জোয়ারে ভেসে গেছে চুলা, রান্না হলো ভাসমান চুলায় | রূপান্তরের গল্প ১৫২

জোয়ারে ভেসে গেছে চুলা, রান্না হলো ভাসমান চুলায় | রূপান্তরের গল্প ১৫২ | Rupantorer Golpo 152 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৫২ : খালের ঠোঁটায় হইচই শুনে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী হলো আবার? সবাই সতর্ক হও। গাছের আড়ালে যাও। আমি দেখছি। বলতে বলতে মাচা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। দস্যুনেতা মজনু আর বাবু হাসতে লাগলো। গুটগুটে বাবু হাসতে হাসতে বললো, ও ভাই আমাদের তিনকাঠি চুলা পানিতে ভেসে গেছে। বললাম, আমি তো দৌড় দেয়ার জন্য রেডি! ততোক্ষণে মাচার ওপর থেকে নেমে হাঁটু পানিতে দাঁড়ানো আমরা। আসলে সুন্দরবনের ডাকাতদের সাথে দেখা করতে এসে কম দৌড়াইনি। ঝাইলোর খালে গোলাগুলির কথাও মাথায় থাকে সব সময়।

পানি ভেঙ্গে হেঁটে গেলাম খালের ঠোঁটার দিকে। যে জায়গাটি দুই ঘন্টা আগেও শুকনা ছিলো, সেখানে এক হাঁটুর বেশি পানি। জোয়ার চলছে এখনও। পানি আরও বাড়বে। তাই হাঁটার সময় বাড়তি সতর্ক আমরা। যাচ্ছি ওই রান্নার জায়গায়।

শর্টস পড়ে হাঁটছি, তাও বেশ কষ্ট হচ্ছে। পাশে হাঁটছেন সাতক্ষীরার সহকর্মী আহসান রাজীব। ফুল প্যান্ট পড়ে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। বললাম ফুলপ্যান্ট কেন? লুঙ্গি কই? রাজীব বললেন, ওই ভুল আর করবো না ভাই। ঝাইলোর খালে গোলাগুলির সময় লুঙ্গি পড়া ছিলাম। সেবার এই জঙ্গলের মধ্যে দৌড়াতে খুব কষ্ট হইছে। তাই সুন্দরবনে আর লুঙ্গি পড়বো না ঠিক করছি। আমরা হাসতে হাসতে শেষ। আরও দুই ধাপ আগাতেই পায়ের তালুতে খচ করে উঠলো। কাঁটা ঢুকেছে। দেখি একগাদা হেঁতালের কাঁটা বিঁধে আছে তালুতে। না হলেই ৫/৭টি কাঁটা একসাথে ঢুকেছে। বের করতে গিয়ে দেখি গলগল করে রক্ত পড়ছে। লবণ পানির ভিতরে সেই ক্ষত জ্বলছে, বেশিই জ্বলছে। কিন্তু এই অবস্থায় পায়ের দিকে তাকিয়ে লাভ নাই। হাঁটতে হবে।

জোয়ার আসার পর সারা গায়ে সুন্দরবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক পোকার কামড়ে হাত পা ফুলে গেছে। বাইরে পোক বা বেড়ে পোকা আমাকে বেশি পছন্দ করে। খালি চোখে দেখা যায় না। শরীরের কোনো অংশ ভেজা থাকলে সেখানে বসে রক্ত চুষে নেয়। তারপর ফুলে যায়, প্রচন্ড চুলকায়। এর রেশ থেকে যায় পরের দুই সপ্তাহ। জঙ্গলে চলতে গেলে, থাকতে গেলে এই পোকার কামড়, কাঁটা মেনে নিয়ে চলতে হয়। আমি অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। বৃষ্টি আসলে বা জোয়ার হলে জঙ্গল আর কাঁদা থেকে বেরিয়ে আসে পোকাগুলো। এই বাদা বনের ছোট ছোট বাধাগুলোও ভয়ঙ্কর। বাঘ-কুমির আর সাপখোপের কথা বলাই বাহুল্য।

