রূপান্তরের গল্প ১৬০ | Rupantorer Golpo 160

শেষ মুহুর্তে ভেস্তে যাচ্ছে সারেন্ডার! অপেক্ষায় ইলিয়াস আর মজনু | রূপান্তরের গল্প ১৬০

শেষ মুহুর্তে ভেস্তে যাচ্ছে সারেন্ডার! অপেক্ষায় ইলিয়াস আর মজনু | রূপান্তরের গল্প ১৬০ | Rupantorer Golpo 160 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৬০ : ঢাকা ফিরে পুরো শহরের মানুষ হয়ে গেলাম। দৈনন্দিন সাংবাদিকতায় ব্যস্ত হলাম। ওদিকে শ্যামনগরের বন উপকূলে দস্যু দল মজনু বাহিনীর সারেন্ডার নিয়ে আলোচনা কমে এসেছে। মজনুকে বলেছি তারা “সারেন্ডার করছে না” এই খবরটি ছড়িয়ে দিতে। আমি গেছি সে কথাও যেন কাউকে না বলে। পরিস্থিতি বুঝে বাড়ি ফিরেছেন আলমগীর। আমাদের সুন্দরবনের ভিতরে নিয়ে গেছেন যে মাঝি, তিনিও কাজকর্মে ব্যস্ত। মাঠ পর্যায়ে যারা সহযোগিতা করছেন তাঁদের বিরক্ত না করতে অনুরোধ করেছিলাম RAB-এর গোয়েন্দা প্রধানকে।

কয়েক দিনের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সময় দিলেন। ১২ জুলাই যাবেন তিনি। কোথায় হবে অনুষ্ঠান, দস্যুরা তখন সুন্দরবনের কোথায় থাকবে! RAB-এর হেফাজতে দিবো কখন, এসব নিয়ে পরিকল্পনা শুরু হলো। ২০১৬ সাল মনে হচ্ছে এই ব্যস্ততায় কাটবে। আপাতত মজনু বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করবে ১২ জুলাই সকালে। তার ঠিক দুই দিন আগে ঢাকা ছাড়বো আমি।

মজনু’র সাথে কথা চলছে। একই সঙ্গে কথা বলছিলাম RAB সদর দফতরের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। কিন্তু তখনও দস্যুনেতা ইলিয়াসের কথা জানতো না সবাই। হাতে সময় কম। তাই দ্রুত ইলিয়াসের আত্মসমর্পণের বিষয়ে অনুমোদন নিলাম। আমার কাজ শুধু মধ্যস্ততা করা। সেটি মাথায় রেখে যাবতীয় প্রস্তুতি নিলাম। ইতিমধ্যে দস্যুদের আত্মসমর্পণ নিয়ে সংবাদ তৈরি করে রাখলাম। প্রচার হবে নির্দিষ্ট দিনে। তার আগে ইলিয়াসকে নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকতে হবে। অনেক কাজ।

ফোন দিলাম। ইলিয়াস তখন মহা বিপদে। অজ্ঞাতবাস থেকে প্রথমে আমার কাছে আসবে। তারপর বনে ঢুকতে হবে অতি গোপনে। সেখান খেকে অস্ত্র-গুলিসহ ইলিয়াসকে নিয়ে যাবো মজনুর আস্তানায়। দুইটি দস্যুদল, তাদের সদস্য, অস্ত্র-গুলিসহ একসাথে তারা যাবে RAB হেফাজতে। পুরো কাজটি করতে সময় পাবো সর্বোচ্চ দুই দিন। RAB তাদের নিয়ে যাবে মংলায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন সেখানে, মংলার ফুয়েল জেটিতে।

RAB খুলনা’র সঙ্গে সব বিষয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু তাঁরা আমাকে ঠিক গ্রহণ করছেন না। মানে সময় সময় ফোন দিচ্ছি, কিন্তু প্রতি উত্তরে কাঙ্খিত উৎসাহ নাই। উনারা নিজে থেকে কোনো ফোন দিচ্ছেন না। যদিও উনাদের সঙ্গে মজনু’র নিয়মিত যোগাযোগ চলছিলো। অস্বস্তিতে আছি বিষয়টি নিয়ে। এতো জটিল একটি বিষয় নিয়ে কাজ করবো। প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে। কিন্তু সেভাবে কথা হচ্ছে না, উষ্ণতাও নাই।

আমি বুঝি যে উনারা আমার ওপর অসন্তুষ্ট। প্রথম আত্মসমর্পণ বরিশাল RAB এসে করেছে বলে মনক্ষুন্ন তাঁরা। কিন্তু সেজন্য আমার কোনো দায় নাই। মাস্টার বাহিনীর সারেন্ডারের প্রস্তাব নিয়ে তাঁদের কাছে গেছি সবার আগে। কিন্তু উনারা হয়তো আমাকে বিশ্বাস করেননি। ভরসা রাখেননি বলেই প্রতাখ্যান করেছেন। এদিকে বরিশাল থেকে মেজর আদনান ফোন দিচ্ছেন। পরের কাজগুলোও একসঙ্গে করতে চান। কী করি আমি? বিষয়টি RAB-এর গোয়েন্দা প্রধানকে জানিয়েছি। কিন্তু সমাধান আসছে না।

