝলাম যে দস্যুদলটির সদস্যরা সবাই তাদের লিডারের প্রতি সন্তুষ্ট না। বিশ্বাসের ঘাটতি আছে।
দস্যু দুনিয়ায় বিশ্বাস বলে কিছু নাই। কেউ কাউকে শত ভাগ বিশ্বাস করে না। আবার বিশ্বাস না করেও উপায় নাই। এক্ষেত্রে দস্যু সরদার একদম নিজের কিছু লোকজন রাখেন চারপাশে। এনামুল, রহমত তেমন দুই জন সদস্য। যারা পালা করে মজনুর পাশে থাকে চব্বিশ ঘন্টা।
চা আর বিস্কিট নিয়ে খালের গোঁড়ার দিকে রওনা দিলো একজন। আমকেও এক কাপ দিলো। ভালো না লাগলেও সেই কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছি। কড়া লিকারের র’ চা! জেগে থাকতে, শরীরটাকে চাঙ্গা রাখতে এর বিকল্প নাই।
মজনুর নৌকার খোলের ভিতরে একটি বাক্স আছে। ককশিটের বাক্স। ভিতরে বড়ফ রাখা। সুন্দরবনের ফ্রিজ বলতে এই ব্যবস্থা। বড়ফের সেই বাক্স থেকে চিংড়ি মাছ বের করা হলো। একজন বসলো মাছ কাটতে। ওদের প্রত্যকের হাতে বন্দুক। কয়েকটি দো-নলা বন্দুক। বাঁকী সব একনলা বন্দুক। গুলির পোসেসগুলো বেশি বড় না। খুব বেশি হলে এক এক জনের কাছে পঞ্চাশটি করে গুলি আছে। এই দস্যুদলের অস্ত্রের হিসাব বুঝতে চাচ্ছি। কিন্তু কিছুতেই পরিস্কার হচ্ছে না বিষয়টি।
দস্যুনেতা ঘুমাচ্ছেন। রাতে একটা বিষয় খেয়াল করিনি। মজনুর পুরো শরীর এক ধরণের চর্মরোগে ভরা। লবণ পানিতে থাকলে নাকী এই অসুখটা বেড়ে যায়। তখন প্রচুর পরিমানে ওষুধ খেতে হয় তাঁকে। তার মধ্যে ঘুমের ওষুধও আছে। তাই দিনে লম্বা একটা ঘুম দিতেই হয়। দস্যুনেতা ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু সেই নৌকায় পাশে বসা এনামুল। সতর্ক দৃষ্টি ঘুরছে চারপাশে। এদিকে রহমতও জেগে আছে। এই দুজন সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশের খেয়াল রাখছে, চোখে চোখে কথা বলছে তারা।
এনামুলকে বললাম, লিডার ঘুমাক। আজকে অনেক কাজ আছে তার সাথে। সকালের রান্নাটা ওরাই করুক। চিংড়ি দিয়ে সবজি আর সাদা ভাত রান্না করতে সমস্যা হবে না। মজনু ভাই রান্না করলে দুপুরের রান্নাটা করুক। রহমত বললো, ছাগলটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে না ভাই। বললাম, সেটা তো দুপুরের খাবার। সবাই একটু বিশ্রাম নিয়ে নিক। আলমগীর ভাইও তো ঘুমাচ্ছেন। উঠুক, তারপর দেখা যাবে।
নাম শুনেই উত্তর দিলেন আলমগীর। বললেন, চোখ বন্ধ থাকলেও কান খোলা আছে ভাই। উঠে বসলেন। আমি বললাম, এই যে ভাই উঠেছেন। এক কাপ চা দাও। উঠে পড়লেন আলমগীর। বললেন, এই ছাগলটা জবাই দিছিস তোরা? সবাই ঘুমাচ্ছিস? কাজগুলো আগায়ে নিবি না? বলতে বলতে পুরো এলাকা গরম করে ফেললেন। বললাম, চা খান। এতো তাড়া কীসের? বললেন, এই ডাকাতেররা কোনো ডাকাতের জাত না। খালি ঘুমায়। এজন্যই তো অন্য পার্টি এদের অ্যাটাক করে বসে। সেদিন কোস্টগার্ডও তাড়া দিলো এদের। তাড়া খেলে ঠিকমতো পালাতেও পারে না এই দস্যুরা।
নতুন তথ্য পেলাম। নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর কারণটাও এবার জানতে পারলাম। কিছু দিন আগে কোস্টগার্ডের ধাওয়া খেয়েছে তারা। ট্রলার ছেড়ে জঙ্গলে নেমে দৌড়ে পালায় সবাই। কেস্টগার্ড তাদের ট্রলার নিয়ে যায়। তারপর দুই দিন না খেয়ে ছিলো। আমি এসে বাজার না দিলে ওরা না খেয়ে মরতো। বললাম, এই নৌকাগুলো কোথায় পেলো তারা? বললেন, জেলেদের নৌকা কেড়ে নিছে! মানে কী? নৌকাগুলো তোমাদের না? জিজ্ঞেস করলাম রহমতকে। বললো, জেলেদের কাছ থেকে নিছি। তাদের তো নৌকার দাম দিয়ে দিছি। আলমগরীর ভাই বললেন, নৌকার দাম তো দিছিস একটার। বাঁকী দুইটা তো ডাকাতি করে নেওয়া! বললাম, কী সাংঘাতিক! কেড়ে নেওয়া নৌকায় বসে আছি? কী বলবো বুঝতে পারছি না। শুধু বললাম, কাজটা ঠিক হয়নি তোমাদের। নৌকাগুলোর দাম দিয়ে দাও। সারেন্ডারের আগেই টাকা দিয়ে জানাবে আমাকে।
