রূপান্তরের গল্প ১৫৫| Rupantorer Golpo 155

কাঁটায় কাঁদায় ছিন্নভিন্ন পা দুটো | রূপান্তরের গল্প ১৫৫

কাঁটায় কাঁদায় ছিন্নভিন্ন পা দুটো | রূপান্তরের গল্প ১৫৫| Rupantorer Golpo 155 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৫৫: কাঁদা-পানিতে লেপটে গেছি। হাঁপাচ্ছি কাঁদায় বসে। দৌড়ানোর সময় আছাড় খেয়ে পড়েছি শুলোবনের উপর। দৌড়ানোর সময় পায়ের দুই আঙ্গুলের ফাঁকে শ্বাসমূল আটকে গেলে কেমন ব্যাথা লাগে জানেন? মনে হয় ছিড়ে দুই ভাগ হয়ে গেছে আঙ্গুলগুলো! হেঁতাল কাঁটা, হরগজা কাঁটা, কেয়া কাঁটা, প্রেমকাঁটায় যখন শরীরটাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। পরনে ছিলো শর্টস। দৌড়ানোর সময় হরগজার ঝোপে বাড়ি খেয়েছে দুই পা। হাঁটুর নিচ থেকে গোঁড়ালি পর্যন্ত না হলেও পনেরোটা ফুটো হয়েছে, রক্ত ঝরছে টপ টপ করে।

পায়ের তালুতে হেঁতালের কাঁটা বিঁধেছে। কয়েকটা কাঁটা চামড়ার নিচে ঢুকে ভেঙ্গে গেছে। এই অবস্থায় হাঁটতে গেলে কাটাগুলো আরও ভিতরে ঢুকে যাবে। তখন কেটে বের করা ছাড়া উপায় থাকবে না। বসে থাকলাম সেখানেই। কী যে অসহায় লাগছে!

পাশে আমার মতো করেই বসে আছে সহকর্মীরা। বাঁধন, রাজীব, নিজাম উদ্দীনের অবস্থাও শোচনীয়। আতঙ্কিত সবাই। এসময় দলনেতা হিসাবে নিজেকে সংযত রাখছি। কারণ আমার মনের ভিতরের অবস্থা তারা বুঝতে পারলে ভেঙ্গে পড়তে পারে। এই সত্যিকারের শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে এতোটুকু ভুল করলে জীবনটা চলে যেতে পারে। পথ ভুলে কেউ অন্যদিকে চলে গেলে বাঘে খেতে পারে। সুন্দরবন ভর্তি কেউটে সাপ আছে। বন্যশুকরও মাঝে মাঝে আক্রমণ করে বসে। এই বিপদগুলো সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা আছে। তাদের তো নাই। তাই কিছুতেই ওদের ভড়কে যেতে দেওয়া যাবে না। তরুণ দস্যুরা যারা আমার পায়ের কাঁটা তুলতে উদগ্রীব, তাদের বললাম, আমার সহকর্মীদের দিকে খেয়াল রাখো। ওদের কাঁটাগুলো বের করো আগে।

আশেপাশে হেঁতাল গাছ নাই। তাহলে কাঁটাগুলো আসলো কী করে? বাঁধনের ধারণা নাই জোয়ার ভাটা সম্পর্কে। বললাম, খেজুরের গাছের মো হয় হেঁতাল গাছ। কাঁটাগুলো শুয়ে পড়ে মাটিতে। তারপর জোয়ারের পানিতে ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়ে। ভাটায় আটকে যায় জায়গায় জায়গায়। আমরা যে কাঁদার উপর দিয়ে দৌড়ালাম, এর নিচে এরকম কাঁটার ছড়াছড়ি। কখন পায়ে ঢুকে পড়বে টেরও পাবো না। হরগজা গাছগুলো ঝোপের মতো। দেখলে বুঝতে পারবে না যে প্রতিটি সবুজ পাতার আগায় শক্ত কাঁটা আছে।

প্রেমকাঁটার গাছগুলোকে দেখতে লাগে আরও নিরীহ। কাঁচা সবুজ পাতার নিচে থাকে শক্ত কাঁটা। কাছে না গেলে দেখা যায় না। সুন্দরবন নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে এসব দিয়ে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে। আমরা তো সুন্দরবনের বন্ধু না, শত্রু। আমাদের ঠেকাতেই প্রকৃতি এখানে এভাবে সাজানো। নৌকা বা লঞ্চ-এ চড়ে বেড়ানোর সময় এই সুন্দরবনকে যতোটা সুন্দর লাগে, ভিতরে এই জঙ্গল ততোটাই প্রতিকূল।

