সন্দেহজনক শব্দ! দিলাম দৌড়! | রূপান্তরের গল্প ১৫৪| Rupantorer Golpo 154 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৫৪ : আকাশে মেঘ করেছে। শেষ ভাটায় মনে হয় বৃষ্টি নামবে আবার। দ্রুত শ্যুটিং এর কাজ শেষ করলাম। ক্যামেরা গুছিয়ে ব্যাগগুলো নৌকার ভিতরে রাখতে বললাম। বাঁধনকে বললাম, ক্যামেরার আর কোনো কাজ নাই। নৌকা থেকে নেমে সদ্য বানানো মাচায় গিয়ে বসলাম। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। রহমতকে বললাম, আবার একটু চা খাবো। বৃষ্টিতে সবকিছু ভিজে গেছে। নৌকার ভিতরেও পানি। তাই নৌকা থেকে ছোট চুলাটি নিয়ে আসলো বাবুর্চি। মাটির উপর একটু জায়গা পরিস্কার করা হলো। চা জ্বললো সেখানেই।
এমনিতেই র’ চায়ের নেশা নাই। তার ওপর লিকার এতো কড়া করে ফেলো তোমরা! ওই চা খেলে মাথা ঘুরায়। বাবুর্চিকে বললাম, একদম হাল্কা লিকার করে আমাকে এক কাপ চা দাও। তারপর তোমাদের কড়া লিকার বানিও। রহমত বললো, আমরা দিনের পর দিন ঘুমাতে পারি না ভাই। তাই কড়া লিকার না হলে চলবে না। জঙ্গলের জেলেরাও একই ভাবে চা খায়। পাশ থেকে গুটগুটে বাবু বললো, আলিফ ডাকাত তো আরও কড়া চা খায়। ও তো দিনে এক ঘন্টাও ঘুমায় না। ওর আস্তানায় দিন রাত চায়ের চুলা জ্বলে। সারাদিন কুচকুচে কালো রঙ এর চা খায়। বললাম আলিফ এখন কোথায়। তোমাদের সাথে যোগাযোগ আছে? সে বললো, মজনু সাহেবকে বাপ ডাকে সে। তার সাথে ফোনে কথা বলে মাঝে মাঝে।
আলিফ পশ্চিম সুন্দরবনের পুরনো ডাকাত। দয়াল নামে পরিচিত। জঙ্গলের এই ডাকাত সরদারকে যমের মতো ভয় পায় জেলেরা। মাঝে নোয়া মিয়ার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো। মাস্টার অর্থাৎ মোস্তফা শেখ বিদ্রোহ করে সেই দলের অস্ত্রগুলো কেড়ে নেয়। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। তারপর আলিফসহ অন্যদের আটকে রাখে। কয়েক দিন পর ছেড়ে দেয়, লোকালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় তাকে।
জীবন ফিরে পেলেও দস্যুতা ছাড়েনি আলিফ। নতুন করে অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করে আবার নেমে পড়ে। সাতক্ষীরা সুন্দরবন থেকে যখন মজনু বাহিনী সারেন্ডারের পথ খুঁজছে। তখন ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে আলিফ বাহিনী। অবৈধ অস্ত্রের কারবারীদের সাথে তার লেনদেন চলছে। শুনলাম, বঙ্গোপসাগরে দস্যুতা করার জন্য অস্ত্র আর দস্যু সংখ্য বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে সে। আলিফের সাথে এক/দুই বার কথা হয়েছে আগে। তবে সারেন্ডারের বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি একবারও। সবশেষ পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মন্তাজের এক অস্ত্র ব্যবসায়ীর সাথে যোগাযোগ চলছিলো তার। অস্ত্র কেনা-বেচা ও সাগরে দস্যুতার বিষয়ে জলদস্যুদের নানা ভাবে সহযোগিতা করতো পটুয়াখালীর সেই মাঝি। একই সঙ্গে কাজ করতো আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স হিসাবে।
চা হলো। এদিকে টিপটিপ বৃষ্টিও শুরু হলো। সুন্দরবনে এই মৌসুমে শেষ ভাটা বা শেষ জোয়ারে নিয়ম করে বৃষ্টি হয়। মাচা থেকে নামবো নামবো করছি। এসময় বাবু বললো, বড় বৃষ্টি হবে না ভাই। আকাশের অবস্থা অতো খারাপ না। চা শেষ করতে করতে বৃষ্টি থেমে গেলো। মাচায় বসে মাস্টার বাহিনীর সারেন্ডারের গল্প হচ্ছে। কয়জন সারেন্ডার করলো। কয়টা অস্ত্র জমা দিলো। এখন তাদের কী অবস্থা! বললাম, দেড় মাস পর জামিন পেয়েছে ওরা। যে যার বাড়িতে আছে। সরকার তাদের খোঁজ খবর রাখছে। মামলাগুলো নিয়ে টেনশন আছে।