৮ জুলাই শেষ অফিস করবো। সেই রাতে রওনা দিবো সাতক্ষীরা সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। মজনুর ডেরায় যাওয়ার আগে ইলিয়াসকে সঙ্গে নিতে হবে। তবে কোন জায়গা থেকে সে আমার সঙ্গী হবে তা জানায়নি। শুধু বলেছে, সাতক্ষীরা শহরের কাছে সীমান্তবর্তী কোনো জায়গায় যেতে হবে। পরদিন সকাল বেলা আমাকে সাতক্ষীরায় থাকতে হবে।

দুপুরে ফোন দিলেন দস্যুনেতা মজনু। যা বললেন, তাতে আমার মাথায় হাত। জানালেন খুলনা হয়ে আত্মসমর্পণ করবেন না তিনি। বললাম, সমস্যা যাই হোক সমাধান করা যাবে। আপনি মাথা গরম করবেন না। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিন তারিখ চুড়ান্ত। কিছুতেই আররসময় পরিবর্তন করা যাবে না। উনি বললেন, সারেন্ডার করলে আদনান স্যারের মাধ্যমে করবো। বিষয়টি আরও জটিল হয়ে গেলো।

এমনিতেই ইলিয়াসকে নিয়ে ঝক্কি পোহাতে হবে। ৯ তারিখ সকালে তাকে আমার গাড়িতে তুলবো। সেখান থেকে সোজা মুন্সিগঞ্জ হয়ে সুন্দরবন ঢুকবো। ট্রলার ঠিক করা আছে অতি গোপনে। কারণ মাঠ পর্যায়ের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ধূলা দিয়ে সারতে হবে পুরো কাজ। ডাঙ্গা থেকে ইলিয়াসকে নিয়ে বনের গহীনে যেতে হবে। শিবসা নদীর কোনো খালে ঢুকতে হবে। অস্ত্রের প্যাকেট বের করে আবার ফিরতে হবে সাতক্ষীরা সুন্দরবনে।

মজনু বাহিনী থাকবে অপেক্ষায়। তাদের নিয়ে ফিরতে হবে মুন্সিগঞ্জ বা অন্য কোথাও। RAB সদস্যরা সেখানে অপেক্ষা করবে। এতোগুলো স্পর্শ্বকাতর কাজ একটানা করবো কী করে? একটু এদিক সেদিক হলে পুরো কাজ নষ্ট হয়ে যাবে। এতো দুশ্চিন্তা নিবো কী করে যদি কার কাছে তাদের জমা দিবো তা চুড়ান্ত না হয়? সবকিছু ঠিক থাকলে খুলনায় সারেন্ডার করার কথা মজনু’র। কিন্তু এখানেও তো প্যাঁচ লেগে গেলো!

গোয়েন্দা প্রধান লে কর্নেল আজাদের কাঁধে সমাধানের ভার দিয়ে রওনা হলাম আমরা। ফেরিতে চড়ে পদ্মা নদী পার হয়ে সাতক্ষীরা পৌঁছাতে ১২ ঘন্টা সময় লাগবে। তারপর সময় মতো ইলিয়াসকে তুলতে হবে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দেয়া শুরু হলো।

পুরো পথ ফোনেই আছি। মজনু’র সমস্যাটি বড় আকার ধারণ করলো। কোনো ভাবেই মানানো যাচ্ছে না। তার একটাই কথা, খুলনা না, বরিশাল RAB-এর মাধ্যমে সারেন্ডার করবে। পরে কারণটা জানতে পারলাম আলমগীর ভাইয়ের মাধ্যমে। খুলনার এক কর্মকর্তা মজনুকে বলেছেন, তাদের মাধ্যমে সারেন্ডার করতেই হবে। তা না হলে সমস্যা হবে তাদের। পরে খুলনায় বসবাস করতে হলে এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। ম আর শর্ত একটাই, সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিমের মাধ্যমে সারেন্ডার হবে না। সরাসরি তাদের কাছে আসতে হবে মজনু বাহিনীকে। এই শংকা শুরু থেকেই ছিলো। তার সমাধানও করতে পারবো। কিন্তু এই এক বেলার মধ্যে সেটি অসম্ভব।

গাড়ি চলছে সাতক্ষীরার পথে। ফোন সাইলেন্ট করে চুপচাপ বসে রইলাম। সহযাত্রীদের বললাম, যেকোনো সময় এই সফর বাতিল হতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top