রূপান্তরের গল্প ১৫৭ | Rupantorer Golpo 157

পথে পথে নতুন বিপদ! ফিরতে পারলাম না! | রূপান্তরের গল্প ১৫৭

পথে পথে নতুন বিপদ! ফিরতে পারলাম না! | রূপান্তরের গল্প ১৫৭ | Rupantorer Golpo 157 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৫৭ : দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনাকে বিশ্বাস করিনি। তবে এখন করছি। আশা করি এই বিশ্বাসের সম্মান রাখবেন। দস্যুনেতা মজনুকে বললাম কথাগুলো। জানালাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও RAB মহাপরিচালক বিষয়টি জানেন। আপনার সঙ্গে দেখা করার বিষয়টিও জানেন উনারা। আমার তরফের কাজ সময় মতো করবো। তবে সেই কাজে সময় লাগবে না। যতো দ্রুত এখান থেকে ফিরবো, ততো দ্রুত বাঁকী কাজ শেষ হবে আমার। এরপর শুধু আপনার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। মজনু বললেন, আপনি চাইলে এখনও নিয়ে যেতে পারেন আমাদের। বললাম, মন্ত্রীর সময় সূচি নিয়ে ফিরে আসবো। নিয়ে যাবো আপনাদের।

ফিরে যাওয়ার কথা বলছি বার বার। কিন্তু সায় দিচ্ছেন না মজনু। এই জোয়ার চলবে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত। আমরা যদি আটটার দিকেও নৌকা ছাড়তে পারি তবে ভাটা শুরু হওয়ার আগে মাইনষালা ধরতে পারবো। মাইনষালা মানে লোকালয়। কোনো রকমে মালঞ্চের মুখ পর্যন্ত যেতে পারলে হয়।

মালঞ্চ নদী যেখানে চুনা নদীর সাথে মিশেছে সেই জায়গার নাম কদমতলা। বন বিভাগের একটি স্টেশনও আছে সেখানে। এই অঞ্চলের যারা সুন্দরবনে যারা মাছ-কাঁকড়া ধরতে আসেন, তাঁরা এই স্টেশন থেকে পার্মিট নিয়ে ঢোকেন। গোন শুরু হয়েছে। তাই রাতের ভাটায় অনেক নৌকা নামবে এই মালঞ্চ নদী দিয়ে। কদমতলার পশ্চিমে হরিনগর। সেখানে বেশ বড় একটি জেলেপল্লী আছে। এছাড়া টেংড়াখালী, কালিঞ্চি, গোলাখালী, কয়রার অনেক জেলেও এদিকে আসেন। চুনা নদী এদিক দিয়ে পশ্চিমে এসে মিশেছে চুনকুঁড়ি নদীতে।

তারপর মাথাভাঙ্গা নদী হয়ে মামদো নদীর মুখে পড়েছে চুনকঁড়ি। আরও পশ্চিমের নদীটির নাম কালিন্দী। উজান থেকে ইছামতী নদী এসে মিশেছে এর সাথে। একটু দক্ষিণে ভারতের সুন্দরবন থেকে বের হয়েছে রায়মঙ্গল। তারপর সেই নামে নেমে গেছে দক্ষিণে। ওদিকে মামদো নদীর সাথে মিশে পড়েছে সাগরে। কালিন্দী ও রায়মঙ্গলের পূর্বে বাংলাদেশ, পশ্চিমে ভারত।

কদমতলা থেকে পূর্ব দিকের লোকালয় মুন্সিগঞ্জ। এর পর কলবাড়ি, দাতিনাখালী ও বুড়িগোয়ালীনি। বড় নদী খোলপেটুয়া থেকে শুরু হয়েছে চুনা নদী। খোলপেটুয়ার মাঝে দ্বীপ জনপদ গাবুরা। তার ওপাশ দিয়ে নেমে গেছে কপোতাক্ষ নদ। তারও পূর্বে কয়রার বেদকাশী। গাবুরার দক্ষিণে খোলপেটুয়া নদী থেকে দক্ষিণে নেমে গেছে কলাগাছিয়া নদী। খানিকটা পথ পেরিয়ে মিশেছে মালঞ্চ নদীতে। মালঞ্চ আর মামদো নদী অনেকটা পথ সমান্তরাল নেমে গেছে দক্ষিণে, সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে। আরও দক্ষিণে খুলনা থেকে নেমে কালির চর-এ এসে আসা আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর সাথে। ডানে বামে সুন্দরবন রেখে এই নদী পড়েছে বঙ্গোপসাগরে।