ফিসফিস করে গল্প করছি আমরা। তবে কান খাড়া রেখেছি। খালের ওদিক থেকে কোনো সিগন্যাল আসে কী না বুঝার চেষ্টা করছি। অবশ্য শব্দের ইশারা আদান প্রদানের জন্য এনামুল আছে। এই মুহুর্তে আমরা চা ভাগে ছড়িয়ে পড়েছি। গুটগুটে বাবু গেছে খালের ওপাশে পায়ে হেঁটে। খাল ধরে নৌকা নিয়ে গেছে রহমত। পাশে কোনো জায়গায় অবস্থান নিয়েছে মজনুসহ আরও কয়েকজন সশস্ত্র বনদস্যু। আর বেশ খানিকটা দূরে আমরা। বনদস্যু এনামুল আমাদের পথ প্রদর্শক। তাকে বললাম, তুমি তোমার ডিউটি করো। ওদিকে নজর রাখো। পায়ের তালু থেকে একটা একটা করে কাঁটা বের করলাম। কয়েকটি কাঁটা থেকে গেলো ভিতরে।

কুঁই দিচ্ছে কেউ। মানে আমাদের খুঁজছে। এনামুল বললো, কেউ পাল্টা শব্দ করবে না। আমি একটু দেখে আসি কী অবস্থা! বলেই হাঁটা দিলো সে। সঙ্গে থাকা একজন বললো, অনেক সময় লোকজন ধরে রেখে কুঁই দেয় প্রতিপক্ষ, অন্যদের ধরার জন্য। বাইন গাছের গোঁড়ায় বসে ওই সময়গুলোকে মনে হচ্ছিলো অনন্ত কাল! মন বলছিলো বিপদ কাটবে। কারণ ঝামেলার কিছু থাকলে এতোক্ষণে গোলাগুলি হয়ে যেতো।

এবার এনামুল কুঁই দিলো। এদিক থেকে সঙ্গী একজন দিলো পাল্টা কুঁই। সাথে সাথে আমিও দিলাম কুঁই। ওই খালের পাশ থেকেও ভেসে আসলো কুঁই, মানে শব্দের ইশারা। চারপাশ থেকে শব্দের ইশারা আসছে। মানে বিপদ কেটে গেছে! উঠে দাঁড়ালাম। আবার প্রায় এক কিলোমিটার পথ এই জঙ্গল ধরে হেঁটে গেলাম। খালের পাশে গিয়ে দেখি মজনু দাঁড়ানো সশস্ত্র সদস্যদের নিয়ে। ওই পাশ থেকে খবর এসেছে ততোক্ষণে। কাঁকড়া শিকারী ওরা। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটছিলো গল্প করতে করতে। সেই শব্দে আমরা ভয়ে পেয়ে লঙ্কাকান্ড করলাম!

কিন্তু কোথায় তারা? চলে গেছে? বাবু কোথায়? রহমতের নৌকা ফিরেছে? জানালেন, তিনজন কাঁকড়ার শিকারীকে আটকেছে বাবু। বন্দুক দেখে আরও কয়েকজন দৌড়ে দিছে। ওদেরকে নিয়ে একসাথে আসবে ওরা। ওদিকের খালে আর কেউ আছে কী না সেটাও চেক করে আসতে বলছি ওদের।

আর পারছি না। দুশ্চিন্তা গেছে। কিন্তু শরীরটা তখন বলছে যে বড় ঝড় চলে গেছে তার ওপর দিয়ে। মাচায় পা উঠিয়ে বসলাম। এনামুলকে বললাম, তালুতে অনেকগুলো কাঁটা ঢুকে আছে। বের করার চেষ্টা করো। ওদিকে চায়ের চুলাটা জ্বলছে। বাবুর্চিও আছে। চোখে চোখ পড়তেই বললো, আর বলা লাগবে না ভাই। পানি গরম তুলে দিচ্ছি নতুন করে।

আমার কাঁধে ওঠেন মামা। বললাম, কেন এনামুল? বললো, কাঁটা তুলতে হলে পা টা ধুতে হবে না? বলতে বলতে কাঁধে তুলে নিলো। খালের পাশে গিয়ে নৌকায় বসালো। তারপর দুইজন মিলে পা ধুলাম। নানা জায়গায় কেটে ছিঁড়ে গেছে ভুলেই গেছিলাম। কিন্তু লবণ পানি লাগার সাথে সাথে তীব্র জ্বালা শুরু হলো। কোনো রকমে গায়ের পায়ের কাঁদা ময়লা ধুয়ে এসে বসলাম মাচায়। মাটি থেকে একটা শক্ত কাঁটা তুলে পরিস্কার করে সেই কাঁটা দিয়ে পায়ে তালু থেকে ছয়টি কাঁটা বের করলো এনামুল।

খালের ভাটি খেকে গান গাইতে গাইতে আসছে কেউ। বইঠার শব্দ আর গান। বাঁক ঘুরতেই নজরে আসলো নৌকাটি। সামনে গুটগুটে বাবু দাঁড়ানো অস্ত্র নিয়ে। পিছনে বসে বৈঠা বাইছে রহমত। আসামীর মতো করে মাঝখানে বসা তিনজন কাঁকড়া শিকারী। ওদের কারণেই ভয়ে পেয়েছিলাম আমরা!

(ছবি: পায়ের তালু থেকে হেঁতাল কাঁটা তোলা হচ্ছে)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top