ঘুরে গেলো ঘটনা, যাচ্ছি সুন্দরবন | রূপান্তরের গল্প ১৬১ | Rupantorer Golpo 161 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৬১ : ফোনের পর ফোন আসছে। আমি চোখ বন্ধ করে বসে আছি। গাড়ি চলছে। ভাবছি কী করা উচিৎ আমার। মানিকগঞ্জ পার হয়ে চায়ের বিরতি নিলাম। যদি ফেরতই আসতে হয় তবে আর পদ্মা নদী পার হবো না। চা বিরতিতে কয়েকটি ফোন করবো। তারপর হবে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ইলিয়াসকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। কারণ সে আসবে ভারত থেকে। সেখানকার সবকিছু গুছিয়ে সে চলে এসেছে সীমান্তে। রাতেই পার হবে চোরাই পথে। সঙ্গে তার স্ত্রী ও সন্তান ফাতেমা। নিয়মিত কথা হচ্ছে তার সাথে। সবকিছু যেন ঠিকঠাক আছে, সেভাবে কথা বললাম। ফোন দিলাম দস্যুনেতা মজনুকে। বললাম, আমাকে বাদ দিয়ে সারেন্ডার করলেও আপত্তি থাকবে না। আপনারা সরাসরি RAB হেফাজতে চলে যান।
আমরা ডাকাতি করতে করতে মরে যাবো ভাই। তবুও আপনাকে বাদ দিয়ে সারেন্ডার করবো না। আরও অনেক ঘটনা ঘটে গেছে ভাই। যদি দেখা হয় বলবো। শুধু এটুকু বলি, খুলনায় যাবো না। বললাম, আমি পথে আছি। আপনারা যেভাবে আছেন সে ভাবেই থাকেন। ফোনটা অন রাখবেন, নেটওয়ার্কে থাকেন। আপাতত কারও সাথে এসব নিয়ে আলোচনা করবেন না।
ফোন আসলো ঢাকা থেকে। RAB সদর দফতরের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা। বললেন, দস্যুদের আত্মসমর্পণ নিয়ে কোনো সংকট তৈরি হয়েছে? সমস্যাটি কোথায়? বললাম, আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা নাই। প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। কোনো কিছুই পরিকল্পনার বাইরে করছি না। কিন্তু মজনু বাহিনী কার মাধ্যমে সারেন্ডার করবে বিষয়টি নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। খোলামেলা বললাম, এক পক্ষ্য চায় মধ্যস্ততায় না থাকি। আরেক পক্ষ্য আমাকে ছাড়া সারেন্ডার করবে না। বললাম, আমি রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমিও আর এগুবো না। ঢাকা ফিরে আসবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
মিনিট দুই এর মধ্যে ফোন করলেন RAB-এর গোয়েন্দা প্রধান। বললেন, মোহসীন ভাই, আপনি না কি ফেরত আসবেন? বললাম, আপনিই বলেন বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমার কী করা উচিৎ? বললেন, আমি সবকিছু ঠিক করে দিচ্ছি। আপনি এগুতে থাকুন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আবারও ফোন করলেন তিনি। বললেন, বরিশাল RAB কাজ করবে। মেজর আদনান কবীর ফোন দিবে আপনাকে। কথা বলেন তার সাথে, পরিকল্পনা করে কাজ এগিয়ে নিন।
গোয়েন্দা প্রধানের ফোন রাখতেই ফোন করলেন বরিশাল RAB-এর অধিনায়ক লে কর্নেল ফরিদ। বললেন, মাথা ঠান্ডা করে কাজ করতে হবে। ১২ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন। দস্যু বাহিনীগুলোকে তুলে আনতে না পারলে মান সম্মান থাকবে না।বরিশাল থেকে পরের ফোনটি ছিলো মেজর আদনান কবীরের। বললেন, আপনি সাতক্ষীরার দিকে এগুতে থাকেন ভাই। সকালের মধ্যে আমাদের টিমও পৌঁছে যাবে সাতক্ষীরা।
ইলিয়াসকে নেওয়ার সময় কি তাহলে RAB-এর টিম থাকবে? আদনান বললেন, অবশ্যই থাকতে হবে ভাই। অনেক বেশি স্পর্শ্বকাতর সবকিছু। ইলিয়াস মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল, সুন্দরবনের দস্যুনেতাদের মধ্যে শীর্ষে তার নাম আসে। RAB, পুলিশ, কোস্টগার্ড সবাই কিন্তু খুঁজছে তাকে। বললাম, আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবো।
আমার সহকর্মীদের মন খারাপ। চায়ের দোকানে বসা। পাশে গিয়ে বসলাম। বললাম, আমরা ঢাকা ফিরছি না। এই রাতের মধ্যে সাতক্ষীরা পৌঁছাতে হবে। রওনা হলাম। পথে ফোনে ফোনে সবকিছু ঠিকঠাক করতে হবে। অনেকের সাথে কথা বলতে হবে। প্রথম কাজ হবে ডাকসাইটে দস্যুনেতা ইলিয়াকে সঙ্গে নেওয়া। এবং সেটি করতে হবে সর্বোচ্চ গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে। সাতক্ষীরার কোন জায়গা থেকে তাকে নিবো জানি না এখনও।
পাটুরিয়া ফেরি ঘাট পার হলাম। তারপর সোজা সাতক্ষীরা। তখন ভোর পাঁচটার মতো বাজে। বরিশাল থেকে তখনও RAB-এর দল এসে পৌঁঁছেনি। অফিসের গাড়ির স্টিকার খুলে রাখলাম। রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে অপেক্ষায় রইলাম। সকাল সাতটার দিকে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন। ওপাশে ইলিয়াস। বললো, চলে আসছি ভাই। আপনারা দ্রুত আসেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে আসলো RAB এর গাড়ি। এএসপি জসীম উদ্দিনের নেতৃত্বে সেই দল নিয়ে রওনা হলাম আমরা। নির্দিষ্ট একটি জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবো। ইলিয়াস আমাদের খুঁজে নিবে। শহরতলী ছেড়ে সীমান্তের পথে চলছে গাড়ি। সামনে আমরা, একটু ব্যাবধান রেখে পিছনে এএসপি জসীমের গাড়ি বহর। নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। ঝড়ের গতিতে গাড়িতে এসে উঠলো দস্যুনেতা ইলিয়াস। সঙ্গে তার সন্তান ও স্ত্রী। কোনো দিকে না তাকিয়ে ছুটলাম শ্যামনগরের দিকে।
মুন্সিগঞ্জ প্রায় তিন ঘন্টার পথ। সুন্দরবনে ঢুকতে হবে। সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সঙ্গে সারতে হবে প্রথম কাজ। কলবাড়িতে একটি রিসোর্ট আছে। সরাসরি সেখানে গেলাম। সেখানে জেটিতে রাখা একটি ট্রলার। পর্যটকের বেশে নেমে পড়লাম নদীতে। চুনা নদী ধরে সুন্দরবনে ঢুকে পড়লাম দ্রুততম সময়ের মধ্যে।
একটার পর একটা খাল নদী পেরিয়ে উঠলাম শিবসা নদীতে। সে এক কঠিনতম পথ। মনে রাখার মতো সফর!