অনেকে সুন্দরবনের জন্য উপযুক্ত পোশাকের কথা বলেন। কিন্তু ওই বৈরী পরিবেশে নিজেকে শতভাগ সুরক্ষিত রাখার মতো কোনো পোশাক খুঁজে পাই না। কেউ বলেন গামবুট পড়তে। কিন্তু এক হাঁটু বা কোমড় পর্যন্ত কাঁদায় হাঁটতে গেলে গামবুট মাটির তলে থেকে যায়। সারা শরীর আবৃত করে রাখা পোশাক পড়লে গরমে শেষ হয়ে যাই। তাই জঙ্গলের মানুষদের মতো করে লুঙ্গি বা শর্টস পড়ে সফরগুলো করি।

জোয়ারে তিনকাঠির চুলাটি ডুবে গেছে। রান্না শেষ হয়নি তখনও। আলমগীর ভাই ও তাঁর সাথের দুইজন মহা বিপাকে। বললাম, হাঁড়িটা নৌকায় নিয়ে রাখেন। পরে ভাটার পানি নামলে আবার জ্বাল দিয়েন। আলমগীর ভাই বললেন, ও ভাই ভাটা আসবে, পানি নামবে, ততোক্ষণে দুপুর পার হয়ে যাবে। দেখেন আমি কী করি।

এবার একটা বড় গেওয়া গাছে কোপ পড়লো। কুড়াল আর দা দিয়ে কেটে ফেলা হলো একটা গাছ। চার টুকরা করে একটার সঙ্গে একটা বেঁধে ফেলা হলো ভেলার মতো করে। এবার একটি স্টিলের প্লেট দিয়ে জ্বলন্ত কয়লাগুলো তুলে দিলো সেই ভেলার উপর। তিনটি কাঠি তার উপর বসিয়ে আরও কিছু শুকনা কাঠ জ্বালানো হলো। গেওয়া গাছের ভেলার উপর জ্বললো চুলা। তিন কাঠির উপর চড়লো অসমাপ্ত রান্না। পুরো বিষয়টি ঘটলো চোখের সামনে কয়েক মিনিটের মধ্যে। আলমগীর ভাইয়ের কেরামতী দেখলাম। আসলে সুন্দরবনের ভিতরে বেঁচে থাকা, টিকে থাকাটা অনেক বেশি কঠিন। সেই কঠিনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেঁচে থাকে সুন্দরবনের মানুষেরা। ভাবছিলাম, বেঁচে থাকা, টিকে থাকাটা জরুরি। কিন্তু কথায় কথায় গাছ কাটার ঘটনা হিসাব করতে গেলে মাথা নষ্ট হয়ে যায়।

বললাম, সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক ঘন্টায় আপনারা শ’ খানেক গাছ কেটে ফেলেছেন। সুন্দরবনে আরও দেড় ডজন দস্যু বাহিনী আছে, হাজার হাজার জেলেরা আছেন। প্রতিদিন আপনারাই কয়েক হাজার গাছ কেটে ফেলছেন। সুন্দরবন বাঁচবে কী করে?

এক সময় এই বনে আনুষ্ঠানিক ভাবে গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হতো। খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিলের জন্য কাটা হতো গেওয়া গাছ। দিয়াশলাই এর কাঠিও তৈরি হতো এই গাছ দিয়ে। নির্দিষ্ট মৌসুমে গড়ান গাছ কাটার অনুমতি নিয়ে জঙ্গলে নামতো বাওয়ালীরা। সুন্দরবনকে বাঁচাতে এখন সব ধরনের গাছ কাটা নিষেধ। গাছে হাত দেওয়া আইনত দন্ডনীয়। সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের চাহিদা ছিলো সবচেয়ে বেশি। বেআইনী হলেও বন উপকূলের ঘরগুলো তৈরি হয় সুন্দরী কাঠ দিয়ে। নৌকা-ট্রলারও সুন্দরী গাছ ছাড়া চিন্তা করা যায় না। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় ছাউনি দিয়ে যে গাছগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোও সুন্দরী। লগি হিসাবেও সেরা গাছ সুন্দরী।