কিন্তু তাদের কেউ তাড়া দিচ্ছে না, ডিসটার্বও করছে না। সারেন্ডার করলে তোমাদের মামলাগুলোর কী হবে এখনও জানি না। এখনও সময় আছে। ভেবে দেখো সারেন্ডার করবে কী না! এটা কিন্তু শূতবিহীন আত্মসমর্পণ। সাধারণ ক্ষমা না। দস্যুরা বললো, একটু নিশ্চিন্তে ঘুম দিতে পারবো তো ভাই? বললাম, জেলখানা হোক বা বাড়ি, তোমাদের কেউ তাড়া দিবে না এটুকু নিশ্চিত। মামলাগুলো তোমাদের আদালতে গিয়ে মোকাবেলা করতে হবে।
এই চুপ করো, চুপ করো! হঠাৎ করেই রহমত নেমে পড়লো মাচা থেকে। থেমে গেলাম আমিও। নেমে পড়লাম মাচা থেকে। কান খাড়া করে কিছু একটা বুঝতে চাইছে ওরা। আশেপাশের কোথাও থেকে মানুষের কথাবার্তার শব্দ আসছে। খালের উল্টো পাশের জঙ্গলে কারা জানি হাঁটছে। ঝটপট সবাই নেমে পড়লো মাচা থেকে। চোঁয়াল শক্ত হয়ে উঠলো সশস্ত্র সেই যুবকদের। আধা মিনিটের মধ্যে নৌকা থেকে দৌড়ে আসলেন দস্যুনেতা মজনু। পিছে পিছে আসলেন সহকর্মীরা। মজনু বললেন, জঙ্গল দিয়ে হেঁটে এদিকে আসছে লোকজন। কারা বুঝতে পারছি না, বিষয়টা বেশ সন্দেহজক। এসময় এই দিকে কারও থাকার কথা না। প্রত্যেকে অস্ত্র-গুলি চেক করে নিলো। কে কোন দিকে যাবে সে দায়িত্ব ভাগ করে দিলেন মজনু।
গুটগুটে বাবু একাই রওনা দিলো। সাঁতরে পার হলো খাল। তারপর হারিয়ে গেলো জঙ্গলের মধ্যে। মানুষের হাঁটা চলার শব্দ যেদিক থেকে আসছে সেদিকে হাঁটা দিলো বাবু। সামনে রাখা একটি নৌকা ঠেলে নামানো হলো। খাল ধরে এগিয়ে গেলো মজনু বাহিনীর মুহুরি রহমত। আমরা খালের এপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। তিন/চার মিনিট পর বনের ভিতর থেকে চিৎকারের শব্দ এলো। এমনিতেই আতঙ্কিত আমরা। সেই শব্দে ভয় পেয়ে গেলাম। তাহলে কি প্রতিপক্ষ কেউ? আইন শৃঙ্খলা বাহিনী না তো? মজনু বললেন, কোনো রকমের ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। সবাই দৌড়াও।
যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেই অবস্থায় দৌড় শুরু করলাম। পানি সরে যাওয়ার পর জঙ্গলের মাটি পিচ্ছিল হয়ে গেছে। হাঁটাই মুশকিল। সেখানে দৌড়াবো কী করে? কিন্তু করারও তো কিছু নাই।
এদিকের বনে বড় গাছ খুব কম। ওই জায়গাটিতে লুকানোর তেমন ঝোপ-ঝাড়ও নাই। খালের ওপাশে এসে দাঁড়ালেই দেখতে পাবে আমাদের। তাই প্রথম কাজ গুলির রেঞ্জ এর বাইরে যেতে হবে। তারপর নিজেদের আড়াল করতে হবে। ডানে বামে না তাকিয়ে ঊর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছি সবাই। পথে কয়েক দফা আছাড় খেলাম। হাত ধরে তুলছে এনামুল। আমার ঠিক পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছে সে।
প্রায় এক কিলোমিটার দৌড়ে একটা বাইন গাছ পেলাম। বেশ বড়। দাঁড়িয়ে পড়লাম। আর পারবো না দৌড়াতে। বললাম, এখন কেউ যদি এসে গুলিও করে, করুক। আমি এখানেই থাকবো। ততোক্ষণে কাঁদায় পুরো শরীর মেখে গেছে। শ্বাসমূলের সাথে সংঘর্ষে পা দুটো শেষ। তালুতে কাঁটার ক্ষত ছিলো আগে থেকেই। গত কয়েক মিনিটে নতুন করে কয়টা কাঁটা ঢুকলো বলতে পারবো না। পায়ের তালুর দিকে তাকানোর সময়ও নাই।
হাঁপাচ্ছি আমরা। বসে বসে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া কোনো উপায় নাই।
(ছবি: পশ্চিম সুন্দরবন)