দক্ষিণের বেহালা-কয়লা, মান্দারবাড়িয়া থেকে উত্তর তালপট্টী পর্যন্ত মজনু বাহিনীর রাজত্ব। উত্তরে কলাগাছিয়া থেকে রায়মঙ্গল পর্যন্ত এলাকায় মাছ-কাঁকড়া ধরতে যাওয়া জেলেদের চাঁদা দিতে হয় এই বনদস্যু দলকে। একই এলাকায় ছোট ছোট এলাকা ভাগ করে দস্যুতা করে জোনাব, আলিফ, আলম, কাজল, আমীর হোসেন, মুন্না, জিয়াসহ কয়েকটি ছোট-মাঝারি দস্যুদল। এদের সবার সাথে সবার যোগাযোগ হয় নিয়মিত। দস্যুতার বিষয়ে সমঝোতা করেই চলতো তারা। তবে কারও কারও মাঝে ব্যক্তিগত ক্রোধ ও ক্ষোভ ছিলো। সেটা না থাকলেও সামনা সামনি হলে কেউ কাউকে ছাড়ে না।

সুন্দরবনের দস্যুদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা প্রায়ই শুনি। মূলত এলাকা দখলের লড়াই চলতো খোলামেলা। কোনো দলকে পরাস্ত করতে পারলে অস্ত্রগুলোর মালিকানা চলে আসে বিজয়ী দলের হাতে। সেগুলোর মালিক হয় দস্যুনেতারা। জলদস্যু-বনদস্যুদের মালিকানা নির্ভর করে অস্ত্রের মালিকানার ওপর। এই জগতে দস্যুতার টাকা অস্ত্রের মালিকরা পায় ৬০ শতাংশ। বাঁকী টাকা দিয়ে চলে দলের বাঁকী খরচ। অলিখিত এই নিয়ম সবাই মেনে নেয়। কে, কবে ভাগাভাগির এই নিয়ম করেছিলো জানা নাই।

সন্ধ্যা নামবে নামবে। অর্ধেক জোয়ার হয়েছে ততোক্ষণে। সবাই মিলে জড়ো হয়েছি সরু খালটির ভিতরে। নৌকাগুলোর তলায় এসেছে জোয়ারের পানি। ভাসবে আধা ঘন্টার মধ্যে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে নানা গল্পে। কিন্তু দস্যুনেতা আমাদের ফিরতি পথ ধরার অনুমতি দিচ্ছেন না। আমার তাড়া আছে। কিন্তু ওরা না বললে যেতেও পারছি না। এখনই যেতে না দেওয়ার কারণ আছে নিশ্চয়ই!

সুন্দরবনে সন্ধ্যা নামে মন খারাপ নিয়ে। শরীর মন অবসন্ন। গত রাত থেকে বাসা কিংবা অফিসের সাথে যোগাযোগ হয়নি। যে অঞ্চলে আছি, সেখানে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নাই। শুধু ভরা জোয়ারের সময় একটু পাওয়া যায় নির্দিষ্ট জায়গায়। আবহাওয়া খারাপ থাকলে সেটুকুও থাকে না। বললাম, রাতে না ফিরলে একটু বাসায় ফোন দিতে হবে। ওরা বললো, জোয়ারের সময় খালের মাঝখানে গেলে ফোনে কথা বলতে পারবো। সুন্দরবনে আসলে একটা সমস্যায় পড়ি। এদিকে ছোট ছোট চাইনিজ ফোনগুলোতে ভালো নেট পাওয়া যায়।

স্মার্টফোনে পাই না। সেজন্য জলদস্যুরা ছোট ছোট ফোন ব্যবহার করে। নতুন ফোন আর সিম রাখা থাকে সব সময়। ঝামেলা হলেই ফোন আর সিম ফেলে দিয়ে নতুন সেট ব্যবহার করে তারা। শুধু বিকাশ নাম্বারগুলো পরিবর্তন করে না।খালের গোঁড়ায় দুইজন সশস্ত্র যুবক পাহাড়ায় বসা। নৌকায় আমরা। ঘুরে ঘুরে বনদস্যুদের সাথে কথা বলছি।

একটা হিসাব মিলছে না। আমাকে যেতে দিচ্ছে না। নৌকা একটা কম দেখছি। আবার দস্যুদের সবাইকে দেখছিও না। বাবুর্চি চা বসিয়েছে। বললাম, একটু দুধ চা না হলে চলছে না। র’ চায়ে নেশা কাটছে না। মাথাটা ব্যাথা করছে। সাথে সাথে এনামুল বলে, এখানে শুয়ে পড়েন মামা। মাথাটা বানায়ে দেই। শুয়ে পড়লাম। নৌকার খোলের ভিতর থেকে টাইগার বাম বের করে কপালে মাখিয়ে মাসাজ করলো। ভালো লাগছে। ঘুম চলে আসছে। কিন্তু ঘুমানো যাবে না কিছুতেই। বাবুর্চি চায়ের কাপ নিয়ে আসলো। বললাম, বিকালে রান্না করলে না যে? আজকে বিকালে ভাত খাবে না? কিছু একটা বলতে গেলো। অন্যরা চুপ করিয়ে দিলো। উঠে বসলাম।