রান্না করতে করতে আলমগীর ভাই বললেন, কাঁকড়ার জেলেরা সবচেয়ে বেশি গাছ কাটে। তাদের কথা তো বললেন না। কী ভাবে? চারো দিয়ে যারা কাঁকড়া ধরে তাদের প্রতিটি চারোর সেট করতে অন্তত একটা করে ছোট কাছ কাটতে হয়। বনে ঢুকেই আঙ্গুলের মতো সাইজের গড়ান বা সুন্দরী গাছ কেটে লগি বা খুঁটি বানায় তারা। প্রতিটি চারো বা বাঁশে তৈরি খাঁচাগুলো ওই খুঁটির সাথে বেঁধে খালের মধ্যে পুঁতে ফেলে।

একটা কাঁকড়ার নৌকায় চারো থাকে একশ’ থেকে তিনশ’। তার মানে প্রতি গোনে এতোগুলো ছোট গাছ কাটা পড়ে চারো বসাতে গিয়ে। তারপর গোন শেষে গাছগুলো জঙ্গলে ফেলে চলে যায় জেলেরা। কারণ সুন্দরবনের গাছ নিয়ে বাড়ি গেলে বন মামলা খেতে হবে। একই ভাবে চরপাটার জাল পাততেও সুন্দরবনের শত শত গাছ কাটা পড়ছে? জেলেরা বললো, জঙ্গলে গাছের অভাব নাই। কাটলে সমস্যা হয় না। বললাম, তাহলে জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলেন। জঙ্গলেরই দরকার নাই। এই বন না থাকলে তখন কী খাবেন?

গল্প করতে করতে রান্না শেষ হলো। তারপর উঠলো ভাতের হাঁড়ি। ভাসমান ওই তিন কাঠির চুলা বেশ কার্যকর। বন্যা জোয়ারের সময় জেলেরা এভাবে রান্না করে। তবে বেশির ভাগ রান্না হয় নৌকার উপর ছোট ছোট টিনের চুলায়।

দস্যুনেতা মজনু চলে গেলেন নৌকায়। আমার পাশে বন্দুক হাতে গুটগুটে বাবু। বললাম, এই নামটা হলো কী করে? বাবু বললো, ছোটখাটো সাইজ আমার। আগে ছিলাম কাঁকড়ার জেলে। হাতে একটা দা থাকলে পুরো জঙ্গল হেঁটে বেড়াতে পারি। পা দুইটা খালি ভালো থাকলেই হয়।

বাবু বলছেন, ডাকাতি করতে আসলাম যখন, তখনও হেঁটে হেঁটে জঙ্গলের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ছুড়ে বেড়াতাম। সেই থেকে লিডারে নাম দিলো গুটগুটে বাবু। ততোক্ষণে বেশ ভাব জমেছে দস্যুদের সাথে। এনামুল, রহমত, বাবুসহ প্রত্যেকেই তরুণ। বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। এই বয়সের তরুণদের সাথে ভাব জমাতে সময় লাগে না আমার।

গল্পে গল্পে আবার মজনুর রান্না করার প্রসঙ্গ তুললাম। ওরা জানালো, সুন্দরবনে ডাকাতির দুনিয়াটা ভাই গাদ্দারীর দুনিয়া। কেউ কাউকে বিশ্বাস করি না। আবার বিশ্বাস না করেও থাকতে পারি না। একসাথে থাকতে গেলে বিশ্বাস করতেই হয়। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। ধরেন, সবার হাতেই গুলি লোড করা বন্দুক। ট্রিগারে একটা টান দিলেই একজন নাই হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা করতে গেলে নিজেকেও মরতে হবে। কারণ অন্যদের হাতেও বন্দুক। বললাম, জোনাব ডাকাতকে একবার ঘুমের ওষুধ খাওয়ালো কে যেন? আপনাদেরই তো সদস্য সে। কী নাম যেন?