দস্যুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করছি। কিছু বিষয় নিয়ে মনটা খারাপ থাকে। এই যে ওদের সাথে আছি, খাবার খাচ্ছি এসব তো সাধারণ জেলেদের কাছ থেকে জুলুম করে নেওয়া। আমার কি এই খাবার খাওয়া উচিৎ হচ্ছে? আবার ভাবছি বিকল্প কী করতে পারি? নিজেরা বাজার সদা করে আনলেও এই দায় থেকে মুক্ত হতে পারবো? পারবো না। তাহলে এই অনৈতিক খাবার থেকে বিরত থাকার উপায় কী? আসলে বিকল্প নাই।
এই সফরগুলোর মধ্যে দিয়ে যদি সুন্দরবনের দস্যুদলগুলো সারেন্ডার করে উঠে যায়, যদি সুন্দরবন কখনও দস্যুমুক্ত হয় তবে কিছু দায় হয়তো কাটবে। কিন্তু সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করা কি সম্ভব? কয়েকটি দল সারেন্ডার করতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করবে কী না জানি না এখনও। বনের দস্যুরা করতে চাইলেও ডাঙ্গার দস্যুরা তাদের সারেন্ডার করতে দিবে না। কিছুতেই না। সেই যুদ্ধটা বেশ বড় হবে, লম্বা হবে। সে পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেতে হবে আমাদের।
আকাশে মেঘ জমেছে। বড় বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। তার আগেই কিছু কাজ গুছিয়ে নিতে হবে। আমার কাজ হলো মজনু বাহিনীকে নিয়ে শ্যুটিং করা। আর উনাদের কাজ হলো রান্নাবান্না করা, চারপাশের খোঁজ খবর রাখা।
চা শেষ করে উঠে পড়লেন আলমগীর ভাই। দুইজন দস্যুকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। বললেন, ছাগলটা বের কর। এর পর তিনজন মিলে ছাগল নিয়ে রওনা হলেন জঙ্গলের ভিতরে। জবাই করে, কেটেছেঁটে আনবেন একবারে। বড় হাঁড়ি, গামলা আর বালতি নিয়ে রওনা হলো তারা। পাশের নৌকা থেকে একটি দা আর কুড়াল নিয়ে চললো আরও একজন।
এদিকে ভাত হয়ে গেছে। চুলায় উঠলো চিংড়ি সবজি। একই সাথে ছোট চুলায় কড়াই উঠলো। ভাজা হলো শুকনা মরিচ। আমি নিজে পেঁয়াজ কেটে শুকনা মরিচ দিয়ে ভর্তা বানাতে বসলাম। রান্না নামতে বড়জোর ১৫ মিনিট লাগবে। আমার সাথে আসা সহকর্মীদের ডেকে তুললাম। বললাম, মুখ হাত ধুয়ে নাও সবাই। খেয়ে কাজে নামতে হবে। ওরা উঠে পড়লো। বাঁধনকে বললাম, ক্যামেরাসহ বাঁকী যন্ত্রপাতি ব্যাগ থেকে বের করে রাখো। তারপর চালু করবে। এই পরিবেশে হুট করে ক্যামেরা অন করলে ঠিকঠাক কাজ করে না। বিশেষ করে লেন্স-এ ময়েশ্চার জমে থাকে। ছবি তুলতে পারবে না সময় মতো। ব্যাটারিগুলোও চেক করে নাও। সুন্দরবনে নামার আগে তো সেগুলো চার্য-এ বসানো হয়নি। যেটুকু ব্যাটারি আছে সেটা দিয়েই আজকের কাজ সারতে হবে।
বাঁধন জানালো, বাড়তি ব্যাটারি নিয়ে আসছি ভাই। আমার মনে হয়েছিলো যে আপনি সুন্দরবনে ঢুকবেন। আর পলিন ভাইও বলেছেন ক্যামেরা কী ভাবে রাখতে হবে, চালাতে হবে জঙ্গলে এসে। বললাম, কোনো ঝামেলা হলে কী করে দৌড়ে পালাতে হবে সেটা বলেনি? পাশ থেকে রাজীব বললেন, গোলাগুলি হলেও এবার সমস্যা হবে না ভাই। আমরা রেডি আছি।
(ছবি: সকালের ভাটা চলছে। দস্যুদের নৌকাগুলো রাখা ছোট খালে)