কী হচ্ছে এখানে এনামুল? বললো, তেমন কিছৃ না মামা। আপনি রেস্ট নেন। পাশের নৌকায় আলমগীর ভাই বসা। বললাম, বাড়ি যাবো না ভাই? বললেন, ওই রাতের খাবার খেয়ে রওনা দিবোনে ভাই। এমনিতে রাতে রান্না হয় না। আজকে আপনার উছিলায় রান্না হবে। আর রাতের রান্না করবো আমি। বললাম, জোয়ার শেষ হতে আর তিন ঘন্টা। মানে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত স্রোত যাবে উত্তরে। ভাটায় তো আর এতো দূরের পথ বেয়ে যেতে পারবো না। কেমন করে কী হবে বলেন তো? দস্যুনেতা বসা পাশের নৌকায়। বললাম, আমাকে ফেরত পাঠাচ্ছেন না কেন ভাই? খোলামেলা বলেন তো!

মুখ খুললেন দস্যু সরদার। বললেন, একটু টেনশনের বিষয় বলে আপনাকে বলিনি। গত রাতে আলমগীর যে নৌকা নিয়ে নেমেছে এটা জানাজানি হয়ে গেছে। আপনি আসছেন সেটা জানে না। আমার কাছে যে বাজার আসছে সেই খবর RAB-এর ক্যাম্প জেনেছে। মুন্সিগঞ্জ ক্যাম্প থেকে সোর্সদের বলে দিয়েছে। কদমতলা, পশুরতলা আর মুন্সিগঞ্জে নৌকা নিয়ে বসা তারা। ফিরার পথে আটক করবে, এরকমই পরিকল্পনা তাদের। এদিক দিয়ে ফিরার সহজ পথ এটাই। কিন্তু এর মধ্যে আপনাদের পাঠানো কি ঠিক হবে? বললেন, আপনাদের কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু আলমগীর আর মাঝির সমস্যা হয়ে যাবে। এমনিতে তাদের বিপদের শেষ নাই। আমার সাখে সম্পর্ক থাকার কারণে ওরা থাকে তাড়ার ওপর।

দূর থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসলো। সন্ধ্যার সময় এমনিতে ঝুঁকি বাড়ে। তার ওপর সারা দিন দুশ্চিন্তা গেছে। এখন আবার গুলির শব্দ! ওরা বললো, ভয়ের কিছু নাই ভাই। গুলি অনেক দূরে হইছে। কেউ শিকার করতে পারে।

আলমগীর ভাইকে বললাম, টেনশন হচ্ছে ভাই? স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বললেন, আমাকে নিয়ে টেনশন করেন না ভাই। বেশি সমস্যা হলে ভেগে যাবো। মাস খানেক এদিক সেদিক ঘুরে আসবো। ভুলে যাবে আমার কথা। কিন্তু এই নৌকার মাঝির বিপদ হবে ভাই। বললাম, এটা খোলামেলা বললেই তো হয়। জঙ্গলে থাকতে আমার ভালোই লাগে। আর ডাকাতদের সাথে থাকতে আরও বেশি ভালো লাগে। বাবুর্চিকে বললাম, রাতের খাবার রান্না শুরু করো। আলমগীর ভাইয়ের হাতের রান্না খাবো আজ।

জোয়ারে ভেসে গেছে নৌকাগুলো। বললাম, এই জোলা খালের ভিতরে আর ভালো লাগছে না। বাতাসও নাই। বাইড়ে পোকা কামড়াতে শুরু করবে এখন। জঙ্গলে জোয়ারের পানি উঠলেই শুরু হয়। বড় খালের মাঝখানে চলেন। এনামুল বললো, জোয়ার চলে। এসময় জেলেরা ঢুকবে খালে। আমাদের দেখে ফেললে সমস্যা। তার ওপর আপনারা আছেন। আইনের লোকজনও ঢুকে পড়তে পারে। সাথে সাথে সেই গেওয়া গাছের গুঁড়িটি আনা হলো। আগুন জ্বালানো হলো। আরেক পাশে নৌকায় মশার কয়েল জ্বালিয়ে দিলো। একজন কিছু একটা দিয়ে হাত পাখার মতো বাতাস করছে। শুয়ে পড়লাম পাটাতনের উপর। ঘুমিয়ে পড়লাম।

খালের মুখে শোরগোলের শব্দ। থেকে উঠে দেখি পুরো বন থৈ থৈ করছে জোয়ারের পানিতে। নৌকা ঢুকছে একটা। খালের মুখে পাহাড়ায় থাকা দস্যুদের সাথে কথা বলছে তারা। কিছুক্ষণের মধ্যে পাশে এসে ভিড়লো। নৌকায় দুইজন সশস্ত্র তরুণ। বললাম, কই গেছিলা? বললো, এই তো পাশের খালে ভাই। আলমগীর ভাই বললেন, কী ব্যাপার? খালি হাতে কেন?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top