রবিউল। সে এখন ছুটিতে আছে। ওর কাজই হলো গাদ্দারী করা। গত বছর জোনাব বেশ কয়েকটা অস্ত্র নিয়ে নামলো। সব একনলা আর দোনলা বন্দুক। রবিউল হলো মজনু সাহেবের লোক। কিন্তু নাটক করে উঠিয়ে দিলো সাহেব। তারপর সে যোগ দিলো জোনাবের দলে। যাওয়ার সময় ইন্ডিয়া থেকে আনা ঘুমের ওষুধ সাথে করে নিছিলো রবিউল। একদিন সুযোগ মতো খাবারে মিশিয়ে দিলো। তারপর সবাই যখন অচেতন তখন অস্ত্র আর গুলিগুলো নিয়ে পলান দিলো সে। মজনু সাহেব কিছু টাকা দিলো তাকে। এখন আমাদের হাতে জোনাবের সেই অস্ত্রগুলো। অবশ্য ওর উপর দয়া করেছে, মেরে দেয়নি। এর পর জোনাব আবার অস্ত্র কিনে নেমেছে। এনামুল বললো, এই বাদায় মজনু সাহেবের শত্রু একজনই। সামনে পড়লে ও আমাদের গুলি করবেই।

আমাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে। জোয়ারে খাল ভর্তি পানি থাকে। শুধু অন্য দস্যুদল না, কোস্টগার্ডও আসতে পারে। রান্না শেষে সবকিছু পরিস্কার করে নৌকায় তোলা হলো। গরম ভাত আর ছাগলের মাংসের ঝোল। যদিও বেশি তাপে ঝোল শুকিয়ে গেছে। অদ্ভুত এক স্বাদ। ক্ষুধা পেটে পোড়া পোড়া সেই তরকারি দিয়ে খেলাম দুপুরের খাবার।

চারপাশো টলমল করছে পানি। খাল, নদী আর ডাঙ্গা একাকার জোয়ারের পানিতে। আমরা ভেসে আছি। শরীরটা ছেড়ে দিচ্ছে। জঙ্গলের ভিতরে একটু বিশ্রাম নিতে চাই। কিন্তু বসতে পারছি কই? বাইড়ে পোকার কামড়ে অতিষ্ট। কেউ বলছে কেরোসিন মাখেন, কেউ বলছে সরিষার তেল দিলে পোকা গায়ে বসে না। একজন বললো, শ্যাম্পু মাখলে বাঁচতে পারবেন। ব্যাগ থেকে মিনিপ্যাক শ্যাম্পু বের করে দিলো রহমত। এসময় পাশে রাখা কাঁকড়ার নৌকায় দেখি মশার কয়েলের মতো ধোঁয়া উড়ছে। বললাম, ওটা কী?

গেওয়া গাছের গুঁড়ি। মরা গাছের গুঁড়ি অনেক দিন পানি ভিজে আর রোদে শুকিয়ে ঝামা ইঁটের মতো দেখতে হয়। তাতে আগুন ধরিয়ে দিলে একপাশ থেকে পুড়তে থাকে। মশার কয়েলের মতো ধিকধিক করে জ্বলে। সেই ধোঁয়ায় বেড়ে পোকা, মশার মতো পোকা মাকড় কাছে আসে না। কতো কিছু দেখলাম, শিখলাম এই জঙ্গলে এসে! আরও কতো কিছু দেখবো!

নৌকা বদলে চলে গেলাম সেই কাঁকড়ার নৌকায়। বেশ দুর্গন্ধ সেখানে। কাঁকড়ার আধারের মরা-পঁচা কুঁচিয়ার গন্ধ। সেই দুর্গন্ধকে সাথে নিয়ে হেলান শরীরটা এলিয়ে দিলাম। গুটগুটে বাবু বললো, একটা ঘুম দেন ভাই। আমি পাহাড়ায় আছি।

(ছবি: মজনু বাহিনীর সাময়িক মাচা। কালির খাল। পশ্চিম সুন্দরবন। জুলাই ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top